দ্বিশত জন্মবর্ষে অবহেলিত হরিশচন্দ্র মুখার্জী

দিলীপ মজুমদার

দ্বিশত জন্মবর্ষে এক হতভাগ্য বাঙালির কথা স্মরণে আসে ।তিনি হরিশচন্দ্র মুখার্জী।বিখ্যাত‘হিন্দু পেট্রিয়ট’পত্রিকার সম্পাদক।উনিশ শতকের এই রাজনৈতিক চিন্তানায়ক ১৮৫৬ থেকে ১৮৬০ –এই স্বল্প সময়সীমার মধ্যে সমকালীন প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক , সামাজিক সমস্যা নিয়ে ব্যক্ত করেছেন তাঁর মতামত;চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত , সিপাহি বিদ্রোহ , ব্ল্যাক অ্যাক্ট আন্দোলন , রায়তদের সমস্যা , চাকুরির ক্ষেত্রে বিভাজননীতি ইত্যাদি নিয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ ; সর্বাত্মক শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করেছেন নীলকরদের এবং সাহায্য করেছেন তাঁদের দ্বারা অত্যাচারিত রায়তদের।অথচ এই রকম একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধাকে অচিরেই বিস্মৃত হয়েছেন তাঁর দেশবাসী ; তাঁর প্রতি অবিচার করেছেন তাঁর বন্ধুবর্গও।এই বিস্মৃতি,এই অবিচার নিছক ভ্রান্তি বলে মনে হয় না । বংশকৌলীন্য , কাঞ্চনকৌলীন্য ও শিক্ষাগত কৌলীন্য না থাকার কারণেই বোধহয় হরিশচন্দ্রের প্রতি সমকালীন বুদ্ধিজীবীদের এই অবহেলা ; যার রেশ অদ্যাবধি বিদ্যমান ।১৮৬১ সালের ১৪ জুন মৃত্যুবরণ করেন হরিশচন্দ্র । অকালে , কেননা তাঁর বয়স তখন ৩৭ মাত্র । কেউ কেউ তাঁর মৃত্যুর জন্য মদ্যপানকে দায়ী করেছেন ।বেঠিক নয় ।কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর মানসিক অশান্তি আর উদ্বেগের কথাও বলতে হয় ।বিশেষ যখন প্রতিশোধগ্রহণে উন্মত্ত আর্চিবল্ড হিলসের মামলা খাঁড়ার মতো ঝুলছিল হরিশের মাথার উপরে ।১৮৬১ সালের ১২ জুলাই ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সভাগৃহে এক স্মরণসভার আয়োজন করা হয় ।এই সভায় হরিশের ‘স্মরণার্থ চিহ্ন স্থাপন করা’ সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় ।কালীকৃষ্ণ দেব বাহাদুর , সত্যচরণ ঘোষাল , রমাপ্রসাদ রায় , প্যারীচাঁদ মিত্র , কিশোরীচাঁদ মিত্র, দিগম্বর মিত্র , জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতিদের নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যদের মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে আন্তরিক ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ । তিনি হরিশের স্মৃতি রক্ষা তহবিলে অনতিবিলম্বে ৫ হাজার টাকা দান করেন এবং ‘হিন্দু পেট্রিয়ট সম্পাদক মৃত হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের স্মরণার্থ কোন বিশেষ চিহ্ন স্থাপন জন্য বঙ্গবাসীদিগের প্রতি নিবেদন’ নামক এক অসাধারণ পুস্তিকা রচনা করেন । যুক্তি ও আবেগের মেলবন্ধনে এই আবেদনপত্র ব্যতিক্রমী নিঃসন্দেহে ।

