উদীচী মানে তেজস্বী ঢেউ

সুশান্ত দাস(প্রশান্ত)

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংক্ষেপে উদীচী হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে সারাদেশে উদীচীর তিন শতাধিক শাখা রয়েছে। দেশের বাইরেও ছয়টি দেশে শাখা রয়েছে উদীচীর। যুক্তরাজ্যে উদীচী প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালের ১৪ই অক্টোবর। তবে ১৯৮৮ সাল হতে উদীচীর সংগঠন গড়ে তুলার চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করেন কেউ কেউ। এমন তথ্য জানা যায় লেখক মাহমুদ এ রউফ এর লিখা বিভিন্ন বই ও আলাপচারিতা থেকে। এবার ২০২৩, সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংসদ “সংস্কৃতির সংগ্রামে দ্রোহের দীপ্তি
মুক্তির লড়াইয়ে অজেয় শক্তি” স্লোগানকে সামনে রেখে উদীচীর ৫৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে।

যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠাকাল হতে এখন পর্যন্ত ১৩টি কমিটি হয়েছে সংগঠনটির। বর্তমানে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি হারুন অর রশীদ ও সাধারণ সম্পাদক জোবের আখতার সোহেল।
বিলেতের মিশ্র সংস্কৃতির মধ্যে বাঙ্গালীর মূল সংস্কৃতির গোড়াপত্তন, প্রগতিমনা সাংস্কৃতিক কর্মীকে একসাথে সংঘবদ্ধ করা ও নতুন প্রজন্মের মজ্জ্বায় শিকড় সংস্কৃতি বিস্তীর্ণের লক্ষ্যে ৩৫ সদস্য ও ৩ উপদেষ্টার সমন্বয়ে লুসি রহমানকে সভাপতি এবং সৈয়দ বেলাল আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রথম উদীচী কমিটি করা হয়। নাটক সংগীতে বিভিন্ন দলে উপদলে ভাগাভাগি হয়ে উদীচী তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশ পরবাস হলেও বৈশ্বিক ও পাশ্চাত্য সমাজ সংস্কৃতির সাথে  মানবিক ও প্রগতির কাজে সম ও সমান্তরাল ভাবে বুক চেতিয়ে কাজ করে যাচ্ছে উদীচী, যা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আলোর দিশারী হিসেবে পরিচিত। তবে এখানেও যে উদীচীর উপর শকুনের দৃষ্টির আচর কাটেনি তা কিন্তু ঠিক নয়।  কেউ কেউ উদীচীকে করতে চেয়েছে পকেটস্থ। করতে চেয়েছে কোম্পানী। কিন্তু উদীচী কারো পকেটস্থও নয়; কোন কোম্পানীও নয়। উদীচী গণমানুষের। ফলে ঢেউয়ের তরঙ্গের ন্যায় কৌশলে উদীচী ‘সত্যেন সেন স্কুল অব পারফর্মিং আর্টস’ এর মাধ্যমে “বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী” সুনামে স্বনামে ধাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এবং স্বমহিমায় “বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী” নামে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বিলেতের বিভিন্ন শহরে শাখা প্রশাখায়। এতো এতো আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের মাঝেও বিশ্বদরবারে মোড়লদের শোনাতে টেমসের পাড়ে বসে উদীচী শোনাচ্ছে সত্যেনের একতারার সুর। রনেশের একতারার সুর। ভোগবাদী সমাজে ঝড়েপরা প্রান্তজনের সুর। যে সুর এক সময়ে পদ্মা, ধলেশ্বরী,ইছামতি কিংবা বুড়িগঙ্গা হতে আসলেও এখন টেমস হতে পদ্মা, ধলেশ্বরী, ইছামতি,বুড়িগঙ্গা, কিংবা প্রশান্ত, আটলান্টিক বা বঙ্গোপসাগরের উত্তাল দরিয়া পেরিয়ে সারা বিশ্বে বহমান। সভ্য, সাম্য ও সমতার খোঁজে উদীচী এখন সারা বিশ্ব সক্রিয়।

