গোপন সীমানা
শামীম আহমদ তালুকদার
আমি লেখক নই, অতি সাধান একজন পাঠক। অনেকদিন ধরে ভাবছি কিছু লেখব। কিন্ত কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছিনা। কিছু লিখতে গেলেই নিজের জীবন কাহানী সামনে চলে আসে।আর এই ভাবনার মধ্যে কেটে গেছে দশটি বছর। এমন একটা জীবন যা অত্যন্ত দু:খ, কষ্ট আর বেদনায় অতিবাহিত হয়েছে। জীবনের মুল গতি ছিল সব সময় স্বপের স্বাদে যুক্তরাজ্য ভ্রমন করা। দু:খ কষ্টের ঘা খেতে খেতে দু-দুবারও গিয়েছিলাম যুক্তরাজ্যে। শুধু যুক্তরাজ্যেই না, বিশে^র কয়েকটি দেশ ভ্রমনের সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্ত স্বপ্নের কাছ থেকে ঠকবাজি আর প্রতারনা দেখতে হয়েছে। মানুষকে ভালোবাসতে যেয়ে ভালোবাসা পাইনি, ভালোবাসার বদলে পেয়েছি ঘৃনা আর প্রত্যাখান। সব কিছুতেই স্বার্থের দন্ধ লেগেই আছে। জীবনে উত্তান-পতন দু’টিই দেখেছি। মৃত্যুর মুখ থেকে কয়েকবার ফিরে এসেছি। এখন এই মধ্য বয়সে জীবনের অর্থ খোঁজে বের করার চেষ্টা করছি। যদিও জীবনে অনেক ফাঁক-ফোকর রয়েছে। এই পিচ্ছিল পথে অনেক দুর হেঁটে এসেছি। আমার পেশায়, আমার লেখায়, আমার জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতি বিরাজমান। মাঝে মাঝে অবাক হই আমি বেঁচে আছি কি করে ? অনেক আগেইতো আমাকে বিদায় নেওয়া উচিৎ ছিল। আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস এই লেখাটি আনন্দ বেদনার ইতিহাস মাত্র।
পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে পুন্যভুমি সৌদি আরব সব সময়েই একটি কাঙ্খিত গন্তব্য। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র জন্মভুমি, ইসলাম ধর্মের উৎপত্তিস্থল, পবিত্র কুরান শরিফ নাজিলসহ এরকম আরও অনেক কারনে মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে সৌদি আরব একটি প্রিয় নাম। এছাড়া পবিত্র মক্কা শরিফ, মদিনা শরিফ এবং পবিত্র হজ্ব ও উমরাহের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিতো রয়েছেই। শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, বরং অর্থনৈতিক ভাবেও সৌদি আরব অনেক প্রভাবশালী একটি দেশ। কাজের জন্য হিন্দু, খ্রিস্টান ও মুসলিমসহ নানা ধর্ম ও বর্ণের লোক পাড়ি জমায়। ভাল পরিবেশ, কর মুক্ত বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থাকার কারণে উপমহাদেশসহ এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা এবং অন্যান্য অঞ্চলের কর্মজীবী মানুষের কাছে সৌদি আরব একটি বিশাল শ্রমবাজার। সৌদি আরব একটি সমৃদ্ধ দেশ বটে। সরকারী নাম আল মামলাকাতুল আরাবিয়্যাতুস সাউদিয়া (রাজকীয় সাউদী আরব)। দেশটির আয়তন ঃ প্রায় ২২,৪৮,০০০ বর্গ কিলোমিটার বা ৮,২৯,৯৯৬ বর্গ মাইল। যার ব্যাস উত্তর থেকে দক্ষিণে ১৮৪৩ কিলোমিটার ও পূর্ব থেকে পশ্চিমে ২০৭৬ কিলোমিটার। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩১৩৩ মিটার উচ্চতায় অবস্থান । সর্বোচচ স্থান আবহা প্রদেশের আসীর অঞ্চল। দেশটির বেশিরভাগ জায়গা মরুভুমি হলেও অনেকগুলো জাঁকজমকপূর্ণ শহর রয়েছে। এসমস্ত শহরগুলো সাজাতে সৌদিরা মোটেও কার্পণ্য করেননি। স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত অনেক জায়গা ও স্থাপনা আছে সৌদি আরবে। তবে জীবিকার তাগিদে প্রবাসে পাড়ি দিতে হবে এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। এক সময় প্রবাসীর তালিকায় নাম লিখাতে হলো। ১৯৯৬ সালে একটকুু সুখ আর সোনার হরিণের আশায় মরুভূমির অজানার