পরিবানু
হামিদ মোহাম্মদ
‘পরিবানু’ উপন্যাস। লিখেছেন হামিদ মোহাম্মদ। সাম্প্রতিক লেখা গ্রন্থখানা বাংলাদেশের সমাজপ্রেক্ষিত, অপ্রাকৃতিক শক্তি, জাদুটোনায় বিশ্বাস ও শঠতায় আচ্ছন্ন সমাজচিত্র এবং দাম্ভিকতার জাল ছিন্ন করার নারীর লড়াই। চলচ্চিত্রশিল্পী সাহসিকা ‘পরিমনি’র জীবনের আংশিক উপাদান রয়েছে কাহিনির নানা পর্বে। উপন্যাসটি ধারাবাহিক প্রকাশ করেছে ‘সত্যবাণী’। পাঠকদের জন্য আজ উপন্যাসটির শেষ পর্ব।সম্পাদক, সত্যবাণী।
॥শেষ পর্ব॥
বসে বসে আমি অনলাইন নিউজ পোর্টাল পড়ছিলাম। আমাকে অসংখ্য লোক সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে, ন্যায় বিচার প্রাপ্তি নিয়ে লিখছে। আমার মুক্তি চেয়ে সংস্কৃতি কর্মী ও লেখকদের মানববন্ধন। কিছু অনলইন লিখেছে আমার নাকি তিন কোটি টাকার গাড়ি, কোটি কোটি টাকা মূল্যের বাড়ি। এসব এরা পেল কোথায়? আমি একটি গাড়ি একদিনের জন্য একটি শোরুম থেকে ট্রায়ালের জন্য এনছিলাম। পরের দিন ফেরত দিয়েছি। সেটাও হয়ে গেছে আমার গাড়ি। সেই শোরুমের ম্যানেজার উত্তর দিয়েছেন, এটা আমি কিনিনি। আবার এও রটেছে আমাকে নাকি কোন এক ব্যাংক ম্যানেজার তিন কোটি টাকার গাড়ি উপহার দিয়েছেন। সেটিও যে ভূয়া তার উত্তর দিয়েছেন সেই ব্যাংক ম্যানেজার। আমি যে এফডিসিতে ৭টি গরু কোরবানি দিয়েছি, সেটি নাকি ভূয়া। আবার আমি এতো টাকা কোথায় পাই।
এসব শতাধিক আজেবাজে সংবাদ পড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। আবার আশ্বস্ত হই যখন দেখি নচিকতা চক্রবর্তীর মত গণসঙ্গীত শিল্পী আমার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমি পুঁজিবাদে হাত দিয়েছি। বিলেত থেকে একজন লেখক লিখেছেন, আমি নাকি ‘বেঙ্গুলের চাকে ঢিল মেরেছি’। আবার হাইকোর্ট যখন দেখি রুল জারি করেছেন, এই মর্মে আমাকে ‘কোন কারণ ছাড়াই তিন তিনবার রিমান্ড নেয়ার হল কেন? কারণ দর্শানো নোটিশ। হাইকোর্ট বলেছেন, ‘চাইলেই রিমান্ড দিতে হবে, এটা অন্যায়’। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট হাইকোর্টে এসে ৭ দিনের মধ্যে জবাব দিতে হবে। রিমান্ড চাওয়া সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনির কর্মকর্তা কারণ জানাতে হবে। সর্বোপরি কোর্টে এসে ক্ষমা চাইতে হবে।’
আবার দেখি, আমার ফলোয়ার্সের সংখ্যা সোয়া কোটি থেকে দেড় কোটিতে পৌঁছেছে। আমাকে জেলে নেয়া আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট হয়েছে। আমার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। যারা আমাকে চিনতো না, তারাও ফ্যান হয়েছে। আমি ভাগ্যবান।
আবার এও দেখেছি, ফেইসবুকে আমাকে কটাক্ষ করে নানা মন্তব্য করেছেন অনেক ফেইসবুক ইউজাররা। আমি নষ্টা, কলঙ্কিনী, দু:চরিত্রাসহ বেফাস কথাবার্তা। ধৈর্যের বাঁধভাঙা কথাগুলোও আমি মনে করি আমার ভাগ্য বদলে দেয়ার জন্য পজেটিভ।
এছাড়া আমি বাসায় জেল থেকে পৌঁছে জানতে পারি বাসার অন্যান্য ফ্লাটের মানুষজন ত্যাক্তবিরক্ত। আমার ফটো তোলার জন্য ক্যামেরাম্যান, দুটি কথা জানার জন্য সংবাদকর্মীদের সারাক্ষণ ভিড় লেগে থাকে। আমাকে বাসা ছাড়তে হবে। বিব্রতবোধ করে ভাবি, আমি এ সময় বাসা পাবো কোথায়, কে-ই বা বাসা ভাড়া দেবে আমাকে? আমি যে নষ্টা!
