স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ
আবু মুসা হাসান
আজ থেকে ৫০ বছর আগের কথা, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা শহরের সাতই মার্চের ঘটনার কথা স্মৃতির আয়নায় এখনও জ্বলজ্বল করছে। কারন এই স্মৃতি যে ভোলার নয়। এমন ঘটনাতো দ্বিতীয়বার আর ঘটবেনা।
একাত্তরের সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার তৎকালীন রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরায়ার্দী উদ্যান) লাখো মানুষের জনসমুদ্রে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।‘ শুধুমাত্র স্বাধীনতার ঘোষণাই নয়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐ জ্বালাময়ী ভাষণে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে আমাদের প্রাণপ্রিয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
তবে, এই লেখায় স্মৃতির আয়না থেকে ঐতিহাসিক জনসভায় আমার সক্রিয় উপস্থিতি, ‘৭১ এর অগ্নিঝরা সাতই মার্চের পটভূমি এবং সেইদিনের জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এর কিছু চিত্র তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক এগারো দফা আন্দোলন এবং ‘৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানের পর পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটে। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের মতিয়া গ্রুপ ও মেনন গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। পরবর্তীতে মাহবুবুল হক দোলন এবং নাজিম কামরানের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন (এনএসএফ) -এর একটি অংশ এগারো দফা ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এনএসএফ ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আইয়ুব-মোনায়েমের পেটুয়া বাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনএসএফ-এর পাস-পার্ট-টু নামে পরিচিত সাইদুর রহমান এবং খোকাদের দৌরাত্বের কথা ঐ সময়ের সবারই জানা আছে। মোনায়েম খানের নির্দেশনায় এরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংগঠনগুলোর আন্দোলনকে দমানোর প্রচেষ্টা চালাতো। মোনায়েম খান ছিল আইয়ুব খান কর্তৃক মনোনিত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর।
মোনায়েম খান সম্পর্কে একটা মজার কথা প্রচলিত ছিল আমাদের কালে। বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আগ্রাসন চালাতে গিয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। ঐ সময় মোনায়েম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল হাইকে ডেকে বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রবীন্দ্র সংগীত বাদ দিয়ে আপনারা রবীন্দ্র সংগীত লিখতে পারেন না? জবাবে অধ্যাপক আবদুল হাই বলেছিলেন, আমি লিখলে ত‘ এটা রবীন্দ্র সংগীত হবেনা, ‘হাই‘ সংগীত হয়ে যাবে।
গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র জনতার দুর্বার আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা‘ প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্তিপাগল বাঙালির বাঁধভাঙ্গা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু অতি দ্রুত বাঙালির একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। ইতোপূর্বে স্বায়ত্ব শাসন আদায়ের লক্ষ্যে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বাঙালির জনপ্রিয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। ঐ সংবর্ধনায় ১১-দফা ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ সভাপতি তোফায়েল আহমদ জননন্দিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু‘ উপাধিতে ভূষিত করেন।
স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতনের পর সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন দিতে বাধ্য হলো। ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হলো। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বেশী ছিল। ‘৭০ এর নির্বাচনের জন্য মোট পাঁচ কোটি ৬৯ লাখ ৪১ হাজার ৫০০ জন ভোটারের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ভোটার সংখ্যা ছিল তিন কোটি ১২ লাখ ১১হাজার ২২০ জন আর পশ্চিম পাকিস্তানের চার প্রদেশ- পাঞ্জাব, সিন্ধ, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমানে খাইবার পাকতুনখাওয়া প্রদেশ ) ও বেলুচিস্তান- মিলিয়ে মোট ভোটার ছিল দুই কোটি ৫৭ লাখ ৩০ হাজার ২৮০ জন। সামরিক শাসনের অধীনে একটি লীগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এল এফ ও) এর আওতায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করেন। এই বিচারপতি সাত্তারই বিএনপি শাসনামলে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের চার প্রদেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে অনেক বেশী ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা। তাই এক ব্যাক্তির এক ভোট নীতিমালার ভিত্তিতে আসন নির্ধারিত হওয়ায় পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের মোট তিনশ‘ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৬২টি আসন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ধারণা করেছিল যে, মুসলীম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পিডিপির মত দলগুলোর তথাকথিত ‘জনপ্রিয়তার‘ ফলে আওয়ামী লীগ মনোনিত প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবেনা। কিন্তু তাদের হিসেব-নিকেষের সাথে বাস্তবের কোন মিলই ছিলনা।