দেশ সৌদি আরবে পাড়ি জমাই। আরেকটা সুপ্ত বাসনা ছিল স্বপ্নের দেশ যুক্তরাজ্যে ভ্রমন করা। কারন সেখানে বসবাস করেন স্বপ্নের রাজকুমারী। এ কথা সত্য প্রবাস জীবন অভিজ্ঞতার ভান্ডার বৃদ্ধি করে। প্রবাস জীবন শিখিয়েছে জীবনযুদ্ধে কিভাবে এগিয়ে যেতে হয়। নিকট আত্মীয় ভিসার ব্যবস্থা করেন। সেইলস্ম্যান হিসাবে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতে হবে। দেশে একটি ট্রেভেলস্ এজেন্সির মাধ্যমে সকল কার্যক্রম সম্পাদন করা হলো। তার পর ওসামনী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সিলেট থেকে ডমেষ্টিক ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দও, ঢাকা। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ বিমানবন্দর। সেখানে পৌছানোর পর জানতে পারলাম আমাকে আরেকটি ডমেষ্টিক বিমানে করে আল-বাহা (আকিক) বিমানবন্দরে পৌছাতে হবে। এই ফ্লাইট জন্য আমাকে আরো ১২ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে। রিয়াদ বিমান বন্দরের মেঝেতে শুয়ে দীর্ঘ সময় পার করে দিলাম। সঙ্গে ছিলনা একটি রিয়ালও। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার দুঃখ ছুঁয়ে ঘুমও স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল। ভোর বেলা ডমেষ্টিক বিমানে উঠলাম। যথাসময়ে বিমান আকাশে উড্ডয়ন করলো। এই বিমানের যাত্রী প্রায় সবাই সৌদি আরাবিয়ান। এদিক সেদিক থাকিয়ে দেখছিলাম একমাত্র আমি পেন্ট সার্ট পড়া কর্মজীবি মানুষ। আরাবিয়ানদের পোষাক দেখে চেনার উপায় ছিলনা ধনী গরীব বা পেশাগত পরিচয়। সবাই দেখতে একই রকম। আমার ঠিক পিছনের আসন থেকে কিছুকক্ষন পর পর কে যেনো মাথায় আঘাত করছে। পিছনে থাকিয়ে দেখলাম সাত-আট বছরের এক শিশুসহ আরাবিয়ান দম্পতি রয়েছেন। শিশুটি বার বার এমন আচরন করছে অথচ মা বাবা কিছু বলেছেননা। আর আমার তো আরবি ভাষা জানা নেই। শিশুটি কিছুতেই মাথায় আঘাত করা বন্ধ করছেনা। কিছুক্ষন থেমে থেমে আগাত করেই চলেছে। একপর্যায়ে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় বলে দিতে বাধ্য হলাম। এইযে ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়, শিশুটি আমাকে বার বার আঘাত করছে অথচ আপনারা শিশুটিকে থামানোর চেষ্টা করছেন না। কে শুনে কার কথা। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে শিশুটি এমন আচরন করে চলছিল। শতাধিক আরাবিয়ানদের মধ্যে আমি যেনো এক বধির। আল-বাহা (আকিক) বিমানবন্দর পৌছালাম। ইমিগ্রেশন শেষে বিমানবন্দর থেকে বের হলাম। বাংলাদেশি এক প্রাউভেট কার চালকের সঙ্গে পরিচয় হলো। সৌদি আরবে সেই সময়ে প্রবাসীদের টেক্সিক্যাব চালানোর অনুমতি ছিলনা। প্রবাসীরা অনেকটা লুকিয়ে কৌশলে প্রাইভেট গাড়ী ভাড়া চালিয়ে থাকনে। স্বদেশী ভাই আমাকে নিয়ে আসেন গন্তব্য স্থান আল-মান্ডাক এলাকায়। বাসায় পৌছে সবার সাথে কোশল বিনিময় শেষে কিছুটা গল্প। তার পর গোসল সেড়ে রাতে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলায় কফিল (বস) বাসায় ছুটে আসেন। আমার নিকট আত্মীয় যিনি ভিসা দিয়েছেন তার সঙ্গে আরবি ভাষায় কথা বলেন। তিনি বলেন, কফিল এসেছেন আমাকে নিয়ে যেতে। তার ডালিম বাগানে এক দু’দিন ডালিম পাড়তে হবে। বসের গাড়ীতে উঠে বসলাম। আঁকাবাঁকা উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে গেরেন্তা নামক এলাকায় পৌছালাম। সেখানে স্থানীয় একটি মাদরাসার প্রহরী বাংলাদেশী এক ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করে