কেমন করে বেঁচে আছি এই করোনায়: পর্ব-৫

দিলীপ মজুমদার

৫ নভেম্বর । আমাদের পল্লববাবু একটু ভিতু মানুষ । করোনা সংক্রমণ শুরু হবার পর থেকে তিনি কেমন গুটিয়ে গেছেন । সেদিন ফোনে আমাকে বললেন, ‘দাদা, কলকাতা মেডিকেল কলেজের সেরো সমীক্ষা কী বলছে দেখেছেন ? বলছে করোনার উপসর্গহীনরাই সুপার স্প্রেডার । কী হবে দাদা !’
-‘কিসের কী হবে ?’ জানতে চাইলাম ।
-‘কে যে উপসর্গহীন কী করে জানব ! আবার সামনে পুজো । হুজুগে বাঙালি ঠাকুর দেখতে গিয়ে করোনার বন্যা ডেকে আনবে যে !’
ভিতু মানুষকে ধমক দিলে কাজ হয় । আমি তাঁকে প্রায় ধমকে বললাম, ‘ ছাড়ুন তো এসব সমীক্ষার-টমীক্ষার কথা । তাকিয়ে দেখুন গরিব মানুষগুলোর দিকে । আপনার বাড়ির সামনে যে মাছওয়ালা, সবজিওয়ালারা রোজ আসছে, তাদের কতজনের করোনা হয়েছে ? বস্তিগুলো তো সমীক্ষা অনুযায়ী উজাড় হবার কথা । তা তো হয় নি ।’
পল্লববাবুর ভয় কাটাবার জন্য এসব বললাম বটে, কিন্তু মনের ভেতরে প্রশ্ন থেকে গেল । আজকের হিসেবে বিশ্বে ৪ কোটির বেশি মানুষ করোনা আক্রান্ত, মৃত্যু হয়েছে ১১ লক্ষেরও বেশি মানুষের । ভারতে আক্রান্ত ৭৫ লক্ষ, মৃত্যু ১ লক্ষের বেশি । আক্রান্ত ও মৃতের এই বিপুল সংখ্যার মধ্যে গরিব মানুষ কত জন তার সঠিক পরিসংখান জানা নেই ।
তবে বায়ুদূষণ ব্যাপারটাকে যে ঘোরালো করে দিতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই । প্রতি বছর বায়ুদূষণে বিশ্বে ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় । সেই বার্ষিক দূষণের সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে সার্স-কোভ ২ রেসপিরেটরি ভাইরাসের সংক্রমণ । ভারতে ১৭% কোভিদ মৃত্যুর কারণ বায়ুদূষণ । ইন্ডিয়ান অ্যাশোসিয়েশন অফ রেসপিরেটরি কেয়ার-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট আর্থার সদাননধম বলেছেন, ‘বায়ুদূষণের কারণে স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা না হারালে হয়তো কোভিদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারত ফুসফুস । যেহেতু তা ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত, তাই সেই লড়াই সে চালাতে না পেরে কোভিদের কাছে হেরে গিয়েছে ।’
পুজো নিয়ে পল্লববাবু যে ভয়টা করছিলেন, সে ভয় আমারও ছিল । গণমাধ্যমেও খুব চর্চা হচ্ছিল তার । ভয়কে জয় করে আমি আর আরতি বিশ্বকর্মা পুজোয় মধ্যমগ্রামে দুষ্টুদের কাছে গেলাম । মধ্যমগ্রাম, বারাসতে করোনার প্রকোপ বেশি । কিন্তু গিয়ে দেখলাম সেখানকার মানুষও ভয়কে

জয় করে ফেলেছে । রাস্তা-ঘাট স্বাভাবিক । দোকানপাট খোলা ।মাস্কপরা লোকের সংখ্যা হাতেগোনা । দুষ্টুদের কারখানায় গিয়ে একই দৃশ্য দেখলাম । দুষ্টু বলল, ‘করোনা মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে । টিভি বা খবরের কাগজের খবর আর মানুষকে ভয় দেখাতে পারছে না । মানুষ বুঝে গেছে সর্দি-কাশির মতো করোনা থেকে যাবে ।স্মিতা বলল, ‘তাছাড়া প্রতিযেধক তো এসে যাচ্ছে ।’দুষ্টুদের কারখানার ম্যানেজার টিপ্পনি কাটে, ‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেলের মতো ।স্মিতা বলে, আমেরিকা তো টিকা তৈরি করে ফেলেছে । ৩ নভেম্বরের মধ্যে টিকা আসবে বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন ।ঘোড়ার ডিম । সামনে নির্বাচন, তাই পাগলা দাশু গোঁপ-খেজুরে করছে ।বিজ্ঞানী অ্যান্টনি ফাউচি কী বলেছেন, তা দেখনি ?’
-‘কী বলেছেন ফাউচি ?’
-‘ বলেছেন বছরের শেষে প্রতিষেধক আনার বিষয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী ঠিকই । কিন্তু তা বলে নির্বাচনের মধ্যেই প্রতিষেধক আনার প্রতিশ্রুতি অবান্তর । আমেরিকা এখনও ভাইরাসের প্রকোপে কাবু। আমরা ভুল পথে যাচ্ছি । যদি এভাবেই চলতে থাকে, তবে দেশের মানুষকে আরও অনেক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে ।নেতা-মন্ত্রীরা মানুষকে অকাতরে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান । এই প্রতিশ্রুতির রস পান করে গরিব-গুর্বো মানুষ বেঁচে থাকে । নির্বাচনের পরে নেতারা সেসব প্রতিশ্রুতির কথা বেমালুম ভুলে যান । আমাদের দেশেও প্রতিশ্রুতির বান ডাকে । সেই আগস্ট মাস থেকে শুনছি প্রতিষেধক এল বলে । কিন্তু সিরাম ইন্সটিটিউটের প্রধান আদর পুনাওয়ালা বলে দিয়েছেন এ বছরের ডিসেম্বরে ছাড়পত্র পেলেও আগামী বছরের মাঝামাঝির আগে অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রা জেনেকার কোভিদ ১৯এর টিকা পাওয়া যাবে না । ভারত বায়োটেকও একই কথা বলেছে । করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি নিয়ে খুব হইচই হচ্ছিল মাস দুই-তিন আগে । কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক এখন সে থেরাপি বাতিল করে দিয়েছেন । কারণ তাতে কোন কাজ হচ্ছে না ।বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানকর্মীরা প্রতিষেধকের ব্যাপারে লেগে আছেন । কেউ কেউ দিন-রাত এ্ক করে

দিচ্ছেন । নানাজনে নানা পথে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করছেন । যেমন টেক্সাসের ভারতীয় বংশোদ্ভূত অনিতা চেবরেলু  তিনি ‘ইনসিলিকো’ পদ্ধতির সাহায্যে একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ তৈরি করেছেন । তাঁর মতে এই যৌগ সার্স-কোভ ২ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে জুড়ে গিয়ে তাকে দুর্বল করে দেবে ।নেতা-মন্ত্রীরা্ তো পরজীবী বা প্যারাসাইট । তাঁরা বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বকে আত্মসাৎ করে নিজেদের ঢক্কানিনাদ করেন । সেজন্য এঁরা তাড়া দিচ্ছেন বিজ্ঞানীদের । বিজ্ঞানীরা সামান্য আলোর পথ দেখতে পেলে তাকে অসামান্য করে প্রচার করছেন নেতা-মন্ত্রীরা । সেজন্যই সতর্ক করেছেন অ্যান্টনি ফাউচি, বলেছেন, ‘আমরা ভুল পথে যাচ্ছি’ । আমার আরও একটা কথা মনে হয় । নানা দেশে এ বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে । কিন্তু সব দেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে এক আন্তর্জাতিক গবেষণাকেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে না কেন !তা কিন্তু হবার নয় । কোন একটি দেশের গাবেষণায় কৃতিত্বের সঙ্গে সেই দেশের নেতা-মন্ত্রীদের স্বার্থ যে জড়িত । ক্ষুদ্র স্বার্থ তাঁরা বিসর্জন দিতে পারবেন না ।মধ্যমগ্রাম থেকে ফিরে আসার পর সপ্তমীতে দুষ্টু আর স্মিতা বাড়িতে এল । মামনিও এল পরের দিন । পুজোর তিনটে দিন ভালোই কাটল । আমি দৈনিক করোনা সংক্রমণের দিকে নজর রেখেছিলাম । না, সংক্রমণ বাড়ে নি । আশা করি কালীপুজোও ভালোভাবে উতরে যাবে । বাজির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে ।কিন্তু কালীপুজোর আগে স্মিতা ফোন করে জানালো দুষ্টুর জ্বর হয়েছে । খুব দুর্বল । কারখানায় যাচ্ছে না । কারখানা-পাগল দুষ্টুর কারখানায় না যাওয়া একটা খবর । তাহলে কী সে খুব অসুস্থ ? স্মিতা চিন্তা করতে বারণ করল কিন্তু দিন দুই পরে নিজেই জানালো যে তারও জ্বর হচ্ছে। অল্প একটু পেটখারাপ হচ্ছে তাদের ।এসব কিসের লক্ষণ ? মাস তিনেক আগে তাদের করোনা সংক্রমণ হয়েছিল । আবার কী…. । মামনিও একই লক্ষণের কথা বলল ।

কিন্তু আরতি শয্যাশায়ী হয়ে পড়তে অন্ধকার দেখলাম চোখে।তার অল্প জ্বর।পেটখারাপ । বমিভাব । কিছু খেতে পারছে না । ভীষণ দুর্বল।নিজের হাতে গড়া ছাদের যে বাগানে একদিন না গেলে,গাছেদের পরিচর্যা না করলে,তাদের সঙ্গে কথা না বললে সে স্বস্তি পায় না, সেই ছাদ-বাগানে সে যেতে পারছে না।ভাগ্যিস, অনুপ আর তনুর মতো প্রতিবেশী ছিল ! তারা খাবার জুগিয়ে গেছে।আমি ডা: চক্রবর্তীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলাম।তিনি ভিটামিন সি ও ডি-র ক্যাপসুল দিলেন, লিভারের ওষুধ দিলেন।আর বলে দিলেন, দিন তিন/চারের মধ্যে অসুস্থতা না কমলে করোনা টেস্ট করাতে হবে।বাড়িতে যাতে টেস্ট হয়, সে ব্যবস্থা তিনি করবেন।দুষ্টু-স্মিতা আর মামনিকেও সে সব ওষুধ দেওয়া হল।দিন চারেকের মধ্যে তারা সুস্থ হল।তবে দুর্বলতা কাটতে সময় লাগল।আমার ধারণা,ওদের করোনা বা করোনার মতো কিছু হয়েছিল।বহুরূপী করোনা নানা রূপে দেখা দেয়।সেই বহু রূপে সম্মুখে তোমার মতো ।কিন্তু চুয়াত্তরে পা দিয়েছি যে আমি,আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা যার সবচেয়ে বেশি ছিল, সে একই বাড়িতে থেকে এখনও অক্ষত।হয়তো করোনা আমার মতো নাস্তিককে স্পর্শ করতে ঘৃণা বোধ করেছে ।

লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।

You might also like