শুভ ১৪৩০: ঐতিহ্যে উজ্জ্বল বাঙালীর অসাম্প্রদায়িক উৎসব পয়লা বৈশাখ
মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য -‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’
সত্য–সুন্দরকে পাওয়ার অভিলাষী ছায়ানটের আহবান – ‘দূর করো অতীতের সকল আবর্জনা, ধর নির্ভয় গান’
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
নতুনের কেতন ওড়ানো বৈশাখের আগমন ঘটে নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও কর্মদ্যোমের প্রেরণা নিয়ে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে প্রবাহিত হয় সময়, বদলে যায় বর্ষপঞ্জির পাতা। নতুন বছর এসে দাঁড়ায় দোর গোড়ায়।এসেছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০। প্রাণের হিল্লোল, আবেগ, ঐতিহ্যউজ্জল বাংলা নববর্ষের প্রথম মাস বৈশাখ। হতাশা, অবসাদ, গ্লানি, অপ্রাপ্তি ঝেড়ে ফেলে নতুন উদ্দীপনায় জাগরণের ডাক দেয় নববর্ষের প্রথমদিন – পয়লা বৈশাখ। তাইতো বিশ্বকবি বলেছেন–
”এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/ তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক…/
“মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে–যাক জরা, অগ্নি¯স্নানে শুচি হোক ধরা।”
বছরের আবর্জনা দূর করে নতুন উদ্যমে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে প্রগতির পথে সামনে এগোনোর অঙ্গীকারে উদ্দীপিত হয় নববর্ষ। সঙ্কট, কুপমন্ডূকতা, দৈন্য, অজ্ঞতা, কুসংস্কার, হিংসা–বিদ্বেষ, সন্ত্রাস, হানাহানি, সাম্প্রদায়িকতা দূর করে অগ্নিস্নানে শুচি হওয়ার দীক্ষাও প্রেরণা দেয় বাংলা নববর্ষ।
বছরের সবকটি দিনের মধ্যে একটি বা দুটি দিন বিশেষ মর্যাদা পায়, সেগুলো যেন চির পুরাতনের মধ্যে নতুন করে দেখা দেয়। এরকম একটি দিন হচ্ছে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। বর্তমানে পয়লা বৈশাখের উৎসব একটি জাতীয় উৎসব। পয়লা বৈশাখের উৎসবের অঙ্গীকার হচ্ছে আমাদের জীবন বোধের অঙ্গীকার।
মঙ্গল শোভাযাত্রা ওমুখোশের ব্যবহার
কৃষিভিত্তিক সমাজে কৃষকেরা কর, খাজনা প্রভৃতি নিয়ে জমিদারদের দ্বারা নানাভাবে নিপীড়িত হতো। কর প্রথা বিলুপ্তির পর সমাজে মঙ্গলবিনাশী শত্রু দমনের উদ্দেশ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হতো। এই শোভাযাত্রায় নানারকম পশুপাখি ও বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্রের উপস্থাপন করা হয়। যা সমাজের অসঙ্গতিসহ নানা দিক তুলে ধরে।
বর্তমানে পয়লা বৈশাখের উৎসবের একটি অনুষঙ্গ হলো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ওশিক্ষকদের সহযোগীতায় পয়লা বৈশাখে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়, তা এবার ৩৪ বছরে পা দিল। অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। বর্তমানে মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে পরিচিত। শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরনের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতি জেলা সদরে আয়োজিত হওয়ায় মঙ্গল শোভাযাত্রা নবতর সার্বজনীন সংস্কৃতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