দিলেন বস। থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। খাবার তার বাসা থেকে দেওয়া হবে। অনভূতি বেশ ভালই লাগছে। রাতের খাবার ডাল আর রুটি আরবিয়ান (তমিস) খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল বেলা গাড়ী নিয়ে বাসার সামনে বস্। প্রায় ১৫ মিনিটের মধ্যেই ডালিম বাগান পৌছালাম। গাছে পাঁকা ডালিম ফেটে আর্তনাদ করছে। বস নিজে দেখালেন কিভাবে ডালিম কিভাবে সংগ্রহ করতে হয়। পরিমানমত ডালিম দিয়ে বক্স করা। কোন অবস্থায় যেনো মাটিতে না পড়ে। মাটিতে পড়লে ডালিম ফেটে নষ্ট হয়ে যাবে ইত্যাদি। জীবনের প্রথম এত বিশাল একটি ডালিম বাগানের সঙ্গে পরিচয়। পাকা ডালিম দেখার পর খাওয়ার লোভ প্রবল জাগ্রত হয়। অন্য দিকে এই পাহাড় ঘেরা অরন্যে একা একা কাজ করতে হবে এই ভেবে ভয়েরও সঞ্চার হয়েছিল। তিনি চলে গেলেন। আমি ডালিম পাড়তে লাগলাম। ডালিম গাছের কাটা মাঝে মাঝে আমার হাতে বিধে আহত করছিল। প্রথম দিন বেশ তৃপ্তি নিয়ে ডালিম খেতে পারলেও পরবর্তীতে আর খাওয়া হয়নি। এভাবে এক সপ্তাহ ডালিম বাগানে কাজ করলাম। তার পর দুই শতাধিক ভেড়ার পালের সঙ্গে পরিচয় করে দিলেন বস। মরুভূমির রোদের উত্তাপ উঁচ নিচু পাহাড় বেয়ে ভেড়ার পাল ছড়াতে লাগলাম। প্রথম দিন ১২০ টি ভেড়ার পাল নিয়ে বের হলাম। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরা হলো। ভেড়াগুলো গুনে দুটি ভেড়া কম পাওয়া যায়। আরবি ভাষায় উচু কন্ঠে যেন যেনো বস কিচু বলে দিলেন। এর কিছুই বুঝতে পারিনি।এর পর দিন আমাকে ভেড়া ছড়াতে না দিয়ে গম কাটতে নিয়ে গেলেন। চারদিকে উঁচু নিচু পাহাড় আর মধ্যখানে সমতল বিশাল গম ক্ষেত। ২ মাস কাটলেও গম কাটা শেষ হবেনা। আহ! স্বাদের প্রবাস। প্রচন্ড রোদ, চারদিকে শোনশান নিরবতা। আমাকে গম কাটতে দিয়ে বস চলে গেলেন। সঙ্গে নেওয়া পানির বোতল যেন কেউ আগুনের তাপে গরম করে দিয়েছে। ছাঁয়ার সন্ধান করছি। কিন্ত বৃক্ষ আছে, ঢাল-পালা আছে। লতা পাতা নেই। বাসায় ফিরে যাবো পথ চেনারও উপায়ন্তর নেই। আঁকা বাকা উঁচু নিচু পাহাড় বেয়ে কতদুর নামিয়ে দিলেন দিশেহারা। বিকেলে বস এসে দেখেন ৩ মুষ্টি গম কাটা হয়েছে।
আবারো উচু সুরে কি যেনো বলে দিলেন। বাসায় ফেরার পর রাতে প্রচন্ড হাড় কাপানো জর।মাদরাসার প্রহরী বাংলাদেশি ভাই যতেষ্ট সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। ভোর হতেই বাংলাদেশি ভাইকে বিনয়ের সাথে বলি আমাকে মান্ডাক যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। কিন্ত সড়ক পথে গেলে বস যদি দেখেন তাহেল যেতে দিবেন না। আমাকে ফাঁড়ি পথে একটা ম্যাপ অংকন করে দিন। ওই ম্যাপ দেখে যেনো আমি মান্ডাক প্রধান সড়কে পৌছাতে পারি। ঠিক তিনি আমাকে ম্যাপ অংকন করে দিলেন। আমি পথ চলতে লাগলাম। কোথাও সাদা পোষাক দেখলেই ভয়ে আতকে ওঠি। এই মনে হয় বস আমার খোঁজে আসছেন। প্রায় ৪ ঘন্টা হাঁটার পর মান্ডাক প্রধান সড়কে গিয়ে উঠলাম। অনেক্ষন মাটিতে বসে ছিলাম। আবার অজানা ভয়ও কাজ করছিল। এটাই গেরেন্তা এলাকায় প্রবেশ দ্বার। কিছুক্ষন পর আমার পাশে এসে একটি কার থামলো। প্রশ্ন করলেন, কাহা যাওগে ? আমি জবাব দিলাম মান্ডাক। চলো ফির অ্যাপকো ছুড়দেতাহো। তিনি আমাকে মান্ডাক নিয়ে গেলেন। কিন্ত যে বাসায় উঠেছিলাম সে বাসার কোন নাম্বার না থাকায় বাসা খোঁজে পেতে অনেকটা বেগ পেতে হলো। বাসায় পৌছানোর পর মনে হয়েছিল বাঘের থাবা থেকে ফিরে পেলাম নতুন জীবন।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী