ঘুষ সংস্কৃতিঃ মানুষ সুনীতি-দুর্নীতি সততা-অসততার পার্থক্যও ভুলে গেছে

  রুহুল কুদ্দুস বাবুল

এদেশে সরকারি সেবা খাতে ঘুষ লেনদেনের সংস্কৃতি নতুন কিছু নয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, ঘুষ লেনদেনের পরিধি আর ঘুষের পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল বিষয় ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা এবং মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পরেও তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারিরা শুধু ঘুষ খেতো, তা নয় সুযোগ বুঝে লুটতরাজও করতো। ঔপনিবেশিক আমলে ঘুষখোরের শাস্তি হতো বলে কোন নজির নেই, তার মানে সেটা তখন প্রথাসিদ্ধই ছিল বলা চলে। তারও আগে মুসলিম শাসন আমলেও চালু ছিল। যেমন জমিদারি, তালুকদারি, সেরেস্তা, খাসমহল ইত্যাদি স্থানে চালু ছিল। তবে ঘুষ বলা হতো না, ব্যবহৃত হতো একটি আরবি শব্দ ‘আবওয়াব’। তহুরি, নজরসেলামি, বারবরদারি প্রভৃতিও বলা হতো। যেহেতু শব্দগুলো আরবি ভাষা থেকে আগত, সাধারণ মানুষের বোধগম্য ছিলনা। তাই এসব শব্দ ব্যবহারে তৎকালিন দূর্নীতিবাজ সমাজচালকদের জন্য সুবিধাই ছিল। অতএব ওগুলো প্রথাসিদ্ধ ব্যবস্থা হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। দূর্নীতি কালক্রমে হয়ে যায় নীতি।
স্বাধীনতার পর আজ অবধি সেই নীতিটা তস্করদের স্বার্থেই চালু আছে। শেখ সাদীর ভাষায় ‘আদব শিখেছি, বেয়াদবের কাছে’। ব্রিটিশের চালু করা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করেও কিছু লোক তো বিবেকবান, নীতিজ্ঞান সম্পন্ন হয়েছেন, তা অনস্বীকার্য। তাদের সাগরেদও নেহায়েত কম নয়। তাই চাপ দেয়ার যন্ত্র জনগণও খানিকটা সচেতন হয়েছে। ঠেলায় পড়ে অল্প বিস্তর আইন-কানুন হয়েছে বটে, তবে আইন যাতে দৌড়ুতে না পারে সেজন্যে পথে কিছু কাঁটাও ছিটিয়ে দেয়া হয়,মাঝে-মধ্যে।
এমন একটি কাণ্ড হয়েছে দূর্নীতি দমন ব্যুরো, সর্বশেষ দূর্নীতি দমন কমিশন সংক্ষেপে দূদক-এ। বলা হয়, এ সংস্থাটি স্বাধীন অর্থাৎ স্বাধীনভাবে দূর্নীতিবাজদের ধরতে পারবে, অভিযুক্ত করে আদালতে পাঠাতে পারবে। ধরেছে, আদালতেও পাঠিয়েছে, কিঞ্চিত বাহবাও কুড়িয়েছে। কিছু রাজনৈতিক তস্করকে দূদক পাকড়াও করতে সক্ষমও হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দূদক ফাঁদ পেতে কিছু সরকারি কর্মকর্তাকে হাতেনাতে ঘুষ গ্রহণকালে ধরেছে। এভাবে ধরার নিয়ম দূদক আইনেও বলা আছে। এখানেই বিধি বাম। আইনের ধারায় সংশোধন চলে আসলো-‘প্রজাতন্ত্রের কোন কর্মকর্তা, কর্মচারিকে তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া গ্রেফতার করা যাবে না’।
রাজনৈতিক সরকার আমলাতন্ত্রকে ভয় পায়, নাকি নিজেদের আকাম-কুকামে সহায়তা করার জন্য ‘আবওয়াব’ ছাড় পেল!  ‘যে যেভাবে পারো মারো’ এ নীতিতে আত্মসমর্পন বলা চলে। অথবা ঘুষের গণতন্ত্রায়ন হয়েছে, তাও বলা যায়।
সরকারি সেবা খাতে ঘুষ লেনদেনের সংস্কৃতি নতুন নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, শিক্ষা, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিচারিক সেবা ও স্বাস্থ্য। প্রকৃতপক্ষে সরকারি সেবা খাত সামগ্রিকভাবেই অতিমাত্রায় অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার, যা সুশাসনের দীন দশা তুলে ধরে। কিন্তু আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ঘুষের পরিমাণ শুধু নয় এর ব্যাপকতা ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপ প্রতিবেদনে এসব স্পষ্ট হচ্ছে। তারা বলছে ভুমি অফিস, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর, উন্নয়ন কাজের প্রতিষ্ঠান সর্বত্র ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ সমাধা করা যায় না।
ঘুষ সংস্কৃতির কালো থাবায় সাধারণ মানুষ অসহায়। একটি অপরাধমূলক মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন বা মামলার ফলাফল অনেকটা নির্ভর করে এর উপর। ঘুষ দিনকে রাত করে দেয়। ভুক্তভোগী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। ভোগান্তি আর হয়রানির কষ্ট সীমা লঙ্ঘন করে। ভুমি অফিসের দুর্নীতি লাখ লাখ মানুষকে তার ন্যায্য হক থেকে বঞ্চিত করে। বিচার বিলম্বিত হয়, এক জীবনে মানুষ ন্যায়বিচারের মুখ দেখেনা।
রাজনৈতিক দলেও ঘুষের নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে। দলের পদ-পদবী, নির্বাচন মনোনয়নেও ঘুষ চলে। গ্রাম্য সালিশ বিচারকরাও ঘুষ নেয়। কতিপয় রাজনৈতিক টাউট, সাংবাদিক নামধারী হলুদ চোখের কিছুসংখ্যক টাউট ঘুষের দালাল বা তদবীরবাজ! গোটা সমাজটায় যেন পঁচন ধরেছে! ঘুষ-দুর্নীতির কালোটাকায় সমাজ কলুষিত।
সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনের আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট চায়। এখন ভোটের আগে প্রতিশ্রিতিরও প্রয়োজন নেই। ফাঁকা মাঠে এসবের দরকারও পড়েনা।
দুর্নীতির গণতন্ত্রায়নে সমাজ থেকে অপরাধবোধও অন্তর্হিত হয়ে গেছে। মানুষ সুনীতি-দুর্নীতি এবং সততা-অসততার পার্থক্যও ভুলে গেছে মনে হয়। দেশ ও সমাজের কল্যাণ মাথায় নেই। প্রত্যেকে প্রত্যেকের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থের জন্য হণ্যে হয়ে উঠেছে। এ ভয়াবহ অবস্থা চলমান রাখতে একটি স্বার্থান্বেষী লুটেরা গোষ্ঠী সদাতৎপর। তারা সুকৌশলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধগুলো আড়াল করে রাখছে। যার ফলে ঘটছে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার অধঃপতন। সাধারণ অপরাধ বৃদ্ধির পিছনে কাজ করছে সর্বনাশা নীতিহীনতা।
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ছাড়া মুক্তির পথ নেই।

লেখকঃ-রুহুল কুদ্দুস বাবুল
রাজনীতিবিদ ও কলাম লেখক
১০.০৩.২০২৪
Email: babuq.syl@gmail.com

You might also like