উদীচী শব্দটির বীজ আমার মধ্যে বপন হয় সেই শিশু বেলায়। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন শাল্লা কলেজের নবীণ বরণ অনুষ্ঠান(১৯৮৭/৮৮) ও সারা গ্রাম জুড়ে বড় পোস্টারিংয়ের মাধ্যমে। যিনি ঘটিয়ে ছিলেন তিনি আরেক হাওর প্রকৃতির পু্ত্র কমরেড শ্রীাকান্ত দাশ। উদীচী ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও প্রতিষ্ঠাতা বা প্রতিষ্ঠাতাগনের সংগে তাঁর পরিচয় ঘটে ১৩৫০ বাংলার ফাল্গুন মাসে(১৯৪৩/১৯৪৪)। সুরমা উপত্যাকায় ৮ম কৃষক সম্মেলনে গণসংগীত পরিবেশনে। যেখানে আলোর দিশারীগন ছিলেন করুনাসিন্ধু রায়(কমরেড বরুন রায়ের বাবা), লালা শরদ্বিন্দু দে, অজয় ভট্টাচার্য, সুরত পাল, বীরেশ মিশ্র, ইরাবত সিংহ, কমরেড মনিসিংহ, রাখাল বাবু, আদম আলী, তারা মিয়া, প্রবোধ নন্দ কর, সত্যেন সেন, রনেশ দাসগুপ্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী প্রমুখ। ফলশ্রুতিতে সেদিনের আলোর আভায় হয়তো তৎক্ষিনক সময় না পারলেও আশির মাঝামাঝি কিংবা নব্বই দশকে কমরেড শ্রীকান্ত দাশ গড়ে তুলেছিলেন হাওর বেষ্টিত শাল্লা উদীচী।

সত্যি বলতে কি, এই প্রকৃতির দানকে প্রকৃতির সন্তানেরাই আঙ্গুল তুলে জিজ্ঞাসা করার ক্ষমতা রাখেন। কারন তাঁরা চিন্তায় ও মননে অনুসন্ধিৎসু। তাঁরা বিশেষ ভাবে জানার অনুসারী। তাঁরা প্রগতির দূত। তাঁদের চিন্তা চেতনায় সমাজ আলোকিত, আমরা আলোকিত। তাঁরা আলোর দিশারী। তাঁদের পুঞ্জিভুত চিন্তাশক্তি দিয়েই আমাদের আলোর দিশারী ‘উদীচী’। হয়তো সত্যেন সেন তাঁর অনুসন্ধিৎসু জিজ্ঞাসা হতে, সমাজ প্রগতির লক্ষ্য রেখে প্রকৃতি হতে ‘উদীচী’ শব্দটিও বাছাই করেছিলেন। যার অর্থ আমরা বিভিন্ন ভাবে বিশ্লেষন করে থাকি। উদীচী অর্থ উত্তর দিক বা ধ্রুব তারা’র দিক। দিকহারা নাবিকেরা যেমনি উত্তর দিকে ধ্রুব তারা’র অবস্থান দেখে তাদের নিজ নিজ গন্তব্য স্থির করে; তেমনি এদেশের সংস্কৃতি তথা গণমানুষের সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সবকিছুই উদীচীকে দেখে তার চলার পথ চিনতে পারে।

কারো লেখাতে একবার প্রকৃতির পুত্র রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পড়েছিলাম, যা সঠিক ভাবে মনে করতে পারছি না। তবে লেখাটির মূলভাব ছিল প্রায় এভাবেই- রবীন্দ্রনাথকে পড়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে জানা যায় কিন্তু একজন রবীন্দ্রনাথকে বানানো যায় না। যেমনি নজরুল, রোকেয়া, সুকান্ত, জীবনানন্দ এদেরকেও বানানো যাবে না, সর্বোচ্চ জানা যাবে। তেমনি পদ্মা, ধলেশ্বরী, ইছামতি নদী বিধৌত এক সময়ের নিচু ভূমি টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামের পুত্র সত্যেন সেন(লস্কর )। তাঁর আরেক কাণ্ডারি চায়ের নগরী আসামের ডিব্রুগড়ের পুত্র রনেশ দাশগুপ্ত। যাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার গাউরদিয়া গ্রামে। এই উভয় শিল্পী সংগ্রামী বাঙ্গালির মননচর্চা ও মুক্তি-প্রয়াসকে বলবান করার ঋষিতুল্য। তাঁদেরকেও বানানো যাবে না, সর্বোচ্চ জানা যাবে।