করোনা মহামারির রেশ না কাটতেই যুদ্ধবিগ্রহের জেরে বিপর্যস্ত পুরোবিশ্ব। তাই এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রায় প্রতিপাদ্য হলো -‘বরিষধরা–মাঝে শান্তির বারি‘। যুদ্ধ নয়, শান্তির পৃথিবীর প্রত্যাশার বার্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পঙক্তি থেকে এ প্রতিপাদ্য নেয়া হয়েছে। শোভাযাত্রায় থাকবে ‘মায়ের কোলে সন্তান‘ এর মাঝে বুঝানো হয়েছে মায়ের কোলে যেমন সন্তান নিরাপদ, তেমনি এই পৃথিবী প্রতিটি মানুষের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠুক। ইতোমধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে, দুঃখজনক হলো ধর্মান্ধতা বার বার বাঙালী সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। এবারেও মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে আইনী নোটিশ দিয়েছে এক উকিল।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতিঃ
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ সালের নভেম্বরে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ওবিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘ইনটেনজিবল হেরিটেজ‘ তালিকায় স্থান লাভ করে।
পাকিস্তান আমলে প্রতিবাদঃ
তৎকালীন পাকিস্তান আমলে যখন বাঙালীর ভাষা ও সংস্কৃতির উপর একের পর এক আঘাত হানতে থাকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী, তখন অনেকটা প্রতিবাদ হিসাবেই সংস্কৃতিমনা সচেতন বাঙালী নববর্ষ বরণের প্রস্তুতি নেয়। ১৯৬৭ থেকে আজ পর্যন্ত এ অনুষ্ঠান অব্যাহত আছে। আর এখন তো বাংলা নববর্ষ আমাদের জাতীয় উৎসব। অনেক উৎসবের ভিড়ে নববর্ষের স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে বাঙালী জাতির একান্ত নিজস্ব অসাম্প্রদায়িক উৎসব এটি।
বিভিন্ন দেশে নববর্ষঃ
বহু প্রাচীনকাল থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নববর্ষ উদযাপিত হয় সাড়ম্বরে। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দেও মেসোপটেমিয়ায় নববর্ষ পালিত হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে জুলিয়াস সীজারের সময় থেকে ইউরোপে নববর্ষ পালিত হচ্ছে জানুয়ারী মাসে। চীন ও জাপানেও নববর্ষ পালনের রীতি প্রচলিত আছে প্রাচীনকাল থেকেই। ইরানের নওরোজ(নববর্ষ) শুধু খুশিরই দিন ছিলনা, এদিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তরুণ সমাজের কাছে। এ দিন তরুণ–তরুণীরা বেছে নিত যার যার জীবন সঙ্গী।
জ্ঞান–বিজ্ঞানের যখন এত প্রসার ঘটেনি, যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই মন্থরগতির, তখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ নিজস্ব দিন–মাস বছর গোনার পদ্ধতি তৈরি করেছিল। প্রাচীনকালে যাদের জ্ঞানচর্চার অভ্যাস গড়ে উঠেছিল, যাদের অর্থনীতি ছিল ক্রমবর্ধিষ্ণ, তারাই প্রয়োজনের তাগিদে দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং রাজকার্যের সুবিধার জন্য তৈরি করেছিল পঞ্জিকা।
বাংলা নববর্ষের গৌরবময় ইতিহাসঃ
বৈশাখ হচ্ছে বাংলা বছর গণনায় বছরের প্রথম মাস। বাংলা সালতথা বঙ্গাব্দ প্রচলনের আছে গৌরবময় ইতিহাস। বাংলা সনকে কেউ বলেন ফসলী সন বা এলাহী সন, কেউ বলেন বঙ্গাব্ধ। মোগল সম্রাট মহামতি আকবরের শাসনামলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলা সন। সে সময় মোগল সাম্রাজ্যে প্রচলন ছিল বিভিন্ন সনের। যেমন – লণাব্দ, বিক্রমাব্দ, শালিবাহন সন, জালালি সন, সেকান্দর সন, শকাব্দ, গুপ্তাব্দ প্রভৃতি। এই সঙ্কট নিরসনে সম্রাট আকবর সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাজস্ব মন্ত্রী আবুল ফজলের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি ফসলি সন প্রবর্তনের দায়িত্ব অর্পন করেন রাজ সভাষদ আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর উপর।
