রাজপথের লড়াকু নেতা মোহাম্মদ নাসিম
আবু মুসা হাসান
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে রাজপথের লড়াকু নেতা মোহাম্মদ নাসিম গুরুতর অসুস্থ হয়ে লাইফ সাপোর্টে আছেন।
‘৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নির্মমভাবে নিহত বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জাতীয় চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর পুত্র সাবেক মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য । তিনি ১৪-দলীয় জোটের মুখপাত্র। তবে ছাত্র জীবনে তিনি এবং তার স্ত্রী আন্জুমান ভানু বিথী পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যায়নকালে ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত ছিলেন।
‘৮০ এবং ‘৯০ দশকে রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত থাকায় রাজপথে এবং জাতীয় সংসদে বা সচিবালয়ে মোহাম্মদ নাসিমের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তাই নাসিম ভাইয়ের সাথে রয়েছে আমার অনেক স্মৃতি। শুধু একটা ঘটনা উল্লেখ করছি।
তিন জোটের এরশাদবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। গ্রেফতার এড়ানোর জন্য নেতারা গাঢাকা দিয়ে আছেন। তবে অনেকেই মিছিল-মিটিংএ অংশ নিয়ে ঝটিকা সরে পড়তেন।
ঐসময় আমি দৈনিক পূর্বকোণ এর ঢাকা ব্যুরো চীফ এর পাশাপাশি বিবিসি’র খ্যাতিমান সাংবাদিক আতাউস সামাদ এর সহকারী হিসেবে কাজ করছি।
একদিন গভীর রাতে সামাদ ভাই গ্রেফতার হলেন। আন্দোলন তুঙ্গে থাকায় ঐসময় লন্ডন থেকে বিবিসি’র ডমেস্টিক সার্ভিসের সাংবাদিক ফীল জোন্স ঢাকায় এসেছেন।
সামাদ ভাই কারাগারে থাকায় আমি টেলিফোনে ফীল জোন্সকে নিউজ দিতাম। একদিন বিকেলে তাকে বল্লাম, আজ নিউজ করার মতো তেমন কিছু ঘটেনি। শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু এ্যাভেনিউতে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে একটি ছোটখাটো পথসভা হয়েছে। ফীল জোন্স জানতে চাইলে আমি বল্লাম, সভায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, “এরশাদকে শুধু ক্ষমতা ছাড়লেই চলবেনা, তাকে দেশ ছাড়তে হবে”। ঢাকার কোন কাগজে পরের দিন কেউ এই নিউজটি কভার করেনি। ঐ সময় সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক নেতা আনোয়ার জাহিদ ছিলেন এরশাদ সরকারের তথ্যমন্ত্রী। তিনি ফীল জোন্সকে সচিবালয়ে তলব করে বল্লেন, দেশী- বিদেশী কোন পত্রিকায় এবং নিউজ এজেন্সীতে বিরোধীদল এরশাদকে দেশ ছাড়তে হবে বলে দাবী করেছে মর্মে কোন নিউজ নেই। তুমি এই নিউজ কোথায় পেলে?
সচিবালয় থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ক্যন্টিনে ফিরে এসে ফীল জোন্স আমাকে জিঙ্গেস করলেন, গতকাল নাসিমের বক্তৃতা শুনেছে এমন কোন রিপোর্টার এখানে আছে? আমি অন্য এক টেবিলে বসা সিনিয়র সাংবাদিক আতিকুর রহমানকে দেখিয়ে দিলে ফীল জোন্স আতিক ভাইয়ের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হলেন যে, আমি তাকে কোন ভুল তথ্য দেই নি। দৈনিক পূর্বদেশ এবং অবজারভারের সাবেক সিনিয়র রিপোর্টার আতিকুর রহমান তখন দৈনিক আজাদীর ঢাকা ব্যুরো চীফ ছিলেন।
প্রেস ক্লাব খেকে শেরাটন হোটেলে ফেরার পথে আমি ফীল জোন্সকে বল্লাম, তুমি যদি এরশাদকে দেশ ছাড়তে হবে বলে বিরোধী দল দাবী করছে না, শুধু আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাসিম দাবী করেছেন বলে নিউজ করতে তাহলে এতো ঝামেলা হতোনা।
ফীল জোন্স আমাকে পাল্টা বল্লো, নাসিম তো আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং আওয়ামী লীগ তো বিরোধী দল? তাই যদি হয়, তাহলে এটা নিয়ে আর কিছু ভেবোনা, আমার নিউজ ঠিক আছে। নাসিম যদি এই বক্তব্য আবার দেন তাহলে আমি আবার নিউজ করবো যে এরশাদকে দেশ ছাড়তে হবে বলে বিরোধী দল দাবী করছে।
রাতে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় নাসিম ভাইকে টেলিফোন করে সব জানালাম। নাসিম ভাই ঐসময় আওায়ামী লীগ নেতা রাজিউদ্দিন আহমেদ এর বাসায় ছিলেন। সাবেক মন্ত্রী রজিউদ্দিন বর্তমানে নরসিংদী জেলার রায়পুরা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
নাসিম ভাই উৎসাহের সাথে বল্লেন, আমি আবার এই একই বক্তব্য দিব। প্রয়োজন হলে বিবিসি’র সাংবাদিকের কাছে ইন্টারভিউ দিব।
কিন্তু নাসিম ভাইয়ের বক্তব্য আর কভার করার সুযোগ পাননি ফীল জোন্স। পরের দিনই জেনারেল এরশাদ সরকারের পুলিশ বাহিনী তাকে শেরাটন হোটেল থেকে সরাসরি বিমান বন্দরে নিয়ে লন্ডনগামী বিমানে তোলে দেয়।
রিপোর্ট লেখার জন্য ফীল জোন্স আমার মিনি টাইপ রাইটারটি ব্যবহার করছিলেন। ডিপোর্ট করার সময় পুলিশ তাকে টেলিফোন করার সময়ও দেয়নি । তাই তিনি আমার নাম লিখে টাইপ রাইটারটি শেরাটন হোটেলের রিসিপশনে রেখে গিয়েছিলেন।
ফীল জোন্স যখন তখ্যমন্ত্রী আনোয়ার জাহিদের সাথে কথা বলছিলেন, তখন এপি’র তৎকালীন ঢাকা ব্যুরো চীফ হাসান সাইয়িদ এবং ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি সৈয়দ কামাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। এই দুজন সিনিয়র সাংবাদিক তখন আমাকে সাবধানে থাকার জন্য সতর্ক করে দিয়েছিলেন।
লন্ডন, ৯ই জুন, ২০২০
(আবু মুসা হাসান: উপদেষ্টা সম্পাদক, সত্যবাণী)