মাতাল বাঁশি
হামিদ মোহাম্মদ
(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)
(উৎসর্গ: অসাম্প্রদায়িক মাতৃভূমি নির্মাণের উদ্দেশ্যে)
॥এক॥
লন্ডনে যখন পা রাখলাম তখন সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশে ওড়ার সময় মিউনিখের বিমান বন্দর ছিল রোদ ঝলমল। ইউরোপ আসার আগে বাংলাদেশে ছিলাম। সন্ধ্যা তখন নামতো পাখির কিচিরমিচিরে, রোদ হলুদ হলে। দু‘বছরে অনেকটা ভুলে গেছি, বাংলাদেশকে।
মাকে একটু পরেই পাবো এরাইভ্যালে দাঁড়িয়ে আছেন, আমাকে দেখে হাত নাড়বেন, হেসে ওঠবেন, আমিও হেসে এগিয়ে জড়িয়ে তাপ নেব মায়ের শরীরের।
না তাপ নিতে পারব না, করোনা ভাইরাস কভিড-১৯-এর কারণে তাকে জড়িয়ে ধরতে পারব না। নির্দিষ্ট দূরত্ব, অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রেখেই মা’র সাথে কুশল বিনিময় করতে হবে। বরাবর হিথরোতে নামলেই মা ও বাবা থাকতেন এ্যরাইভাল করিডরে, আর আমি হুলস্থুল শুরু করে দিতাম মাকে না বাবাকে, কাকে আগে জড়িয়ে ধরি–এমনি জল ছল ছল চোখে হেসে উঠতাম। বাবাকে আজ দেখব না, তিনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন দু’বছর আগে হার্ট-এ্যাটাকে, এক ভর সন্ধ্যায়। মরণোত্তর দেহদানের কারণে তিনি হাসপাতলেই আছেন, তবে নির্জীব। বাবার মুত্যুর পর বাংলাদেশ থেকে ছুটে এসেছিলাম। তার লাশ এনএইচএস-এ হস্তান্তর করতে রয়েল লন্ডন হাসপাতালে উপস্থিত ছিলাম আমি। বাবা তার দেহ দান করে গিয়েছিলেন এনএইচএস-এ। সে কাজটি সুচারুরূপে সম্পাদন করে মা ও আমি চোখভরা জল নিয়ে ঘরে ফিরি। পাঁচদিন পর সেই বাংলাদেশে কর্মস্থলে পাড়ি দিয়েছিলাম। ফিরছি আজ ২২ ডিসেম্বর ২০২০, মাঝখানে দু’বছর মিউনিখ বাস। সেখানে ‘এন্ত্রোপলজিক্যাল গ্লোবাল হেলথ’-এর একটি কোর্স সম্পন্ন করে ফেরা।
মোট দশ বছর ছিলাম বাংলাদেশে। দু’বছর জার্মানির মিউনিখ আর আজ কতদিনের জন্যে পাড়ি দিলাম লন্ডনে–তা জানি না। মিউনিখে থাকার কথা ছিল না, কথা ছিল সরাসরি লন্ডনে পা দেবার, বাবার অবর্তমানে আমি হব মা’র নিতান্ত সঙ্গী। কিন্তু ‘এন্ত্রোপলজিক্যাল গ্লোবাল হেলথ’ কোর্সটি আমাকে টেনে ধরে, নিয়ে যায় মিউনিখে। প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল, হিউম্যান এন্ত্রোপলজিক্যাল টার্মটা মাথায় ঢুকিয়ে কোন স্বস্থি পাই কিনা। কারণ, বুঝতে চেয়েছি েলাম, মানুষ কী-না তার জিনে বহন করে এমন একটি ¯স্রোত, যা রক্তপ্রবাহে–প্রতারণার অর্ন্তজাল তৈরি করে। আরও জানতে চেয়েছি কতটুকু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। নি:সঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর আমি এমনি একটি গবেষণা কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ কোর্সটি সম্পন্ন করি।
বাবা আহমেদ আজাদ মারা যাওয়ার দু’বছর হয়ে গেছে, মা সেই কঠিন সময় পার করেছেন। তার অসম্ভব নি:সঙ্গতা কাটিয়ে উঠেছেন এতদিনে। এখন আবেদীন সালাম নামের তার সতীর্থকে নিয়ে স্বপ্ন রচনায় বিভোর, তা আবার ঘর বেঁধেছেন গোটা দিনেক হয়। ষাটোর্ধ মা আমার। মন তার কঁচি খুকিদের মত। মাঝে মাঝে আমাকেও হার মানান তিনি। আমারও ভাল লাগে তার খুকী খুকী ভাব। এই চঞ্চল মা, ঘোর নি:সঙ্গ থাকা পছন্দ করেননি। এই অবস্থায় সালাম কাকুও তার বৈধব্য ঘোচাতে মা‘কে পেয়ে যান। বলতে গেলে মা যাতে বৈধব্যমুক্ত হন, তাতে আমারও সায় আছে, অর্থাৎ মা’র আসলে-ই তো একজন সঙ্গী চাই বা দরকার। খুনসুঁটি, আড্ডা, গল্প করা, তথা বেড়ানোর একজন সাথী অবশ্যই প্রয়োজন। মানুষ একা থাকবে কী করে! যারা থাকে, তারা কী করে থাকে, তা আমার জানা নেই। জোড় মেলাতে তো হতে হবেই। হাটঁতে হবে দু’পায়ে নয়, চার পায়ে, এটা আমার থিওরীই ধরতে পারেন। অনেকের কাছে এসব হাস্যকর হতে পারে, কিন্তু আমার অবস্থান এরকম, এতে অনড় আমি।
এক প্রচন্ড রকমের প্রকৃতির দান আমার মা, প্রকৃতির মতই দোল খান, হাওয়ায় ওড়েন, জলে ভাসেন, মানুষের মাঝে ডুব মারেন–এক অদ্ভুত স্বভাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের মাটিকাঁপানো মেয়ে সেলিনা তাপাদার পরবর্তীতে সেলিনা আজাদ হয়েছিলেন। তার ব্যাচমিট আবেদীন সালাম। সেই সালাম কাকু এখন মা’র সাথী, জীবন সঙ্গী। এক অজানা রোমান্স ওড়ছে তাদের চোখে, ভাসছে মাথার ওপর হাওয়া হয়ে, ধমকা বাতাসে নড়ছে শরীর,নদীর ঢেউয়ে কাপঁছে ঠোঁট। এতসবের পরেও মা’ এখনও সেলিনা আজাদ নামেই আছেন। সহসা ‘আজাদ’ পদবীটা বদলাতে চান না, বরং এ পদবী বহন করেই বাকী জীবন চলতে চান, সালাম কাকুও মেনে নিয়েছেনÑযতটুকু জানি।
মা সেলিনা আজাদ এয়ারপোর্টের এরাইভ্যাল লবিতে থাকবেন নিশ্চিত, সঙ্গে সালাম কাকুও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাবো। তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ঢাকায় বাবা মারা যাওয়ার পর, আমাকে শান্তনা দিতে গিয়েছিলেন আমার বাসায়। তার সাথে বাবা পরিচিত হয়েছিলেন মা’র বিয়ের এক বছর পরেই। মা-ই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সহপাঠী বলে। এরপর তাদের মধ্যে বন্ধত্বু চলে দীর্ঘদিন। সালাম কাকু ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক তখন। মা’ পাড়ি দেন লন্ডনে, শিক্ষক হয়ে, বাবাও বিলেত ফেরত আইনজীবী। মা-বাবার বিলেত আসার বছর সাতেক আগে বাংলাদেশে আমার জন্ম। লন্ডনে আসেন যখন, সে সময়টা ১৯৯২ সাল। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে আন্দোলন চলছে, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর নেতৃত্বে রয়েছেন। গণআদালত বা ট্রাইবুনাল বসিয়ে বিচার হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সরকারও ১০১ জনকে আসামী করে দেশদ্রোাহী মামলা রুজু করে দিয়েছে। বলতে গেলে দেশ গণগণে আগুনের ফুলকি। টান টান এসব উত্তেজনাপূর্ণ গল্প শুনেছি ম’ার কাছ থেকে।
যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপির জোট সরকার। বিএনপির যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। তাই ক্ষমতাগ্রহণের পর পরই নানাক্ষেত্রে দেশে কিছু মৌলিক পরিবর্তন শুরু করে তারা। তখনই নড়েচড়ে ওঠে প্রগতিশীল সচেতনমহল, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী সংগঠনসমূহ। যুদ্ধাপরাধীদের মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহের বিচার আন্দোলন শুরু হয় দেশব্যাপী। এই সময় সালাম কাকু বিশ্বাবদ্যলয়ের ক্লাশে যুদ্ধাপরাধীদের সন্তানদের পড়াবেন না–এই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হয়ে শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। তার মুখ থেকেই শুনেছি, তার ক্লাশেই ছিল যুদ্ধাপরাধীদের তিনজন সন্তান, তিনি সহ্য করতে পারতেন না যখন ক্লাশে ওরা ঢুকতো, বসে বসে শুনতো লেকচার। এই অপরাধবোধ তাকে তাড়া করতো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীর আন্দোলনের সুযোগে তিনিও প্রতিবাদ স্বরূপ চাকরিতে ইস্তফা দেন। মা’র কাছে সালাম কাকুর এ গল্প শুনেছি। আর সালাম কাকুও যেন এইভাবে আমাদের আপনজন হয়ে ওঠেছিলেন অনেক আগেই। এয়ারপোর্টের এ্যারাইভ্যাল লনে তাকে অর্থাৎ সালাম কাকুকে মা’র পাশে দেখলে তাই আমার খারাপ লাগবে না, বাবা যে নেই সেটা তার পরিচ্ছন্ন মন, লড়াকু চিন্তা দিয়ে–তথা বাবার প্রবল আত্মবিশ্বাসী জায়গাটি এতো দিনে দখল করে ফেলেছেন তিনি। আর এসব সম্ভব হয়েছে, স্কাইপে,ভিডিও আলাপে, মার সাথে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে। মা-ও আমার সাথে কথা না বলে ঘুমোতে যান না। কী খেলাম, রান্না করলাম কিনা সব খুটিয়ে খুটিয়ে জেনে, তারপর ঘুমুতে যান–সঙ্গে আমিও ঘুমাই, যেন মা-মেয়ে এক সাথে। যত দূরে থাকি না কেন, বাংলাদেশ কিংবা জার্মান, সব জায়গা সমান।
আমি মিউনিখ ছাড়ার আগেই ফেইসবুক ক্রল করে দেখেছি বাংলাদেশে কুষ্টিয়া শহরের চৌরাস্তার মোড়ে নির্মিতব্য জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙে দিয়েছে মৌলবাদীরা। সুতরাং আকাশে যতক্ষণ ছিলাম বলতে গেলে মনটা খারাপই ছিল। নামার পর চুপসে যাওয়া মনটা মাকে পাওয়ার আনন্দে একটু ফুরফুরে হয়েছে। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ সম্পাদন করে বেল্ট থেকে লাল সুটকেশটা টেনে ছুটলাম করিডোর দিয়ে। ভাস্কর্যের কথা মনে হতেই মনের আয়নায় ভাসতে লাগল ঢাকা শহর, নির্মিয়মান পদ্মাসেতু, জলভরা বর্ষায় থৈ-থৈ দেশ। আবার অগ্রায়হনে হলুদ মাঠ, ঢেউ খেলানো পাকা ধান। মনে আরো ভেসে ওঠে একই সঙ্গে মোল্লাদের হেফাজতে ইসলাম নামক দলের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ না-করতে দেয়ার ঘোষণা, স্থানে স্থানে তাদের লক্ষ মানুষের জমায়েত। জমায়েতগুলোতে মওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী, মওলানা ফয়জুল করিম চরমোনাই ও আল্লামা মওলানা মামুনুল হকের ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও উসকানিমূলক বক্তৃতা যেন কানে শন শন করে বাজতে থাকে।
পদ্মাসেতু থেকে ঢাকার প্রবেশমুখ ধোলাইপাড় মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ করছে সরকার। মোল্লারা তা নির্মাণ করতে দেবে না, নির্মাণ করলে ভেঙে বুড়িগঙ্গায় গুড়িয়ে দেবে–এই হুঙ্কার দিয়েছে, হুমকি দিয়েছে। এটা নাকি মূর্তি। মূর্তিপূজা ইসলামে না-জায়েজ, বেদাত। তারা ঘোষণা দিয়েছে কোরআন, হাদিস সূন্নাহ পরিপন্থী কোন কাজ করতে দেবে না–একজন ইসলামপ্রেমিক ঈমানদার মুসলমান বেঁচে থাকতে। জীবন দিয়ে হলেও প্রতিহত করবে তারা। বাংলাদেশে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এ নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে, পাল্টাপাল্টি সভা হচ্ছে। একদিকে ইসলামী গোষ্ঠী নানা নামে, অপরদিকে যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট তথা ৬৫টি সংগঠন। জেলায় জেলায় তারাও নানা কর্মসূচী ঘোষণা দিয়েছে। চলছে প্রতিবাদী মানব-বন্ধন, মিছিলমিটিং। কর্মসূচীগুলোতে ভাস্কর্য নির্মাণ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হচ্ছে শহর-গ্রাম-মহানগরে সর্বত্র। দেশে বলা যায়Ñমুখোমুখি দুটি পক্ষ। কবে কী হয়। এরই মধ্যে ঘটে গেল কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মীয়মান ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা। দেশ উত্তপ্ত। অন্যদিকে, করোনা ভাইরাস কভিড-১৯-এর প্রকোপে দেশ কেন, বিশ্ব কম্পিত, এ পর্যন্ত লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া এ দানবকে ঠেকানো যায়নি। এই অবস্থায় বাংলাদেশ মোকাবেলা করছে মৌলবাদীদের উৎকট হুংকার, বিরক্তিকর চ্যালেঞ্জ। এই দুর্বিসহ দিনে, সর্বোপরি করোনা ভাইরাসের মানবপ্রজাতি বিধ্বংসী চ্যালেঞ্জের মুখে আমি লন্ডনে পা রাখলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে মা’র কোলে নিরাপদ হব। (চলবে)