ফসলী খাজনাঃ
হিজরী সনের হিসাব ধরে আগে খাজনা আদায় হতো। যেহেতু সেকালে কৃষি নির্ভর সমাজ ব্যবস্থায় খাজনা আদায়ের সঙ্গে কৃষকের ফসলের সংযোগ ছিল, তাই কররূপা দেয় ফসলের অংশ ‘ফসলী খাজনা’ হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু হিজরী সনের সঙ্গে ফসল তোলার সময়ের ১২ দিনের একটি গোলমাল প্রতিবছরই খাজনা আদায় করতে গিয়ে বিবাদ লেগেই থাকতো। তাই সম্রাট আকবর হিজরী সন থেকে ১২ দিন ছেঁটে যে বৎসর গণনা শুরু করেন, তাই কালক্রমে ফসলী সন বা বঙ্গাব্দ হিসেবে খ্যাত হয়।
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল থেকে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়, হিজরীতে তখন চলছে ৯৬৩ সাল। ৯৬৩ হিজরীতে যখন বাংলা সন শুরু করা হয়, তখন হিজরী সনের প্রথম মাস ’মহরম’ বৈশাখ মাসের সঙ্গে মিলে যায়। ফলে পহেলা বৈশাখই বাংলা নববর্ষের শুরু হিসাবে পরিচিতি হয়।
১৯৮৮ সালে পয়লা বৈশাখের তারিখ ‘নির্ধারণ‘:
বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের শাসনামল থেকে ১৪ এপ্রিলই পয়লা বৈশাখ হিসাবে নির্ধারিত হয়েছে কিন্তু কলকাতায় আগের নিয়মে চলছে পয়লা বৈশাখ। বাংলাদেশেও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অনেকে আগের পঞ্জিকার নিয়মেই পালন করে থাকে। তাই, আগের মত পঞ্জিকার নিয়মে পয়লা বৈশাখ উদযাপন হওয়া উচিত। তাহলে সকল ধর্মের মানুষ একই দিন পয়লা বৈশাখ উদযাপন করতে পারবে।
ষড় ঋতুঃ
এই উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশেই বোধহয় ছয়টি ঋতু আছে – গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত। ইউরোপের দেশগুলোতে চারটি ঋতু। বাংলাদেশের ছয়টি ঋতু দু’টি করে মাস গণনা করা হয়। বৈশাখ+জৈষ্ঠ্য=গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়+শ্রাবণ=বর্ষাকাল, ভাদ্র+আশ্বিণ=শরৎকাল, কার্তিক+অগ্রহায়ণ=হেমন্তকাল, পৌষ+মাঘ=শীতকাল, ফাল্গুন+চৈত্র=বসন্তকাল।
কিন্তু শরৎ এবং হেমন্ত এই দুটি ঋতু চার মাস থাকেনা। শরৎ যখন হেমন্তকে পথ ছেড়ে দেয় তখন পূর্ণ দু‘মাস হয়না। বসন্তকাল সবচেয়ে কম স্থায়ী। বসন্তের পাখি কোকিল যখন ডাক দেয় তখন জানা যায় বসন্ত এসেছে।
ষড়ঋতুর মধ্যে গ্রীষ্মের দাপটে বর্ষা কেঁদে ফেলে, বর্ষার অভিমান ভাঙ্গাতে শরৎ আসে কাশফুলের উপহার নিয়ে, আর হেমন্ত আনে শিশিরের গহনা। শীত ঢেকে দেয় কুয়াশার আঁচল। ক্ষণবসন্ত দখিনা বাতাসে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেয় সেই আঁচল। ঋতুরাজ গ্রীষ্ম জ্বলন্ত সন্ন্যাসীর মতো ফিরে আসে পদব্রজ শেষ করে। আর রবীন্দ্রনাথ ’বর্ষশেষ’ কবিতায় বৈশাখের মনোমুগ্ধকর রূপটি তুলে ধরেন – ’হে নতুন এসো তুমি সম্পূর্ণ গগনপূর্ণ করি পুঞ্জপুঞ্জ রূপে/ ব্যপ্তকরি লুপ্তকরি স্তরে স্তরে স্তবকে স্তবকে ঘনঘোর স্তূপে।’
