পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করছে ‘সত্যবাণী’। আমাদের ভরসা পাঠকদের ভাল লাগবে।-সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥উনিশ॥
আমি সিনেমা জগতে প্রবেশ করে বড়দের স্নেহসিক্ত আর সমসাময়িকদের প্রিয়ভাজন হতে সময় লাগেনি। বিদ্যুতের গতিতে ঘটতে থাকে আমার বিচরণ। এ জগতে এসে ছোটবেলার কথা মনের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গাছে গাছে ডাঙগুলি খেলা, নদী সাঁতরে এপার ওপার হওয়া গোল্লাছুট, সেকি উত্তেজনার দিন ছিল। সিনেমা জগতে প্রবেশ করেই বোধ শক্তিতে সেই উত্তেজনা বেড়ে যায়।
লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে এ জগতের শিল্পী কলাকুশলীদের সাথে আমার বন্ধুত্ব ও আন্তরিক সম্পর্ক। এক ধরনের অদম্য পিপাসা আমাকে স্রোতস্বিনী করে তুলে।
ঈদ এলো। কুরবানির ঈদ। খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম, এখানের অসংখ্য কর্মী আছে যারা মাসেও একদিন মাংশ খেতে পায় না। নিত এনে নিত খাওয়া এই মানুষরা আমাকে যেভাবে ভালবাসে, আমি তার প্রতিদান কী দেবো? স্থির করলাম, গরু কুরবানি দেবো। অন্তত, তারা যেন দুচারদিন পেট পুরো খেতে পারে মাংশ। যেই কথা তেমনি সিদ্ধান্ত। নানাও খুশি হলেন প্রস্তাবে। সাতটি গরু কেনার ব্যবস্থা হল। ছোটখাটো গরু নয়, বড় সাইজের গরু। যাতে প্রচুর মাংশ পাওয়া যায়। জেনে নিলাম, এর আগে কেউ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মচারিদের জন্য বিশেষ কোন কুরবানি দেয় কিনা বা দিয়েছে কি।
আসলে কেউ এরকমটি করেনি। পছন্দ মত কেউ কেউ মাংশ পেয়ে থাকে বা আনতে বলে বাড়ি থেকে। কেউ পায়, কেউ গিয়ে আনে–এই দশা।
আমি যেই কুরবানি দিলাম প্রথম বছরেই সাতটা, সে কি আনন্দ। ক’দিন পরে আবার টের পেলাম,কেউ কেউ আমার উদরতার বাড়তি সমালোচনা করছেন। কানে আসতে সময় লাগেনি। আমি শুনে এসবের কোন পাত্তাই দিলাম না।
মনে হল, এ জগতেও শত্রু আছে। প্রথম দিকে মনে হয়েছিল এ শিল্পময় জায়গাটি পূতপবিত্র। আমি এরপর থেকে সর্তক হয়ে চলাফেরা শুরু করি। আমাকে দেখলে অনেকে মেকী আচরণ করতো, সেটা বুঝে ফেলি। তাদের মুখ ভার, চোখে পড়তো। ওরা মনে করতে লাগলো বাচ্চা মেয়ে একটি এসে তছনছ করে দিচ্ছে এ অঙ্গনটি। কেউ কেউ আমার নাড়িভুড়ি খোঁজ করতে নেমে গেল।
আমি ভেরিফাইড দু’টি ফেইসবুক খুলি। একটিতে আমার ব্যক্তিগত পোস্ট দিই। আরেকটিতে দিই আমার কাজের নানা প্রেক্ষিত, নোট ও অগ্রগতি বিষয়ক পোস্ট।
আমার অতীত জীবনের বিধ্বস্ত গহব্বরকে দেখতে পাই একটা অগ্নিবলয়। যে আগুনে পুড়ে এখন আমি কাঞ্চা সোনা। অতীত সংগ্রাম আমাকে নিয়ে এসেছে আজকের জায়গায়। দেখতে পাই ছিন্নমূল, ছিন্নভিন্ন আমি কী ছিলাম, আর কী হয়েছি।
এই ভাবনা, অতীতের অভিজ্ঞতা অবিরাম আমার পিছনে তোলপাড় করে। গত দু’বছর আমার জন্মদিন পালন করেছি নানাকে নিয়ে। এর ভেতর আমার নানী আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন। হুট করে নানীর মরা। হার্টএ্যাটাক। যতটুকু এগিয়েছিলাম, সবটুকুর সঙ্গী হাড় ঝিরঝির নানী। হাড় ঝিরঝির হলেও স্বাস্থ্য ভাল ছিল। ভাল স্বাস্থ্য থাকা স্বত্ত্বেও নেমে এলো আমার জীবনে অন্ধকার এক তুফান। নানী এই তুফানে আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। কান্নাকাটি ও চোখের জলে বুক ভাসিয়ে স্তদ্ধ আমি। মনে হল, আমি কী আর বাঁচি?
নানীর অবর্তমান, নানীহীন দু:খ ঘোচাতে খুঁজে বেড়াই একটি ঝলমল আশ্রয়। এতোদিন জন্মদিনটা পালন শুরু করি দুটো দফায়। একটি ঘরে নানা-নানীকে নিয়ে। সুরাইয়া খালা থাকতেন সহআয়োজক। নানীর অবর্তমানে কেন জানি মনে হল একটি শান্তিময় জায়গার সন্ধান করি। সহসাই পেয়ে বসে মীরপুরের এতিমখানার কথা।বাচ্চারা মায়াদয়াবিহীন একটি কৃত্রিম পরিবেশে হৈ-হুল্লোড় করে কাটায়। একটি সিনেমার লোকেশন ছিল আমার অভিনয়ের ক্ষেত্র ছিল এই এতিমখানা। তখনই আমার ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়।
মীরপুরের এতিমখানায় জন্মদিনটা চমৎকার কাটে। তাদের নিয়ে কেক কাটি। নিজ হাত দিয়ে বাচ্চাদের কেক খাইয়ে দিই। তাদের নিয়ে সকাল থেকে বেলুন দিয়ে ডাইনিংটা সাজাই। সুঁতোয় লাগিয়ে কাগজের ফুলের বাহারী সম্ভার। বাচ্চারা এমন হৈ-চৈ করলো, মনে হল–এটা তাদেরই কারো জন্মদিন। অথবা আমি তাদের কোন বোন।
পত্রিকায়, ফেইসবুক টিভি, অনলাইন টিভি, ইউটুবে ছবি ও ফুটেজের ছড়াছড়ি। বাংলাদেশে চিত্র জগতের কেউ এ পর্যন্ত এধরণের উৎসব বা জন্মদিন পালন করেনি। রাত্রে একটি পাঁচতারকা হোটেলে বিশাল আয়োজন। আয়োজনটি আমারই পরিকল্পনা। নাচ-গান আর কেক কাটা, খাওয়া দাওয়া বন্ধুবান্ধবদের হৈ-চৈ বিস্তর ব্যাপার স্যাপার।
মিডিয়াওয়লাদের কাছে আমি পরীবানু নয় শুধু ‘পরী’। পরী উড়ছে, ভাসছে, হাসছে। এ যে এক অন্য জগতের জন্ম। জন্ম দিলাম আমি পরীবানু।
বিদেশ যাওয়া এখন শুধু শুটিংয়ের জন্য নয়, এমনিতেই বিভিন্ন কোম্পানির স্পন্সর হয়ে যেতে আমন্ত্রণ পেতে থাকি। (চলবে)