পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে।-সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥আঠারো॥
সিনেমায় অভিনয় শুরু করার খবর পত্রপত্রিকায় গেল। স্কিপ্ট নিয়ে কন্ট্রাক্ট সাইন করার দৃশ্য আপলোড করা হল ইউটুবে, ছবি ছাপলো পত্রিকা। দিন পেরুতে না পেরুতেই সাংবাদিকদের ভীড়। প্রথমে নাইমুরের মডেলিং ফার্মে সাংবাদিক দু’একজনের মুখোমুখি। পরে সেখানের ভীড় সামলাতে না-পেরে দিলাম বাসার ঠিকানা। এতেও সংকট দেখা দিল। আমার পাশের ফ্লাটে থাকেন সুরাইয়া খালাম্মা। তিনি নাইমুরের সাথে ঘনিষ্ট মানুষ। এই খালা-ই আমাকে ফ্লাটটির খোঁজ দেন। তিনি টিভি নাটকে অভিনয় ছাড়াও পরিচালকের কাজ করেন। আমাকে অভিনয়ে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন। এ জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এই ফাঁকে সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগটা এলো।
আমার কস্টিউম যিনি নিয়োগ পেলেন, তিনি অবাক হলেন আমার সহযোগিতা পেয়ে। তাকে বুঝতে দিইনি, আমি যে সাজগোজ সম্পর্কে ধারণা রাখি। বিউটিশিয়ান ছিলাম, বা বিউটি পার্লারে কাজ শিখে রীতিমত পাকনা সেটা গোপনই রাখি। কিভাবে একজন সাদামাটা লোক বা মেয়েকে চরিত্র অনুযায়ী সাজিয়ে ফুটিয়ে তোলা যায়, সে দীক্ষা আমার না থাকলেও নিজের ভাঁজটা খুলতে যা যা লাগে সেটা আমার রপ্ত করা আছে, এমনই পরিবেশ তৈরিতে আমার আসন যোগ্য হয়ে ওঠে।
এরি মধ্যে অফার পেলাম দুবাই আর্ন্তজাতিক এ ফেস্টিবালেপারফর্মিংয়ে। সেখানে নাচ, নানা ইভেন্টে উপস্থাপনা—এমনকিবিষয়ভিত্তিক মডেলিংও। এক সপ্তাহ থাকলাম বুর্জ খলিফা হোটেলের প্রেসিডেন্ট স্যুটে। এতেদিন শুধু নাম শুনেছিলাম হোটেলটির। এখনস্বয়ং নিজে সে হোটেলের বর্ডার। কী অদ্ভুত দৃশ্যে শোভিত হোটেলটি।সমুদ্রকে দেখা আমার কতবার হয়েছে কক্সবাজার, কুয়োকাটাসহআরো কত স্থানে। কিন্তু এখানে মনে হল সমুদ্র তো সমুদ্র নয়, এ যেনএক টুকরো স্বর্গ। কী যে অপূর্ব ঢেউখেলানো নগ্ন জলরাশিরজলকেলি। বুকের কাছে যেন বাজছে সেই ছলছল শব্দ। দিনে সুর্যেরআলোয় এক ধরণের ঝিলমিল, রাতে চন্দ্রালোকিত দৃশ্য অন্য রকম।আরেক চেহারা। ঝিঁকিমিকি। সমুদ্র রাতে মিটমিট করে হাসে।সহস্রতারা যেন নেমে আসে জলে, পরীদের ভিড়। সমুদ্রের রূপ এমনইঅপরূপ। বিশ্বে বোধ হয় দ্বিতীয়টি এমন নেই, অত্যাশ্বর্যই বটে। যারাআমার সাথে গেলেন, তারা আমাকে সম্মান দিয়ে সেখানে রাখলেন।এই প্রথম মনে হল, স্বর্গ কি অন্য কিছু? থকথকে, ধবধবে, নিটোলশহর দুবাই। প্রাণহীন মরুর বুকে মানুষ প্রাণ নিয়ে এসেছে। আকাশছোঁয়া ভবনগুলো আকাশে উড়ছে, না উড়ছে না—নৃত্য করছে। কেজানে কী এক মোহনীয়তায় ভবনগুলো প্রাণময়। যদিও কনক্রিটেরভবন, মনে হয় জীবন্ত কেউ, কোন প্রাণী। ভবনকেও যে প্রাণ দেয়া যায়, দুবাইর ভবনগুলো না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না। ভবনগুলোছুঁয়ে ছুঁয়ে বিমান নামে। দেখা যায় সমুদ্রে নামছে, না সমুদ্রেনয়,রানওয়েতেই। কোন নগর পরিকল্পনা যে শিল্প হয়ে ওঠে, দুবাই এরসাক্ষী।
এক সপ্তাহ কাটলো মহা ব্যস্ততায়। এখানের মানুষগুলো আরেকধরণের। বুঝা যায়, অন্য কোন গ্রহ থেকে নেমে আসা প্রাণী এরা।চালচলন,পোশাক–আশাক ভিন্ন। প্রবল সমীহ করে চলে একেঅন্যকে। ভিড়বাট্টা করে না কেউ, না পথে চলতে, না শপিংমলে।
আমার অনুষ্ঠানে তো মানুষদের দেখলাম মেশিনের মত। মেশিনমানে, নির্দেশিত সিটে বসা, নির্দিষ্ট সময়ে হলে ঢোকা, অসম্ভব শৃঙ্খলাবজায় রাখা, সেকি মানুষে পারে! ঢাকায় বহু অনুষ্ঠানে তো দেখেছি, টিকেট নিয়ে কিংবা আসন নিয়ে মানুষ কী যে হই–হল্লা করে। পানেরপিক রাস্তায় থু করে ছুঁড়ে মারে, দেয়ালে আঙুলের চুন ঘষিয়েছাড়ায়,খাতকুত করে মুখ দিয়ে, যেন গলায় বিঁধে আছে কোন কাঁটা।অভিনব দৃশ্য। এরকম আমার দেখা দৃশ্য আর অভ্যস্ত জীবন দুবাইএসে পালটে গেল। মানুষের পৃথিবী থেকে কোথায় এলাম, কীদেখলাম, কী পেলাম—এসব কাকে বোঝাই। ঢাকায় গিয়ে গল্প করলেআমাকে অনেকে পাগল টাউরাবে। নানা সুলেমান গাজী তো ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকাবে আমার মুখের দিকে।শেষ পর্যন্ত আমাকে ডাক্তার দেখাতে ভাববে কি না কে জানে।
দিনে বাইরে বেরুলে আগুনলাগা গরম। তবে সে গরম আমাকে ছুঁতেপারেনি, আমি কেন, সাধারণত মানুষ গাড়ি নিয়ে বাইরে চলাচলকরে। সকলেই এসি গাড়ি নিয়ে বেরোয়। কিন্তু কথায় বলে না—‘বাত্তির তল আন্দাইর’। সে রকমও আছে।যারা খোলা জায়গায় কাজকরে, তারা সুর্যের তেজে জ্বলে আঙরা। চোখ রাখা যায় না এসবদৃশ্যে। দর দর করে কাঁপে বুক। আমি বাইরে বেরুলে এসব দৃশ্য যখনদেখি, চোখ বুঁজে ফেলি। কত দিন এরকম করতে হয়েছে।এছাড়াঅবাক হওয়ার কিছু নেই—রোদে পুড়ে কাজকরা লোকগুলোবেশিরভাগ বাংলাদেশ,ভারতসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী মানুষ। দেশেরেখে এসেছে পরিবার–পরিজন। যাদের মুখে দুমুটো অন্ন জোগাতে এইরোদের তেজকে গায়ে মাখছে না। এদের ঘামেই গড়া মরুর দেশ। আমাদের দেশের মানুষও পাথরে ফুল ফোটাতে জানে এবং পারে।বিদেশে এসে ফুল ফোটাচ্ছে মরুদ্যানে। সবুজছায়ার মনোরম পরিবেশমানুষের তৈরি। কৃত্রিম হলেও আনন্দময়। ফুরফুরে আমেজেভরা।
আনন্দ আর বেদনার দুবাই সফর আমাকে অন্য এক পৃথিবীর বার্তাদেয়। চোখ বুজে বুঝতে চেষ্টা করি আমাদের দেশকে। মরুভূমি দেখারপ্রবল ইচ্ছা এক সময় প্রবল ছিল। মরুভূমিতে কি আবার মানুষ বাঁচে? বাঁচে। মাইলের পর মাইল সবুজ বনায়নও মরুভূমিতেও সম্ভব হয়েছে। খেঁজুর গাছের সারি দিগন্ত বিস্তারি।তবে আমাদের দেশ কীঅপরূপ সবুজ। প্রকৃতির দান। দেশে থাকতে সবুজ কি জিনিস সেটাবুঝা আসলেই কঠিন। দুবাইয়ে এসে বুঝলাম,সবুজ কাকে বলে। মরুভূমির আশ্চর্য রূপান্তর! তবে জলহাওয়ার মিষ্টি সবুজ দেশবাংলাদেশ, আসলে এদেশটি কোথাও খুঁজে পাবার নয়।
এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরলাম। দেশে এসে দেখি, বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় আমার দুবাই সফর নিয়ে মিঠে কড়া নানা মুখরোচক রির্পোটিং। বেশ ইন্টারেস্টিং, মজা পেলাম। আবারমন খারাপকরা কিছু অপরিপক্ক লেখাও চোখ এড়ায়নি। সিনেমাজগতটাই এমনি,এটা আমার বুঝে আছে। আজে-বাজে কোনকিছু গায়ে না-মেখে উড়িয়ে দেয়াই একমাত্র কাজ। অথবা কোন সময়নেগেচিভ প্রচারও পজেটিভ হয়ে ওঠে, এটাও কম নয়। (চলবে)