মাতাল বাঁশি

 হামিদ মোহাম্মদ

(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)

(উৎসর্গ: অসাম্প্রদায়িক মাতৃভূমি নির্মাণের উদ্দেশ্যে)

॥আট॥

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে কবি শামীম আজাদের পূর্বোখেল্লিত স্ট্যাটাসের জের ধরেই বলতে চাই আরো কিছু সংগ্রামী তৎপরতা ও তাদের কাজ সম্পর্কে। বাবার কাছে শোনা। বাবা এর আগে ১৯৮৭ সালে আইন পড়তে বিলেত এসেছিলেন।

তার বর্ণনা হুবহু এরকম–‘কিছু দিন পর লন্ডনে হামিদ মোহাম্মদও আসেন। ¯স্রেফ,ঘুরে যাওয়া। লন্ডনে প্রথম সফর। এসেই আমরা দুজন জড়িয়ে পড়ি সাংস্কৃতিক কাজে। উপলদ্ধি করি–এখানে বাঙালিদের মাঝে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কাজ করা প্রয়োজন। প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিকে পরিচর্যা করতে হলে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাÐকে বেগবান করা জরুরী। সিদ্ধান্ত নিই উদীচীর শাখা গঠনের। দেশে উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে যোগাযোগ করে অনুমতি পাই। বাংলাদেশে তখন স্বৈারচার বিরোধী আন্দোলন চলছে এক টানা। সাংস্কৃতিক আন্দোলনও। লন্ডনেও রাজনৈতিক দলসমূহ আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয়। এ অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গঠন করা প্রথমে জরুরী মনে করি। কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গঠনেরও অনুমতি পেতে বিলম্ব হয়নি। লন্ডনে সামসুল আলম ও সৈয়দ রকিব আহমেদ আসেন একই সময়ে। কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করতে এগিয়ে আসেন পুরাতন কর্মী নিখিলেশ চক্রবর্তীও। পার্টির শাখা সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে অতিথি হয়ে আসেন আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাহিদ। সম্মেলনের মাধ্যমে নিখিলেশ চক্রবর্তী সভাপতি, সৈয়দ রকিব আহমেদ সাধারণ সম্পাদক ও হামিদ মোহাম্মদ সহসাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই সময়ে  উদীচী গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ সময়  বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে  বইমেলা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর কর্ণধার মফিদুল হক। আমরা সিদ্ধান্ত নিই উদীচীর সম্মেলন উপলক্ষে বইমেলার আয়োজন করা সম্ভব। ১৯৮৮ সালে, প্রথমে একটি আহবায়ক কমিটি গঠন করে  সম্মেলনের প্রস্তুতি নিতে থাকি। ২৫ সদস্যের আহবায়ক কমিটিতে আহবায়ক হামিদ মোহাম্মদ ও যুগ্ম আহবায়ক হন সৈয়দ বেলাল আহমেদ।

১৯৮৯ সালের ১২ অক্টোবর পূর্ব লন্ডনের ডেভেনান্ট সেন্টারে সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হলো। সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালা ও বইমেলা। বইমেলা উদ্ধোধন করেন সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। অতিথি হিশেবে উপস্থিত ছিলেন এ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল আর্ন্তজাতিক ব্যক্তিত্ব  ইয়ান মার্টিন।

১৪ অক্টোবর সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে গণসঙ্গীত শিল্পী লুসি রহমানকে সভানেত্রী ও সৈয়দ বেলাল আহমেদকে সেক্রেটারি ও মোহাম্মদ হরমুজ আলীকে কোষাধ্যক্ষ  নির্বাচিত করে ২৫ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। সহসভাপতি নির্বাচিত হন  হামিদ মোহাম্মদ ও ডা.  ফজল মাহমুদ। উপদেষ্টা ডা, কুদরতুল ইসলাম ও মাহমুদ এ রউফ। সাধারণ সভায় কমিটি ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা লেখক ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মফিদুল হক।

এ সময় বিলেতের নিস্তরঙ্গ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উদীচীর সম্মেলন ও উদীচীর উদ্যোগে সপ্তাহব্যাপী বইমেলা সাধারণ মানুষের মধ্যেও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। বইমেলায় উপচেপড়া ভীড় এবং অনুষ্ঠানাদিতে শ্রোতাদের উপস্থিতি এতোই ব্যাপক ছিল, নিয়ন্ত্রণ করতে স্বেচ্ছাসেবকদের  হিমশিম খেতে হয়।

সেই সময়ে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী যুক্তরাজ্য শাখা অল্প দিনেই বিলেতের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গতি সঞ্চার করে। ঘন ঘন গণসঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি ও গণমুখি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ব্যতিক্রমী ধারা সৃষ্টি করে। কাজের গতি ধারায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও এসে সমবেত হন ও সহযোগিতা করেন। উদীচীর এই পথচলায় বর্তমানে অনেকগুলো সংগঠন গড়ে উঠেছে। এরাই বিলেতে বাংলা সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। বিলেত তথা যুক্তরাজ্য এখন বাংলা সংস্কৃতিচর্চার অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র।

কিন্তু আমরা যে উদ্দেশে ৮৮ সালে উদীচী প্রতিষ্ঠা ও  সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলাম তা কতটুকু সফল হয়েছে তার হিশেব মেলাতে পারছি না  যেন। উদীচী বিলেতে বর্তমানে অনেক বড় সংগঠন। অন্যান্য শহরেও গড়ে ওঠেছে। বিলেতে বাঙালি সমাজের প্রগতিশীল বিকাশ চোখে পড়লেও, মৌলবাদের বিস্তার  এতোটা বেড়েছে, দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় নেই।

  কিছুদিন আগে একটি অনলাইন শপিং ওয়ারহাউসে কাজ করতে গিয়ে হিমশিম খেলাম। প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা একজন বাঙালির। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইন্ডিয়া, ইরান, আরব ও তুরস্ক থেকে নানান পণ্য আসে। কাপড়ের মধ্যে বোরকা,  নেকাব, হিজাব, সেলোয়ার, কামিজ, শাড়িসহ শতাধিক আইটেম। আরও আছে আতর, হালাল সেন্ট, হালাল কসমেটিক। ইসলামিক বই বাংলা, ইংরেজি ও ইংলিশ ভাষায় অনুদিত। অনলাইনে অর্ডার আসে। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো, কমপক্ষে হাজারখানেক বোরকা বিক্রি হয় প্রতিদিন। নেকাব, হিজাব, হালাল সেন্ট ও আতরের কথা বলে তো লাভ নেই। অন্যদিকে, অর্ডারদাতাদের মধ্যে বাঙালি তরুণীরাই হলেন আশি ভাগ। অথচ দু’দশক আগে বিলেতে বোরকা বিক্রি বা পরার কথা ভাবা-ই যায়নি, হিজাব নেকাব তো দূরের কথা।

যতটুকু মনে পড়ে, ইরানে খোমিনীর উত্থানের সময় প্রথম বোরকা পরে মেয়েদের রাস্তায় মিছিলে দেখা গিয়েছিল। তারপর আফগানিস্তানে তালেবান শাসন, আলকায়দার উত্থান, এখন আইএসআইএস-র উত্থান ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায়। ‘আরব বসন্ত‘নামে মিশরসহ মুসলিম দেশগুলোতে চলছে উগ্র রাজনীতি ও উগ্র শাসক শ্রেণীর আর্বিভাব। আর এসব নব্য ইসলামী ধ্যানধারণা ও পোশাকের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে বিলেতের বাঙালি মেয়েরা। এ সমস্ত  দেশের মেয়েদের নব্যধাচের পোশাক পরিচ্ছদ পরা ও কায়দা কানুন  অনুসরণ করছে তারা। শুধু পোশাক পরিচ্ছদ ধার নয়,তাদের উগ্র মৌলবাদী ধ্যানধারণাও রপ্ত করতে পিছ পা হচ্ছে না। অথচ চার দশক আগে আমাদের মায়েরাও পর্দা মেনে চলতেন, তবে এ রকম নয়। মাথায় ও গায়ে হালকা চাদর রাখতেন, শালীনতা বজায়  রেখে চলাফেরা করতেন।

বর্তমানে পর্দার অপব্যবহারও হচ্ছে দেশে দেশে। পর্দার আড়ালে মুখ ঢেকে বোমাবাজি, খুন, সন্ত্রাস, ছিনতাই এমনকি ডাকাতিও হচ্ছে। আর মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক কর্মকাÐ তো চলছেই সব দেশে।

মরোক্কোর মত মুসলিম দেশ বোরকার অপব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে সম্প্রতি  বোরকার উৎপাদন ও বিপনন নিষিদ্ধ করেছে ২০১৭ সাল শুরুর প্রথম মাস জানুয়ারিতেই। কিন্তু  এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শোরগোল ওঠেছে সে দেশটি ছাড়াও মুসলিম দেশগুলোতে।

কথা হচ্ছে, ইতিহাস কী পেছনে ছুটছে মধ্যযুগের দিকে! প্রতারক ও হন্তারক সমাজ তৈরী হচ্ছে! প্রতারিত হচ্ছি আমরা! ডুবে যাবো কোন-সে অতলে! যার তল নেই।

লন্ডনে অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে সামাজিকতা ও কাজের সুবাদে। এমনি পরিচিত দু‘জনের কথা বলতেই হয়। একজন হলেন বিলেতবাসী এক তরুণীকে বিয়ে করে বাংলাদেশ থেকে এসে স্থায়ী হয়েছেন। তিনি এদেশে এসে বিদ্যমান সমাজে নিজেকে খাপ খাওয়াতে গিয়ে নানা ধরনের হতাশায় আক্রান্ত। বাঙালি আইডিন্টিটির পাশাপাশি মুসলিম আইডিন্টিটিতে স্বচ্ছন্দ্য অনুভব করেন। লম্বা দাঁড়ি রেখেছেন। লম্বা জোব্বাও পরেন। স্ত্রীকেও বোরকা-নেকাব পরা দেখতে চান। এতে দ্বন্ধ, বিরোধ সৃষ্টি হয়। বছর পাঁচ গড়িয়ে যায় দ্বন্ধ বিরোধে। একে একে তিন সন্তান জন্ম নেয়। এক পর্যায়ে তিন সন্তান নিয়ে স্ত্রী পৃথক বসবাস শুরু করেন। পৃথক বসবাস শুরু হয় বাচ্চার জন্মদিন পালন নিয়ে দ্বন্ধের জেরে। স্বামী বলছেন, জন্মদিন পালন না-ফরমানি এবং গোহনার কাজ। সৃষ্ট এই বিরোধ থেকেই পরিবারটি ভেঙে যায়। সন্তান নিয়ে মা-বাপের টানাটানিও আরেক গল্পের সৃষ্টি করে।

অন্যজন হলেন লন্ডনে স্টুডেন্ট হয়ে আসা ব্যক্তি। চোখে উচ্চশিক্ষার হাতছানি। স্থায়ী হওয়ার সহজ পথ ব্রিটিশ নাগরিক মেয়েকে বিয়ে করা। এ পথ মাড়িয়ে এখন দুর্বিপাকে। প্রগতিশীল ও ধ্রæপদী সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ তিনি। স্ত্রী বিপরীত জগতের বাসিন্দা। সাংস্কৃতিক জগতটা খোলামেলা। এই খোলামেলা জগতের মানুষ তিনি। আড্ডাবাজও দারুন। আড্ডার ধরণটাও না-রাত, না-দিন হিশেব নেই। সামাজিক অন্তরঙ্গ পরিবেশ, এসব না-পছন্দ এই তরুণীর। কাজ আর ঘর, বড়জোর বাপের বাড়ির আত্মীয়স্বজনকে ঘিরে থাকা চাই,এর বেশি নয়। হিজাব আর নেকাব ছাড়া চলেন না। এ নিয়ে দ্বন্ধ। গর্ভে সন্তান মহিলার। গর্ভাবস্থায় শুরু হয় পৃথক বসবাস, মুখ না-দেখাদেখি। এক কন্যা সন্তান জন্ম নেয় কিছুদিন পর। কিন্তু কন্যার মুখ দেখা হয়নি বাবার।

এসব তো বিলেতে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কথার হেরফের হলেই পৃথক বসবাস, একে অন্যকে  ছেড়ে চলে যাওয়া। বড় সস্তা জীবন এখানে। অটুট বন্ধনের সংসার আশা করাই যায় না। আর ভাঙনটা কোন কোনটি আদর্শগত, ধ্যান-ধারণার মনে হলেও মূলত এক ধরনের অপ-জেদ বা স্বার্থপরতা-ই এতে ক্রিয়াশীল–বড় বেশি প্রভাব আমিত্বের।

এর পেছনে সাম্প্রদায়িকতাও রয়েছে। মুসলিম বা মুসলমান পরিচয়। এই পরিচয়ের ভেতর বহুবর্ণের বা  বহুজাতিক সমাজে বর্ণবাদও জায়গা করে নিচ্ছে বা  রয়েছে। বিলেতের বাঙালি সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া এসব বাস্তব চিত্র দেখেশুনে বিবেকবানরা হতভম্ব। অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন আসতে পারেÑসাম্প্রদায়িকতা কী আবার আমাদের গ্রাস করবে? বা করছে? বর্ণবাদের উত্থান, উগ্র জাতীয়তার পুর্নজন্ম!

বুক ভরে শ্বাস নিতে গিয়ে তিল তিল কষ্ট  জেগে ওঠে। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খায় মস্তিষ্কে, মগজে। শুদ্ধ মানুষ, শুদ্ধ সমাজের স্বপ্ন কই? মানবকিতার যে মাতাল বাঁশি এক সময় মনে লালন করতো এ সমাজ, শুনতো তার সুরধ্বনি, কই? সেই  বাঁশি. . .।  (চলবে)

You might also like