শুধু তাই নয় , ১৮৬১ সালের ৯ নভেম্বর কালীপ্রসন্ন কার্যনির্বাহক সমিতিকে জানান যে হরিশের স্মৃতিমন্দির স্থাপনের জন্য তিনি তাঁর সুকিয়া বাগান অঞ্চলের ২ বিঘা জমি দান করতে ইচ্ছুক ; সেই স্মৃতিমন্দিরে গ্রন্থাগার স্থাপন ও সময়ে সময়ে বক্তৃতার প্রস্তাবও কালীপ্রসন্ন দিয়েছিলেন ।কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে হরিশের স্মৃতিমন্দির স্থাপনের কাজ বিলম্বিত হতেই থাকে । শেষে হরিশচন্দ্র ফাণ্ডের ১০,৫০০ টাকা ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান সভার গৃহনির্মাণে ব্যয় হয় । এর কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে রামগোপাল সান্যাল বলেছেন , ‘ The truth of the matter is that some of the influential members of the Association , who had contributed handsomely to the fund , contrived in collusion with BabuKristo Das Pal , to appropriate the entire fund to the erection of the building of the Association.’
১৮৬১ সালের ৩ অক্টোবর ‘হিন্দু পেট্রিয়টে’ প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে হরিশ মুখার্জীর জীবনী রচনা করবেন শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় । কিন্তু কেন শেষ পর্যন্ত সে জীবনী রচিত ও প্রকাশিত হল না , তার কারণ অজ্ঞাত । ১৮৬৩ সালে হরিশের প্রথম জীবনী গ্রন্থ যিনি রচনা করেন , তিনি বাঙালি নন , মুম্বাইএর এলফিনস্টোন কলেজের পার্শি অধ্যাপক ফ্রামজি বোমানজি । তাঁর বইএর নাম : ‘ Lights and Shades of the East or a Study of the Life of BabooHurishChunderMookerjee and Passing Thoughts of India and its People , their Present and Future.’ পরবর্তীকালে দেশে ও বিদেশে এই বইএর নানা সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে , যা প্রমাণ করে বাংলার বাইরে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ ও হরিশ মুখার্জী সম্বন্ধে ইতিহাসমনস্ক মানুষের কৌতূহল আছে । বাংলা ভাষায় হরিশ জীবনীর প্রথম প্রকাশ ১৮৮৭ সালে । লেখক রামগোপাল সান্যাল । ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত হয় রামগোপাল সান্যালের ‘A General Biography of Bengal Celebrities—both Living and Dead .’ এই বইতে হরিশ মুখার্জীসহ আট জন খ্যাতনামা ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত জীবনী আছে । ফ্রামজি বোমানজি বা রামগোপাল সান্যাল , এঁরা কেউই হরিশচন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্ত তুলে ধরতে পারেন নি , পারা সম্ভবও ছিল না । হরিশের জীবনসম্পর্কিত তথ্য –চিঠিপত্র , দলিলদস্তাবেজ , তাঁর অন্তরঙ্গদের স্মৃতিচারণা – কোন কিছুই পাওয়া যায় না । প্যারীচাঁদ মিত্র , শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় , জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতিরা কেন হরিশের জীবনী রচনা করলেন না , কিংবা তাঁর জীবনসম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে রাখলেন না , সে এক অপার রহস্য ।১৯১০ সালে ধর্মতলা স্ট্রিটের দ্য চেরি প্রেস থেকে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় : ‘Selections from the Writings of HurrishChunderMookerjee.’ এই সংকলনগ্রন্থের ভূমিকায় নরেশচন্দ্র বলেছেন যে ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকার দুটি খণ্ড থেকে রাজা প্যারীমোহন মুখার্জীর সহায়তায় হরিশের রচনা সংকলিত হয়েছে । উক্ত পত্রিকায় লেখকদের নাম থাকত না এবং পত্রিকায় রামগোপাল ঘোষ , কিশোরীচাঁদ মিত্র , রাজেন্দ্রলাল মিত্র ,গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখরা লিখতেন ; রচনারীতির বিচার করে হরিশের রচনা সনাক্ত করা হয়েছে ।

হরিশচন্দ্রের জীবনী রচনা যে দুরূহ সে কথা বলতে গিয়ে আক্ষেপ করে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছেন যে হরিশের বাল্য ও কর্মজীবনের যথাযথ তথ্য পাওয়া যায় না , তাঁর কোন ছবি পাওয়া যায় না , সন্ধান পাওয়া যায় না তাঁর বাসগৃহের । উত্তরসূরীরা ভবানীপুরে তাঁর নামে একটি রাস্তা ও একটি পার্ক তৈরি করে তাঁদের কর্তব্য সমাধা করেছেন ।ভবানীপুরের হরিশ পার্কে একটি স্মৃতিস্তম্ভ আছে , কিন্তু কোন প্রতিকৃতি নেই । অথচ হরিশের সমকালীন মানুষদের সকলেরই ছবি পাওয়া যায়। এই প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি । গত শতকের আশির দশকে হরিশচন্দ্র মুখার্জী সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে একদিন আমি দেখতে পাই হরিশ পার্কের বিপরীত দিকে একটি সাদারঙের দোতলা বাড়ির দেওয়ালের একটি ট্যাবলেট , যাতে লেখা ছিল : ‘এই রকম স্থানে হরিশ মুখার্জী বসবাস করিতেন ’ । তখন আমি তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী , পৌরমন্ত্রী , তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে ওই বাড়িটি অধিগ্রহণ করতে অনুরোধ করি । কিন্তু আমার মতো রামা কৈবর্তের আবেদন বাজে কাগজের ঝুড়িতে পড়ে । কিছুদিন বাদে সেই রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে দেখি দোতলা বাড়িটি ভেঙে ফেলে বহুতল নির্মিত হয়েছে । কৈফিয়ৎ হিসেবে সরকারের তরফ থেকে বলা হয় যে হেরিটেজ কমিটি জানিয়েছেন উক্ত স্থানে হরিশ মুখার্জী বাস করতেন না । এ নিয়ে বিধানসভায় বিতর্কও হয়েছিল ।এবার হরিশ মুখার্জীর ছবির কথা । বর্তমান শতকের প্রথম দিকে কোন এক নামকরা পত্রিকায় হরিশ মুখার্জী সম্বন্ধে আমার একটি অকিঞ্চিৎকর নিবন্ধ প্রকাশিত হয় । পত্রিকাটি হাতে নিয়ে অবাক বিস্ময়ে আমি দেখি যে আমার সেই লেখার উপরে হরিশ মুখার্জীর একটি ছবি দেওয়া হয়েছে। হরিশের ছবির জন্য আমি বহু বই ও পত্রিকা ঘেঁটেছি । ছবি পাই নি । এঁরা পেলেন কোথা থেকে ? পত্রিকা কর্তৃপক্ষ জানালেন গুগুল সার্চ করে তাঁরা হরিশের ছবি পেয়েছেন । গুগুল সার্চ করে আমিও দেখলাম সে ছবি ।কিন্তু ছবি কোথা থেকে পাওয়া গেল তার কোন সূত্র নির্দেশ নেই ।তাহলে ছবিটি কি জাল ? দুর্ভাগা হরিশ মুখার্জীকে কি জাল ছবির আস্তরণেই চাপা পড়ে থাকতে হবে ? অপর্যাপ্ত তথ্যের সাহায্যে এ দেশের রাজনৈতিক সাংবাদিকতার অগ্রদূতের খণ্ডিত জীবনীটুকুই সম্বল হবে আমাদের ?

You might also like