মুক্তিযুদ্ধে বেতিয়ারার বীর শহীদদের কথা

 পরিতোষ দেবনাথ

২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্যরাতে ঢাকায় পাক হায়েনাদের ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামের বিভীষিকাময় নারকীয় হত্যাকাণ্ড, লুটপাট অগ্নিসংযোগের পরে জীবন বাঁচাতে বহু মানুষ ছুটে চলে শহর ছেড়ে গ্রামে। সর্বত্রই শুরু হয় প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। মুক্তিযুদ্ধ।
অসংখ্য মানুষ দেশ ছেড়ে পাড়ি জমায় ভারতে। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাছাকাছি সীমান্ত আগরতলা। সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরুণ সদস্যরা জমায়েত হতে শুরু করেছেন আগরতলায়। ওখানকার সিপিআইয়ের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ গ্রহণে আগ্রহী ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি – ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের ঠাঁই হয়েছে ক্রাফটস ইনস্টিটিউশন হোস্টেলে। বামেদের মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিষয়টা খুব সহজ ছিল না। মণি সিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের প্রচেষ্টায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়।
২৭ মে বিকেলে প্রথম দলটি আগরতলা বিমানবন্দর হয়ে আসামের তেজপুরে পৌঁছায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন মেজর প্রশিক্ষণার্থী দলকে অভিনন্দন জানিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে নিয়ে যান। ২৮ মে থেকে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। প্রতিটি স্কোয়াডে ১০ জন করে ১০টি স্কোয়াডে ভাগ করে দেয়া হয়। এরপর চলতে থাকে প্রতিদিন নিয়মিত প্রশিক্ষণ। ১৭ জুন তেজপুর ক্যান্টনমেন্টে ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর প্রথম দলের প্রশিক্ষণ শেষ হয়। এদের মধ্য থেকে ৪৫ জনকে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য নেয়া হয় চীন সীমান্তের কাছাকাছি নেফা নামক একটি স্থানে। প্রশিক্ষণ শেষে সবাই ১৫ জুলাই বাইখোরা বেস ক্যাম্পে এসে পৌঁছায়। ১৮ জুলাই সবার হাতে তুলে দেওয়া হয় যুদ্ধ অস্ত্র।
১৯ জুলাই ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ ও সরদার আব্দুল হালিম ক্যাম্প পরিদর্শন করে মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিকভাবে উজ্জীবিত করেন। সময় পার হতে হতে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে গেরিলা বাহিনীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দেশে প্রবেশের অনুমতি পায়। কমিউনিস্ট নেতা ওসমান গনির নেতৃত্বে এই দলটি সফলভাবে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
নভেম্বরের প্রথমদিকে কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খানের নেতৃত্বে আরো কয়েকটি দল বাংলাদেশে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হয়। ১১ নভেম্বর ন্যাপের চৌধুরী হারুন-অর-রশিদ, কমিউনিস্ট নেতা মঞ্জুরুল আহসান খান ও কমান্ডার আব্দুর রউফের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনীর সব ক’টি দল বাংলাদেশের বিলোনিয়া সীমান্তের অপর প্রান্তে ত্রিপুরা রাজ্যের চোত্তাখোলা পৌঁছায়। চোত্তাখোলার পশ্চিম সীমান্তে চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথ দীঘির পাশের রাস্তা ধরে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলাদের স্বদেশে ফেরার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। ন্যাপ নেতা চৌধুরী হারুন অর রশিদ গেরিলা দলগুলোকে শেষবারের মতো সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন। সামনের দুটো দল দুদিগ থেকে এগিয়ে গেল সীমান্তের পানে। এই দুটো দল সফল হলে অন্যরাও এগিয়ে যাবেন সেই পথ ধরে। ওদের হাতে অস্ত্র শস্ত্র আর ন্যাপের ‘নতুন বাংলা’ কমিউনিস্ট পার্টির ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকা।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে খন্দকার মোস্তাক গংয়ের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি অংশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নীলনকশা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি এবং পাকিস্তানের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার অশুভ প্রচেষ্টা চালানোর একটি বিশেষ প্রতিবেদন ‘নতুন বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সকল বামপন্থী দলগুলো এ বিষয় নিয়ে অস্থায়ী সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে। ফলে মোস্তাক গংয়ের প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়।
সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের পানে এগিয়ে চলে গেরিলা দল। গেরিলা দল সিএন্ডবি সড়কে পৌঁছার আগেই ওত পেতে থাকা থাকা শত্রুবাহিনীর মুখামুখি পড়ে যায় । শুরু হয় গোলাগুলি। পাকসেনারা গেরিলা দল দুটিকে বিভিন্ন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। অসীম সাহসী যোদ্ধাদের অনেকেই পাক সেনাবাহিনীর বুহ্য ভেদ করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে গেরিলাদের ৫ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন এবং ৪ জন পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বেতিয়ারা গ্রামের কাছাকাছি পাকবাহিনীর ক্যাম্পে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতারকৃত ওই ৪ জন শহীদ হন।
ওরা ৯ জন ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুম মুনির, নিজাম উদ্দিন আজাদ, বশিরুল ইসলাম, জহির জহিরুল হক দুদু, শহীদুল্লাহ সাউদ, আব্দুল কাদের, আওলাদ হোসেন, শফিউল্লাহ ও আব্দুল কাইয়ুম।
ওদের স্মৃতি নিয়ে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বেতিয়ারার শহীদ মিনার।
লাখো শহীদের কাঙ্খিত বৈষম্যহীন, অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় আজও বীর মুক্তিযোদ্ধা, সৎ, আদর্শবান মানুষেরা তাদের সাধ্যমতো লড়াইয়ের পতাকা বহন করে চলেছেন। আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের সংসদে সরকার এবং বিরোধী দলের আসনে থাকবেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। কিন্তু ৭৩ এর সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই সেই ধারাটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তার পরবর্তী অবস্থাটা বারবার কালো পর্দায় আচ্ছাদিত হয়ে গেছে।
প্রকৃত অর্থে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার জন্য সৎ, আদর্শবান, নির্লোভ, মানুষ ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা এক কাতারে দাঁড়িয়ে অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ গড়তে গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।

পরিতোষ দেবনাথ: সাংবাদিক, রাজনীতিক। সম্পাদক, নতুন বাংলা।

You might also like