মুক্তি পাবার নেশায় বিভোর বাঙালি জাতি যে বঙ্গবন্ধুকে তাদের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিল তা তারা আন্দাজই করতে পারেনি। তারা ভাবতেই পারেনি যে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নৌকা মার্কা ছাড়া অন্য কোন মার্কা গ্রহণ করবেনা। তাই নির্বাচনের ফলাফলে চমকে উঠলো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা। সরাসরি নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত মোট ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনেই বঙ্গবন্ধু মনোনিত আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হন। অবশিষ্ট দুটি আসনের একটিতে পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (পিডিপি) নূরুল আমীন ময়মনসিংহ থেকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী চাকমা রাজা ত্রিদীব রায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় এই নূরুল আমীনই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের চীফ মিনিষ্টার। নুরুল আমীন চীফ মিনিষ্টার থাকাকালেই ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে পুলিশ গুলি চালিয়ে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর ও জব্বারদের হত্যা করে ভাষা আন্দোলনকে দমাতে চেয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চালানোর জন্য এই নরুল আমীনকেই দায়ী করা হতো। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাত ফেরীতে অনেক শ্লোগানের মধ্যে একটি জনপ্রিয় শ্লোগান ছিল, ‘নূরুল আমীনের কল্লা চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই‘। কৈশরে আমরাও একুশের মিছিলে এই শ্লোগান দিয়েছি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরায়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলীম লীগের ভরাডুবি ঘটলে নূরুল আমীন ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তানেই থেকে যান নূরুল আমীন। এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক নিয়োজিত হয়ে তিনি ১৩ দিনের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ও স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে থেকে যান। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনায় পাকিস্তানের রাষ্টদূত ছিলেন।
সেই যা-ই হোক, ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু দেশে-বিদেশে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃত হন। কিন্তু নির্বাচনের পর পরই পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকদের আসল চরিত্র প্রকাশ পায়। তারা ছলে-বলে এবং কৌশলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে।
‘৭১-এর ৩রা মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের স্থানটিতে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সংসদ ভবন। শেরেবাংলা নগরকে তখন বলা হতো সেকেন্ড ক্যাপিটেল। অর্থাৎ পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাজধানী। তখন এই সেকেন্ড ক্যাপিটেলেই শুরু হয়েছিল বর্তমান জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ কাজ।
পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জাতীয় পরিষদের মাত্র ৮১টি আসনে জয়লাভ করলেও জুলফিকার আলী ভূট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র ও দৌড়-ঝাপ শুরু করলো। ভূট্টো বাধ সাধলেন যে, তারা পূর্ব পাকিস্তানে এসে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবেনা। কিন্তু এসবই চলছিল বাঙালির হাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর না করার গভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবে। তারই ফলশ্রুতিতে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে পহেলা মার্চ দুপুরে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের ৩রা মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দেন। দুপুর ১২টায় রেডিও পাকিস্তানের বাংলা সংবাদ বুলেটিনে ইয়াহিয়া খানের এই ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর ফুঁসে উঠে সমগ্র বাঙালি জাতি।
আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে মিছিলে সমগ্র ঢাকা শহর কেঁপে উঠে।
ঐদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী মেরিলীবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) টীমের সাথে পাকিস্তান দলের টেস্ট ক্রিকেট খেলা চলছিল। রাজপথের বিক্ষোভের ছোঁয়া স্টেডিয়ামে গিয়ে পৌঁছে, গ্যালারী মুখরিত হয়ে উঠে জয়বাংলা শ্লোগানে। পুরো গ্যালারী জুড়ে প্রচন্ড বিক্ষোভের মধ্যে খেলা পন্ড হয়ে যায়। ঐ ম্যাচে একমাত্র বাঙালি খেলোয়াড় রকিবুল হাসান তার ব্যাটে ‘জয়বাংলা‘ স্টীকার লাগিয়ে মাঠে খেলতে নেমেছিলেন। রকিবুল আমার ঢাকা কলেজের বন্ধু। রকিবুলকে নিয়ে আমরা সহপাঠীরা সব সময় গর্ব করতাম। প্রসঙ্গত, পাকিস্তান আমলে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যের মত খেলাধুলার অঙ্গনেও বাঙালি বৈষম্যের শিকার হতো। পাকিস্তানের ক্রিকেট টীমে বাঙালি খেলোয়াড়দের স্থান হতো না। পাকিস্তানিরা বলতো, বাঙালিরা ক্রিকেট খেলবে কিভাবে? ব্যাটই ধরতে জানেনা।
এদিকে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র পরিষ্কার হয়ে গেলে সমগ্র দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এই অবস্থায় বাঙালি জাতিকে দিক-নির্দেশনা দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু সাতই মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহ্বান করলেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মুক্তিপাগল বাঙালি সমবেত হলো রেসকোর্স ময়দানে।
ঐসময় পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর কট্টর সমর্থক ছাড়া আপামর জনগণ এক কাতারে শামিল হয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দিকনির্দেশনা পাওয়ার জন্য দলে দলে রেসকোর্স ময়দানে ছুটে এসেছিল। যেমন, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আমি ও আমার বন্ধুরা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মুজাফফর) প্রার্থীদের জন্য কাজ করেছিলাম। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ঢাকায় ন্যাপের দুজন প্রার্থী ছিলেন। একজন পুরনো ঢাকার সর্দার আব্দুল হালিম এবং অপর জন সাংবাদিক সাহিত্যিক খোন্দকার ইলিয়াস। ন্যাপের নির্বাচনী প্রতীক ছিল কুঁড়ে ঘর। আমরা ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ন্যাপের এই দুজন প্রার্থীর জন্যই কাজ করেছিলাম। তবে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আমরা লালবাগ-রমনা এলাকার প্রার্থী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে কাজ করেছি। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে প্রার্থী ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা ঢাকার নবাব বাড়ীর খাজা খয়ের উদ্দিন। বলাবাহুল্য, ‘৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার পক্ষে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তাতে ন্যাপের প্রার্থীদের জয়লাভের কোন সম্ভাবনাই ছিলনা। এই গণজোয়ার এতই প্রবল ছিল যে, নির্বাচনে জামানত হারিয়ে ন্যাপ প্রার্থী খোন্দকার ইলিয়াস নির্বাচনের পরের দিনই ন্যাপ ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই ন্যাপের প্রার্থীরা হেরে যান। তবে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে সুনামগঞ্জের ভাটি অঞ্চল থেকে ন্যাপ মনোনীত প্রার্থী প্রয়াত সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত জয়লাভ করেছিলেন। এই এলাকাটি ছিল বামপন্থীদের ঘাঁটি এবং ‘৫৪ সালের নির্বাচনে এই এলাকা খেকেই প্রয়াত কমিউনিস্ট নেতা বরুণ রায় জয়লাভ করেছিলেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই আসন থেকে বহুবার জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েছেন। বামপন্থী রাজনীতির ভাঙ্গা-গড়ার প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ছিলেন।
সত্তর-এর নির্বাচনের এই চিত্র তুলে ধরেছি এই জন্য যে, সাতই মার্চের জনসভায় যোগদানের প্রশ্নে আমাদের মধ্যে কোন বিভাজন ছিলনা। সাতই মার্চ আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে লাখো জনতার কাতারে সমবেত হয়েছিলাম। ঢাকা শহর এবং আশে-পাশের জেলাগুলো থেকে হাজার হাজার মানুষ মারমুখি মিছিল করে রেসকোর্স ময়দানে জড়ো হয়েছিলো। অধিকাংশ মিছিলকারীদের হাতেই ছিল বাঁশের লাঠি। আমরা আজিমপুর নতুন পল্টন লাইন থেকে একটি বর্শা মিছিল নিয়ে গিয়েছিলাম।
এই বর্শা মিছিল কিভাবে এবং কেন করেছিলাম, তা না বলে পারছিনা। ৭ই মার্চের আগে পাড়ার বন্ধুরা মিলে মিছিল করে রমনা মাঠে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। ঐ সময় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রয়াত সেলিম (ফারুখ) নতুন পল্টন লাইনের ইরাকী কবরস্থানের পূর্বদিকের বিশাল লোহার গেটের লম্বা বর্শাকৃতির রডগুলোকে কেটে নেয়ার প্রস্তাব দিলে আমরা সবাই তার প্রস্তাব লুফে নিলাম।