যে বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণে মানুষের বিরক্তি, সে–ই ধরণীকে অমল বর্ষণে করে শস্য শালিনী। খরাদগ্ধ চৈত্রের চৌচির মৃত্তিকা যেন খুঁজে পায় বৈশাখের গুরু গুরু মেঘের হৃদয় ছেঁড়া অমল বর্ষণ। চৌচির মাটিকে বৃষ্টি পলিময় করে তোলে শষ্যে, যেন ভরে উঠে কৃষকের শূন্য আঙ্গিনা প্রান্তর। এ ঋতু চক্রের আবর্তেই সুখ–দুঃখের চক্রাকারে ফিরে ফিরে আসাকে মেনে নিয়েই নিরাশাবাদী হতে পারিনা আমরা। এজন্যই কবির সাথে সাথে আমরাও আশাবাদী ও স্বাপ্নিক।
বৈশাখ এই আশা ও স্বপ্নকে জন্ম দেয় নবজীবনের দ্বারোদ্ঘাটন করে। তাইতো প্রান্তিক কৃষক নববর্ষে সেই পুরোনো প্রার্থণাটুকু আবার করে – আগামী বছর যেন ভালো যায়। নিত্য দুঃখের তরঙ্গসঙ্কুল জীবন নদীপাড়ি দেবার জন্য বোধকরি স্বপ্নই একমাত্র ভেলা। এ স্বপ্ন একটি সুন্দর বছরের, যা অতীতের অপ্রাপ্তি আর ব্যর্থতাকে অতিক্রমে সম্ভাবনাময় উজ্জ্বলতর হবে।
রাশি থেকে বারো মাসের নামকরণঃ
বারো রাশির প্রথম রাশি’ মেষ’। মেষ রাশির পূণরালোকিত নক্ষত্র বিশাখা। এ বিশাখা থেকে বাংলার প্রথম মাস বৈশাখ। নক্ষত্রিক নিয়মে বাংলা সনের মাসগুলোর নাম। যেমন জ্যৈষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়ি থেকে আষাঢ়, শ্রাবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদা থেকে ভাদ্র, আশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কার্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রহায়ণা থেকে অগ্রহায়ণ, পৌষা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফাগুনী থেকে ফাগুন, চিত্রা থেকে চৈত্র।
সপ্তাহের নামঃ
সম্রাট আকবরের সময় মাসের প্রতিটি দিনের জন্য পৃথক পৃথক নামছিল। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এ জটিল প্রথা পরিহার করে সপ্তাহের সাত দিনে সাতটি নাম নির্ধারণ করেন। বর্তমানে ব্যবহৃত এ সাতটি নামের সাথে রোমান সাপ্তাহিক নামগুলোর সাদৃশ্য সহজেই অনুমেয়। কথিত আছে বাদশা শাহজাহানের দরবারে আগত কোন ইউরোপীয় (সম্ভবত পর্তুগীজ) মনীষীর পরামর্শক্রমে মূলত গ্রহপুঞ্জ থেকে উদ্ভুত নামগুলো হয়। ’সান’ বা সূর্য্য থেকে রবি। ’মুন’ অর্থাৎ চাঁদ থেকে সোম। ’মার্স’ বা মঙ্গল গ্রহ থেকে মঙ্গল। ’মারকারি’ বা বুধগ্রহ থেকে বুধ। ’জুপিটার’ বা বৃহস্পতি গ্রহ থেকে বৃহস্পতি। ’ভেনাস’থেকে শুক্র। ’স্টার্ণ’ বা শনি গ্রহ থেকে শনিবার।
বৈশাখকে ঘিরে উৎসবঃ
বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের গুরুত্ব নিঃশেষিত হয়ে যায়নি আমাদের সমাজ জীবনে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাস করে গ্রামে। এই জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশ কৃষক। কৃষির সাথে নিবিড় সংযোগ আছে বাংলা সনের। কৃষকের ফসল বোনা ও ঘরে ফসল তোলা হয় বাংলা মাসের হিসাবে। ঘরে ফসল তোলা হলে কৃষক মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে। ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত হয় নবান্ন উৎসব।
হালখাতা:
বৈশাখকে ঘিরে অনুষ্ঠিত হয় নানারকম আনন্দানুষ্ঠা।’হালখাতা’ উৎসব এ ধরনেরই একটি উৎসব। হালখাতা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা। সারা বছর মহাজনরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সাথে ব্যবসা–বাণিজ্য করে, এতে অনেক টাকা বকেয়া পড়ে। হালখাতা উপলক্ষ্যে বকেয়া টাকাগুলো শোধ করে দিয়ে খাতায় নতুনভাবে নাম লেখাতে হয়। সেদিন ক্রেতাদের মিষ্টি খাওয়ানোর আয়োজন করা হয়।
মেলা:
নগরজীবনের যান্ত্রিকতার মাঝেও বৈশাখী মেলা স্মরণ করিয়ে দেয় আমাদের পরিচয়। নতুন বছর আগমনের বেশ কিছু সময় আগ থেকেই গ্রামবাংলায় শুরু হয় উৎসবের পালা। দোল, অষ্টমী, নবমী, বারণী, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, চরক পূজার ধারাবাহিক উৎসবের মাঝেই এসে পড়ে নববর্ষ। চৈত্রের শেষ দিনটিতে হয় চৈত্রসংক্রান্তির উৎসব। গ্রাম–গঞ্জে বসে মেলা। হিন্দু ধর্মাবলাম্বীরা চৈত্রসংক্রান্তির দিন চরকপূজা করে।
মেলার উৎপত্তি
বাঙালি জাতির নিজ ঐতিহ্যের মধ্যে গ্রামীণ মেলা অন্যতম। এসব গ্রামীণ মেলার উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী বিদ্যমান। প্রাচীন বাংলার নৌ–বন্দরগুলোতে কৃষিজ পণ্যের সমারোহ এবং বিনিময় পর্যায় থেকে এ মেলার উৎপত্তি ঘটে। পরবর্তীতে মানুষ তার জীবন–জীবিকার তাগিদে হস্তশিল্পজাত পণ্যের উৎপাদন, পণ্য বিনিময়ের জন্য মেলায় আসে। তবে জমিদারি আমলে খাজনা আদায়কে আনুষ্ঠানিক রূপ দেবার জন্য জমিদার এবং প্রজারা মিলে বিশেষ ঐতিহ্যের সাথে বৈশাখি মেলা পালন করতো।
গ্রামাঞ্চলের মেলায় শৌখিন দ্রব্যাদির তুলনায় নিত্য ব্যবহার্য সম্ভার থাকে বেশী। মেলা যে শুধু বেচাকেনার বাজার তাই নয়, সেখানে নানারকমের আমোদ–প্রমোদের ব্যবস্থা থাকে। এককালে গ্রামীণ মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল লাঠি খেলা, হা–ডু–ডু, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের লড়াই ইত্যাদি। মেলায় যাত্রা ও পালা গানের ব্যবস্থা থাকে। নানাধরনের মিষ্টি, গুড়ের জিলাপী সন্দেশ, বাতাসা, মুড়ি–মুড়কি, গুড়–চিড়া–দই বিক্রি হয়।
বৈশাখের সাজঃ
বাহুতে জড়ানো লাল পাড়ে সাদা শাড়ী, চুলের বেণীতে ঠাঁই নেয় বেলীফুলের থোকা। কপালের মধ্যবিন্দুতে টুকটুকে লাল টিপ। কর্ণে রুপোর কুন্দন। হাতে লাল আর রূপালী রঙের চুড়িপড়া বাঙালী নারী পহেলা বৈশাখের উৎসবে নিয়ে আসে ভিন্ন একব্যঞ্জনা। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে নগরীর বুটিক হাউসগুলোর থাকে বিচিত্র আয়োজন। পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শাড়ি, টি–শার্টে কারা কত বৈচিত্রআনতে পারে এ নিয়ে চলে তীব্র প্রতিযোগিতা। নববর্ষের আজকের যেরূপ, এর নেপথ্যে আছে ছায়ানট, উদিচীসহ বাঙালী সংস্কৃতি লালনকারী অসংখ্য সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। এক্ষেত্রে চারুকলার শিক্ষার্থীদের উদ্যোগ ও ভালবাসা অনুষ্ঠানকে করে আরো উজ্জ্বল।এবারের নববর্ষের প্রথম প্রভাতে সত্য–সুন্দরকে পাওয়ার অভিলাষী ছায়ানটের আহবান –দূর করো অতীতের সকল আবর্জনা, ধর নির্ভয় গান।
তবে, আমাদের জীবনে আনন্দের উৎসগুলো ক্রমশঃ সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। প্রায় বাইশ বছর আগে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় অনেক তাজা প্রাণ ঝরেছে, তা আজো আমাদের কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে।
প্রবাসেও বাদ যায়না বৈশাখের আনন্দ। বৈশাখী ঝড়ের মতই এই দিনটি সব মালিন্য দূর করে আমাদের অস্তিত্বে ঝাকুনি দিয়ে মনে করিয়ে দেয় কোথায় প্রোথিত আছে আমাদের শিকড়।
বাংলা ১৪৩০ সালের প্রত্যাশা – নতুন এই বছরটি সুন্দর হোক, শুভহোক, সবার জন্য হোক আনন্দময় ও কল্যাণকর।
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান: সাংবাদিক, বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী।