ফিরে দেখা বিজয়ের মাস
সৈয়দ রকিব
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর।
১৯৭১ সালের ৬ই ডিসেম্বর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে এক তরফা যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ৬ই ডিসেম্বর আমাদের সময় সকাল ১১টায় ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। আমার মনে আছে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে রেডিও শুনতে ছিলাম। আকাশবাণী কলকাতা থেকে ভারতের স্বীকৃতির ঘোষণা আসে। কি আনন্দ সকলের কাছে। একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হতে চলেছে, অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী (যৌথবাহিনী) অভিযান শুরু করেছে বাংলাদেশের সকল অঞ্চলে।
ভারতের এই স্বীকৃতি ও যৌথবাহিনীর অভিযানে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের মনোবল ভেঙে পড়ে। ৭ই ডিসেম্বর ভূটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী দ্বিতীয় রাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ভারতের জনগণ , সরকার ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি। ইন্দিরা গান্ধীও জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথবাহিনীর ঘোষণা দেন। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে যৌথবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। উভয় নেতা জানিয়ে দেন বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হতে চলেছে। রণাঙ্গনে তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথবাহিনীর বিজয়ের বার্তা জানিয়ে দিলেন দেশবাসীর কাছে। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিভিন্ন দেশে দেশে গিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কি ভাবে হত্যাযজ্ঞ ও অপরাধ চালাচ্ছে ও বাংলাদেশের এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়ে যে কষ্ট ও সংকটের মধ্যে পড়েছে সর্বোপরি বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের যথার্থতা তুলে ধরেছিলেন। বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের দেশগুলো একত্রিত হয়ে বাঙালি জাতির এই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বিশ্ব জনমত গঠনে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদান অনস্বীকার্য। অন্যদিকে আমেরিকা, চীনসহ কিছু রাষ্ট্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তারা কুটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মুহূর্তেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠায়। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ঠেকানো চেষ্টা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। বাংলাদেশের বিজয় কেউই ঠেকাতে পারেনি।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয়ের পিছনে ভারতসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের অকৃত্রিম সাহায্য ও সহযোগিতা ছিল বিজয় অর্জনের অন্যতম প্রধান কারণ। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী যখন সারা দেশে হত্যাযজ্ঞ চালায় তখন থেকেই আমাদের দেশের প্রায় এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নেয়। এই নয় মাসের যুদ্ধে ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ বাংলাদেশের এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে বাসস্থান, খাদ্য, ঔষধ সহ সকল ধরনের সাহায্য করে। অন্যদিকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধাদের ট্রেনিং, অস্ত্র, চিকিৎসা ও সকল সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে । এই যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর ২৭হাজার সেনা আত্মদানের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গৌরবের অংশীদার হয়ে বাঙালি জাতিকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করে। ভারতের জনগণ, সেনাবাহিনী ও ভারত সরকার যেভাবে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করেছে, বাঙালি জাতি কখনো কি তা ভুলতে পারে? মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি বুঝতে পারে ভারত আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু। যদিও আজকে চিত্র ভিন্ন। ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্নতা ছিল আমরা দু’দেশের আদর্শ ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষ জাতি। এখন ভারত সেই অবস্থানে নেই। আর বাংলাদেশের কথা তো না ই বললাম। বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে ও এর আগেও ভারতের সাথে ক্ষমতায় ঠিকে থাকতে সে দেশের সরকারের সাথে সার্বভৌম দেশ হিসেবে দাঁড়াতে হয় সেটা আমরা পারি নাই। অন্যদিকে ভারতও বন্ধু নয়, বড় ভাইয়ের ভূমিকা পালন করে। তবে মনে রাখতে হবে সরকার আসে সরকার যায়। জনগণ অনাদি কালের। জনগনের সাথে জনগনের বন্ধুত্ব কখনও ম্লান হয না। কৃতজ্ঞতা বোধ, ভালবাসা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ পৃথিবীকে সুন্দর করে। ভালো প্রতিবেশী হওয়ার দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে।
এদিকে আমাদের দেশের একটি শ্রেণী প্রথম থেকেই খেয়ে না খেয়ে ভারত বিদ্বেষী। এরা অনেকই ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন, অথবা রাজনৈতিক কারণে বিরোধী ছিলেন। সম্প্রতি গন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটানো হয়, তাতে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সংগঠন হাসিনা সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের দিকে আঙ্গুল দিয়ে অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করে চলেছে। এদের মধ্যে অনেকেই নিজেদেরকে পান্ডিত্যের জায়গায় নিয়ে কথা বলতে শুনেছি। বদরুদ্দীন উমর ও আহমেদ ছফার বই পড়ে ওনারা তাত্ত্বিক কথা বলতে শিখেছেন। তারা কি জানেন ঐ তাত্ত্বিকরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বলে ছিলেন এটা দুই কুকুরের লড়াই। আবারও কিছু গন্ধ পাচ্ছি একাত্তরের দালালদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মুখের ভাষার। আমার সুযোগ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ ভাবে দেখার। মুক্তিযুদ্ধকে আমার আবেগ, অনুভূতি এবং হৃদয় দিয়ে সমর্থন করার। আজকের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতাদের জন্ম যদি একাত্তরের আগে হতো এবং আমার মতো বয়স হতো এবং ঐ চেতনাকে ধারণ করতেন, তবে অনেক কথা আরো সহনশীল হয়ে বলতে পারতেন।
ইতিহাস জানতে গিয়ে বিভ্রান্তিকারিদের শরনাপন্ন হওয়া ভালো না। আমি এটা বলি না যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিকৃতি হয়নি। অবশ্যি হয়েছে। নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য এগুলো করা হয়েছে। মহানায়ককে একক ভাবে দেখানো হয়েছে, তার আশেপাশের লোকজন কে না দেখার চেষ্টা হয়েছে। যিনি নায়ক হিসেবে ছিলেন না তাকে নায়কের কাতারে এসে মিথ্যা ইতিহাস তৈরির চেষ্টা হয়েছে। বাদ দেয়া হয়েছে যাঁদের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। তাদের সাহস, বুদ্ধি ও দূরদর্শিতায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ মাত্র নয় মাসে বিজয় এনে দিয়েছিলো । এদের স্থান রাষ্ট্রীয়ভাবে কার্পন্য করে তুলে ধরা হয়েছে। এককভাবে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে গিয়ে মুলত বঙ্গবন্ধুকে ছোট করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান অবশ্যই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। যার নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। তাঁকে বুকের মধ্যে ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ব করছেন। তাকে অপমান বাংলাদেশকে অপমান, তার অবমাননা মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা। হাঁ গত সরকার তাঁকে নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি করেছে এটা অত্যন্ত সত্য ।এটার জন্য দায়ী শেখ হাসিনা। আমরা জানি না শেখ হাসিনা কতটুকু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধারণ করতেন। এর চেয়ে বেশি তিনি তাঁকে ব্যবহার করেছেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য। অন্যকে ছোট করে দেখিয়েছেন। অন্যের নাম উচ্চারণ করতেও দ্বিধা বোধ করতেন। হাসিনার প্রাপ্য তিনি পাচ্ছেন ও আরও পাবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অহেতুক নিজেদের পান্ডিত্যে হাসিলের জন্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে লাভ হবে না। সময় সবার জন্যই অল্প। কার কিভাবে পরিনতি হয় ক্ষমতায় থাকলে বুঝা কঠিন। বাংলাদেশের তিপ্পান্ন বছরের ইতিহাসের দিকে থাকালে তা বোঝা কঠিন হবে না। দেয়ালে সব কিছু লেখা আছে। আপনারাও দেয়াল সমৃদ্ধ করছেন। ইতিহাসের নায়ক হতে গিয়ে যাতে খলনায়ক না হয়ে যান। একটুখানি খেয়াল রাখতে অনুরোধ।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি
জয় বাংলা।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।সিপিবি, যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সম্পাদক।