সেলিম শুধু আমার পাড়ার বন্ধুই ছিলনা। আমরা একসাথে গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুল ও ঢাকা কলেজে পড়েছি এবং ১৯৭০ সালে এক সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। সেও আমার মত ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিল। ৬ মার্চ নিউমার্কেট থেকে হ্যাক্সো ব্লেড কিনে আমরা গভীর রাতে বর্শাকৃতির রডগুলোকে অনেক কষ্ট করে কাটলাম। এই কাজে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী আমার বন্ধু হারুন। আরও ছিল বন্ধু মতি, মেহেদী, শাহীন, বাবলু, ফোয়াদ প্রমুখ।
৭ই মার্চ বর্শাফলকগুলো নিয়ে আমরা যখন মিছিল নিয়ে রমনা মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন রাস্তার দু‘দিক থেকে সবাই আমাদের বেশ বাহাবা দিচ্ছিল এবং আমাদের মিছিলে শামিল হচ্ছিল। পথে দেখা হয়েছিল জিঞ্জিরা থেকে আগত একটি বিশাল মিছিলের সাথে, তাদের হাতে ছিল নৌকার বৈঠা। আমাদের মিছিল যত অগ্রসর হচ্ছিল, মিছিলের কলেবরও তত বড় হচ্ছিল। কারন তখন সবারই গন্তব্য ছিল রমনা মাঠ।
পাকিস্তানি চর এবং সমর্থকরা ৭ই মার্চের আগে প্রচার করেছিল যে, রমনা মাঠে বঙ্গবন্ধুর জনসভায় হামলা চালানো হবে। হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগানের গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানো হবে। কিন্তু জনগণ ঐসব হুমকি বা গুজবে ভ্রুক্ষেপ করেনি, বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দিক নির্দেশনা পাওয়ার জন্য পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছিল রমনা মাঠের দিকে। অবশেষে আমরা যখন রমনার রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে পৌঁছলাম তখন প্রকৃত অর্থেই এটি জনসমুদ্র। রমনা কালীবাড়ী ছাড়িয়ে গিয়েছিল জনতার ঢল। কানায় কানায় ভরে উঠেছিল রেসকোর্স ময়দান। মুহুর্মুহু জয়বাংলা শ্লোগানে রমনার আকাশ কেঁপে উঠছিল। এখন ভাবতে অবাক লাগে, ঐ সময়ের ঢাকা শহরের যে পরিমান লোকসংখ্যা ছিল তাতে করে এতো মানুষ কিভাবে রমনা মাঠে সমবেত হয়েছিল। আর দেশের অন্যান্য জেলা থেকে দলে দলে যে লোকজন আসবে তারও উপায় ছিলনা, তখন ত‘ এখনকার মতো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলনা, ছিলনা এতো যানবাহন। আসলে ঢাকা শহরের লোকজন ঐদিন ঘরে ছিলনা এবং ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলো থেকে মুক্তিপাগল লোকজন দলে দলে পায়ে হেঁটেই রমনা মাঠে হাজির হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন প্রতিটি মুহূর্তেই মনে হয়েছিল একটি জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে ভাসতে ছিলাম। ভাষণের প্রতিটি শব্দই ছিল এক একটি স্ফুলিঙ্গ। ভাষনে উজ্জেবিত জনতা শ্লোগানের পর শ্লোগান আর বাঁশের লঠি উঁচিয়ে সমর্থন জানাচ্ছিল। ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো‘, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো‘ প্রভৃতি শ্লোগানে কাঁপিয়ে তোলে রমনা মাঠ।
আমার এই লেখায় ৭ই মার্চের ভাষনের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ না করলেও নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ঐ ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ওপর তাঁর পুরো নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন। একাত্তরের ৭ই মার্চের ভাষনেই তিনি ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করলেন, যা সমগ্র জাতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলোর আহ্বান জানিয়ে, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন বঙ্গবন্ধু।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে তিনি তার ভাষণের ইতি টানলেন। তাই প্রকৃত অর্থে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণই ছিল আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। তার এই ভাষণে উজ্জেবিত দেশবাসী সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা পেয়ে শুরু করলো মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। আমরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে ডামি রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম।
তাই ত‘ একাত্তরের ২৫শে মার্চ রাতের আঁধারে পাকিস্তানি সামরিক বাহনী অতর্কিতে আক্রমন চালিয়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালালে বীর বাঙালি দিশেহারা না হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এবং কালক্ষেপণ না করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করতে সক্ষম হয়।
আমরা ২৫শে মার্চ রাতে ইপিআর গেইটের সামনে গাছ কেটে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিলাম। এবং পরবর্তিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি।
লন্ডন, ৭ মার্চ, ২০২১
আবু মুসা হাসান: মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক। উপদেষ্টা সম্পাদক, সত্যবাণী