আমি যখন এসব পড়ে পড়ে ক্লান্ত হচ্ছিলাম এসময় বাসার গেইটে হৈ-চৈ শব্দ শুনি। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, আমার পুত্র উজ্জ্বল কেঁদে কেঁদে ঢুকছে বাসায়। নানা বগলদাবা করে ধরেছেন তাকে। উজ্জ্বলের শার্ট ছেড়া। ডানপাশটা ঝুলে আছে। আমি দৌঁড়ে নিচে নামতে যাচ্ছি দেখে পাশের ফ্লাটের সুরাইয়া খালাম্মা আমাকে ঝাঁপটে ধরে আটকালেন। তিনি নেমে গেলেন নীচে। আমার জাদুমনি উজ্জ্বলকে জড়িয়ে ধরে তিনি উপরে উঠলেন। আমি দরজা খুলে বাবুকে কোলে নিলাম। আমার মাথায় যেন বজ্রপাত হল। তার কোন কথা বুঝা যাচ্ছে না কাঁন্নার চটে। তোয়ালে ভিজিয়ে এনে মুখ মুছিয়ে দিই।
নানা বললেন, হোস্টেল সুপারেন্টডেন্টের ফোন পেয়ে তিনি বাজার থেকে বাড়ি ফেরার রাস্তায় ছিলেন, গাড়ি ঘুরিয়ে যান। গিয়ে দেখেছেন সে কাঁদছে। দু’জন টিচারও দাঁড়ানো পাশে। তাকে সান্তনা দিচ্ছেন। তারা সাথেও এসেছেন। হাত দিয়ে তাদের দেখিয়ে বললেন, ওনারা ঘটনা জানেন।
ঘটনা কি? বিস্ময়ে হতবাক হয়ে শুনি। সপ্তাহ দশ দিন হয় তারই হোস্টেলের ছেলেপিলেরা তাকে নানভাবে হেনস্থা করছিল। তারা নাকি নেটে পড়েছে আমার গ্রেফতার হওয়ার খবর, আমার সম্পর্কে খবরের কাগজগুলোর রসালো সংবাদ। ফেইসবুকে ইত্যকার মন্তব্য। এ নিয়ে তাকে হোস্টেলের অন্যান্য ছেলেরা প্রশ্নবানে জর্জরিত করছিল। এমনকি গালাগাল কটুক্তিও কম করেনি। এতদিন সহ্য করে আসছিল, কিন্ত পাল্টা উত্তর দিয়েছিল। যাতে ওরা ক্ষেপে যায়। তারপর, মারামারি।
উজ্জ্বল কেঁদে কেঁদে বললো, একটি ছেলে খুব নাদুসনুদুস, সব সময় সে তার কাছ থেকে চকলেটের পয়সা চেয়ে নিত। সে লাত্থি দিয়ে বলেছে, শালা আমরা পয়সা পাইনা ভাত খেতে, তুই এতো পয়সা পাস কই, ‘মাগীর পুত’? উজ্জ্বল বললো, তখন আমি আর বসে থাকিনি, আমিও লাত্থি দিছি। পরে তো তার সঙ্গে থাকা এক পাল ধাঙর ধাঙর বালক হামলে পড়ে তার ওপর। কিল চড়, লাত্থি বসায়, শার্ট ছিড়ে ফেলে।
এসব শুনে আমিও কেঁদে ওঠি। জাদুমনির মুখ মুছতে মুছতে বলি, বাবা তুমি হলে মায়ের পুত, যারা তোমাকে বলেছে তারা ‘মাগীর পুত’।-সমাপ্ত