আর হাওরবিল বা হাওরপাড়ের কথা কি লিখবো? রাধারমন, হাছন রাজা, বিপিন পাল, মনিসিংহ, বারীন দত্ত, হেমাঙ্গ বিশ্বাস হতে এযুগের বাউল আব্দুল করিম যাঁরা হাওরের কাদামাটি ভাসান পানির ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ কিংবা চাঁন কপালী আফালের ঢেউয়ের প্রকৃত দৃশ্য দেখে যাঁদের জন্ম ও জীবন অতিবাহিত। যদিও যুক্তির খাতিরে বলা চলে সময়-ই তাঁদের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এটা ওতো মানতে হবে প্রকৃতির দান তাঁদের ধ্যান-ধারনা চিন্তা-ভাবনা, সমাজের আধাঁর দূরীকরনে সমাজ প্রগতির এক বড় আলোর মশাল। যা দেখে দেখে মুক্তমনা, মুক্তচিন্তার প্রজন্মরা সমাজ প্রগতির সামনের দিকে হাঁটছে। আলোর দিশারী হিসাবে কাজে লাগাছে। আর সেই কাজটি করে গিয়েছেন ১৯০৭ সালের জন্ম নেওয়া সেদিনের সত্যেন সেন(লস্কর),  ১৯৬৮ সালের ২৯শে অক্টোবর উদীচীকে জন্ম দিয়ে।
শোষক ও শোষিত বিভক্ত সমাজে, সাম্য সমাজের জন্যে লেনিন যেভাবে কাস্তে ও হাতুড়ী চিহ্ন দিয়ে সারা  দুনিয়ায় কম্পন তুলেছিলেন, ঠিক তাঁর উত্তরসূরি হিসাবে সত্যেন সেনও ঢাকর উত্তর পার্শ্ব
হতে বাংলাসুরের মাধ্যমে, বাউলদের প্রতীক একতারা দিয়ে কামার-কুমার, মাঝি-মাল্লা, চাষা-ভুষা হতে হাওর বিল শহর পেরিয়ে গ্রামগঞ্জে খুব সহজে পৌঁছে দিয়েছেন উদীচীকে। সেই ৬৮, ‘৬৯, ’৭০, ’৭১ সালে বাঙ্গালির সার্বিক মুক্তির চেতনা হতে, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিটা আন্দোলন সংগ্রাম হতে এখন পর্যন্ত শাণিত করেছেন মানুষের প্রগতির চিন্তাকে, মানুষের অধিকারের সচেতনাকে।

আমরা জানি পানির খরস্রোতের যে ধার,মহাসাগরের ন্যায় ভাসান পানির যে প্লাবন, উসকিলে চাঁন কপালী ঢেউ কিংবা শান্ত অবস্থাও ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের আঘাত, যে প্রতিনিয়ত আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ করে অস্থিত্ব। বিলীন করে ছাড়ে নদী মোহনার পাড় হতে গাঁও গেরাম,গঞ্জ থেকে শহরকে। অপরদিকে তার(পানির) প্রবাহমান চলা হতে আধুনিক সভ্যতার ‘বিদ্যুৎ’। এইযে শান্তাবস্থায় স্থিতিশীল হতে পানি পরিচয় করিয়ে দেয় ভাব-সুন্দর হতে মনোহর আবার গতিশীল অবস্থা হতে দেয় বিদ্যুৎ, বৈরি পরিবেশে উসকিলে চাঁন কপালী তেজস্বী ঢেউ। সেই প্রাকৃতিক রূপ পরিবর্তন হতে শিক্ষা নিয়ে হয়তো নারিন্দা, বাংলাবাজার, গোপীবাগ, চামেলীবাগ যে যাহাই বলেন, বুড়িগঙ্গার পাড়ে ঢাকার সত্যেন কিংবা পদ্মা, ধলেশ্বরী,ইছামতি নদী বিধৌত নিচু ভূমি, টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সোনারংয়ের পুত্র লস্কর; তাঁর চিন্তাকে শাণিত করে বহি:প্রকাশ করেছেন উদীচীর মাধ্যমে। আর তাই তো পদ্মা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, বুড়িগঙ্গা ডিঙ্গিয়ে বঙ্গোপসাগর,কালীদহ মহাসাগর(সমগ্র ভাটি অঞ্চল,উল্লেখ্য মনসামঙ্গল)পেরিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগরের এপাড় ওপাড় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র তথা সমগ্র বিশ্বে বাংলার গণমানুষের কাছে তেজস্বী ঢেউয়ের ন্যায় উদীচী তাঁর সক্রিয়তা দেখাচ্ছে। যে ঢেউ ‘৬৮, ‘৬৯, ’৭০, ’৭১ কিংবা ৭৫-এর ১৫ আগষ্ট হতে বাংলার সংস্কৃতি জাতিসত্ত্বা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সম্প্রীতির উপর যখনই অপশক্তি কালো থাবার হুল ফুটিয়েছে তখনই অপশক্তিকে লন্ডভন্ড করে ছেড়েছে উদীচী।

সুশান্ত দাস(প্রশান্ত): সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী

 

 

 

 

You might also like