মাতাল বাঁশি
হামিদ মোহাম্মদ
(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)
(উৎসর্গ: অসাম্প্রদায়িক মাতৃভূমি নির্মাণের উদ্দেশ্যে)
॥ তিন॥
আমি দেশে যাওয়ার আগে আমার বর নাফিস মাহমুদ-এর সাথে কথা হয় যে, আমার হাসপতাল চালু করার পর সে দেশে যাবে। সে দেশে গিয়ে বসে থাকতে পারবে না, চাকরি একটা করতেই হবে। সেই কথা অনুযায়ী সে দেশে গেছে হাসপাতাল চালু করার দু’মাস পর।
দেশে গিয়েই মাহমুদ নাফিস কোন জব করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। গ্রাম ভাল লাগলেও, বাংলাদেশের গ্রাম তার মত ম্যানেজমেন্টে পড়ুয়া যুবককে চাকরি দিতে প্রস্তুত হয়নি এখনো। শহরেই যেতে হবে, যেখানে বর্তমানে প্রতিটি শহরে বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান, গার্মেণ্টস থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাদিসহ নানা কর্মযজ্ঞ কম নয়। বিলেতফেরত এরকম চৌকস যুবক বাংলাদেশে কর্মরত যে কোন বিদেশী প্রতিষ্ঠানের জন্যও আকর্ষণীয়। দেশে কারো সাথে যে একেবারেই যোগযোগ করা হয়নি, তা নয়–অনেকের সাথে যোগাযোগ ও নানা আশার কথা শুনেই আমার মত তারও দেশে আসা। দেশে বিশাল ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে, যেটাকে উন্নয়ন দূত বলা হচ্ছে, দেশ নাফিস মাহমুদদের মত যুবককে চায়, এদের প্রয়োজন তৈরি হয়েছে দেশের আভ্যন্তরীন নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড।
তবে নাফিসের চাকরি খোঁজার আগে আমার হাসপাতালের সংকট সমাধান জরুরি হয়ে পড়ে। নাফিস দেশে আসার পর একদিন আমি এবং নাফিস গেলাম খাদিমনগর ললিতা আন্টির খোঁজে তার নার্সিং হোমে। মা’র দেয়া ফোনে যোগাযোগ করেই যাওয়া। নার্সিং হোমটা আমাদের শহরের বাড়ি দেবপুরের ‘শ্রাবণী’ থেকে খুব এটা দূরে নয়। শহরের পূর্ব প্রান্তে চার/পাঁচ মাইল হবে।
বাবা আমাকে একটি লাল রঙের টয়োটা গাড়ি কিনে দিয়ে লন্ডনে চলে যান, যে দিন নাফিস দেশে আসে এর চারদিন পর। গ্রামের বাড়ি বা আমার হাসপাতালে যেতে গাড়ি ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়। গাড়ি ছাড়া হয় গ্রামে থাকতে হবে, নয় শহরে থাকতে হবে, এই অবস্থা। একমাত্র আশা, ছোট হলেও যাওয়া-আসার পাকা নড়বড়ে ভাঙাচোরা রাস্তা আছে। বেশ কয়েকটি এলজিডিই’র সরু রাস্তা শ্যামগঞ্জকে যুক্ত করেছে বড় রাস্তার সাথে। আমি এই গাড়ি চালিয়েই শ্যামগঞ্জ যাওয়া আসা করি। বাস করি শহরে, দাদার সময়ে অর্থাৎ দাদা বেঁচে থাকতে তৈরি বাড়ি ‘শ্রাবণী’তে–যা আমার বাবার হাতেই তৈরি।
এক টাকার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছি, তবে তা থেকে তো আমার নিজস্ব কোন উপার্জন নেই। সেই জন্য শহরেও একটি রোগী দেখার চেম্বার খুলেছি শহরের মধ্যস্থলে স্টেডিয়াম মাকের্টে, যেখানে পঞ্চাশেক ডাক্তারের চেম্বার ও ডজন খানেক টেস্ট করার ক্লিনিক রয়েছে–যেটি থেকে দু’আনা রোজগার হলে আমার পেট চালাতে পারি। এখানেও পাঁচ’শ বা এক হাজার টাকার বদলে ফি নিতে থাকলাম পঞ্চাশ টাকা মাত্র। বলতে গেলে অল্প। এতেও রোষানলে পড়লাম এখানের প্রতিষ্ঠিত ডাক্তারদের। আমার জন্যে এটা বা এই পরিস্থিতি কোপানলই বলতে হয়। যাহোক এটা অন্য কাহিনি।
খাদিমনগর গিয়ে নার্সিং হোমে ললিতা আন্টিকে পেলাম। তাকে ছোটবেলা আমি দেখিনি, দেখলেও মনে নেই। তাকে বিস্তারিত খুলে বললাম। তিনি নিয়মিত অন্তত নার্স বা কম্পাউন্ডার দিয়ে সহায়তার কথা বললেন, আশ্বাস দিলেন আমার চাহিদা মেটানোর। কথা প্রসঙ্গে, অদ্ভুত একটি পরামর্শ দিলেন তিনি। বললেন, এখানে রোটারী ক্লাব, রোটারেক্ট ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব, লায়নেস ক্লাব ও লিও ক্লাব রয়েছে। তারা ঔষধ কোম্পানিগুলোর নিকট থেকে বিনাপয়সায় ঔষধ পেয়ে থাকে। ঔষধগুলো বিভিন্ন এলাকায় চিকিৎসা ক্যাম্প বসিয়ে দরিদ্র রোগীদের মাঝে বিতরণ করে সংগঠনগুলো। চাইলে তোমাকে ওরা ঔষধ দিয়ে সহায়তা করতে পারে। আমি যোগাযোগ করিয়ে দেবো। আর হ্যা, এই নাও ভিজিটিং কার্ডগুলো, অনেককে পেতে পারো ফোন করে। না পেলে আমাকে বলবে, আমিও বলে দেবো তাদের সাথে দেখা হলে বা যোগাযোগ হলে।
চা-পানের পর উঠতে যাচ্ছি, এই সময় নাফিস যে কোন চাকরি খুঁজছে, বা চাকরি করতে চায়, সে সম্পর্কে সামান্য আলাপ হল। তিনি বললেন, তাদের মূল প্রতিষ্ঠানটি অনেক বড়, ঢাকার অফিসে ম্যানেজমেন্টে লোক নেবে। আন্তর্জাতিক নানা প্রোগ্রাম রয়েছে সংগঠনের। নাম ‘হিউম্যান সাপোর্ট- বাংলাদেশ’। নামটা শুনেই আমরা দু’জনও নড়েচড়ে বসি। খুব নামধাম প্রতিষ্ঠানটির। বিশ্বমাত্রিক কাজ রয়েছে এনজিও হিসেবে।
বাসায় এসে বসলাম ল্যাপটপ নিয়ে। সাইট ঘেটে পাওয়া গেল লোকনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। অনলাইনে দরখাস্ত দেয়া গেল। পনেরদিন পর ইন্টারভিউ।
বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বললাম আমি। বাবা ‘হিউম্যান সাপোর্ট-বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠানের মালিক বা প্রেসিডেন্টকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। তারা যখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি ভূমিহীনদের অধিকার নিয়ে ‘ক্ষেতমজুর সমিতি’র আন্দোলন করেন তখন এই ব্যক্তি সুনামগঞ্জের শাল্লা থানার একটি গ্রামে এই প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন। উনিশ শ বায়াত্তর সাল। সবে মাত্র দেশ স্বাধীন হয়েছে। দিরাই, শাল্লা ভাটি এলাকা। এ এলাকায় ‘জমরমা’ নামে এক প্রকার সুদের ব্যবসা যুগ যুগ ধরে চালু। এছাড়া ‘চুক্তিভাগী’ নামে ভাগচাষ আছে কৃষকদের মাঝে। কোনটাই চাষীদের জন্য ভাল বা সুখের নয়। এই পদ্ধতি কৃষকদের সর্বস্বান্ত করে ভূমিহীনে পরিণত করেই ক্ষান্ত হয় না, ঋণের জালে বেঁধে ফেলে চিরদিনের জন্য, যেখানে মুক্তি নেই। বড় কৃষকরা নিজ নিজ জমি এ সমস্ত প্রচলিত নিয়মে ভূমিহীনদের মাঝে চাষবাসের জন্য প্রদান করে বটে, ফসল হউক বা না হউক ‘চুক্তিভাগি’র ধান বা ‘জমরমা’র টাকা মালিককে পরিশোধ করতেই হবে।
এই জায়গায় বা এই জর্জরিত ভাটি অঞ্চলে তিনি বিলেতফেরত আউয়াল মুনসি পুঁজি নিয়ে আসেন, শুরু করেন সল্প সরল সুদে ‘হিউম্যান সাপোর্ট- বাংলাদেশ’ নামের সুদের ব্যবসা। সুনামগঞ্জ অঞ্চলে তখন ‘ভাসানপানি’ আন্দোলন চলছে। ‘ভাসানপানি’ আন্দোলন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আশার আলো। ইজারাদারদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। বর্ষায় হাওর-জলে মাছ ধরতে তারা বাঁধা দেয় দরিদ্র মানুষকে। একদিকে সুদের ব্যবসায় জর্জরিত, অন্য দিকে বর্ষায় মাছ ধরতে না-পারলে হত দরিদ্র মানুষগুলো খাবে কি? এই অবস্থায় ক্ষেতমজুর সমিতি গরীব লোকদের নিয়ে বর্ষার দিনে খোলা পানিতে বা ‘ভাসান পানি’তে মাছ ধরার দাবী নিয়ে আন্দোলন করছে।
আউয়াল মুনসী তার ‘হিউম্যান সাপোর্ট-বাংলাদেশ’ সংগঠন নিয়ে এই দরিদ্রদের পটিয়ে সুদ-ব্যবসা শুরু করেন। তার নিয়োজিত দালালরা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। কম লাভে টাকা-প্রদানের এবং চাষাবাদ করার নানা ভাল দিকগুলোর প্রচার করতে থাকে। এক সময় কাবু করে ফেলে দরিদ্র মানুষদের।
বাবা এই আউয়াল মুনসী নামের লোক সম্পর্কে এর চেয়ে ভয়ংকর একটি তথ্য আমাকে দিলেন আর বললেন, তুমি নাফিসকে এ সম্পর্কে ছিটেফোটাও বলিও না। সব মানুষের জীবনে অন্ধকার কিছু দিক থাকে, এরকমই এই লোকটির এই অন্ধকার জগৎটি। আমরা ‘বাত্তির তল আন্ধাইর’ এই প্রবাদটি জানি। যে অন্ধকারটি মেনে নিতে হয়। এইভাবে আউয়াল মুনসীর জীবনের এই অন্ধকার অংশটি।
আউয়াল মুনসী যখন সুদের ‘হিউম্যান সাপোর্ট-বাংলাদেশ’ নামের ব্যবসা শুরু করেন তখন পুঁজি ছিল খুব অল্প। অল্পদিনেই বুঝতে পারেন লাভের হিসেবটা অভাবনীয়, ছুটে যান লন্ডনে। লন্ডনে ছিলেন তার গার্লফেন্ড মারিয়েটা পুসেফ। তাকে বলে এসেছিলেন যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশে দরিদ্র মানুষদের জন্য কোন একটা করতে। ফিরে গিয়ে বললেন এবং বিভিন্ন নথি-নাতি দিয়ে বুঝালেন এর ব্যবসা এবং জনহিতকর দিক। মারিয়েটা খুশি হয়ে তার দুই বেডরুমের সেন্ট্রাল লন্ডনের ফ্লাটটি পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডে বিক্রি করে সমুদয় টাকা আউয়াল মুনসীর হাতে তুলে দিলেন। এই টাকা নিয়ে বড় পুঁজি দিয়ে যে ব্যবসা শুরু হয়েছিল এটিই আজকের বিশ্বমাত্রিক এনজিও প্রতিষ্ঠান ‘হিউম্যান সার্পোট-বাংলাদেশ’। এদিকে, টাকা নিয়ে আসার পর আর যোগাযোগ নেই মারিয়েটার সঙ্গে আউয়াল মুনসীর। দু’বছর পর একদিন মারিয়েটা হাজির– তাও বাংলাদেশে আউয়াল মুনসীর ঢাকার অফিসে। সে সময় বর্তমানের মত টেলিযোগাযোগ বা অন্য কোন ধরণের যোগযোগ ব্যবস্থা বলতে একমাত্র চিঠিপত্র ছাড়া তেমন ছিল না। তাই, কোন খবরবার্তা না-পেয়ে মারিয়েটার ঢাকা আগমণ। ঢাকায় ‘হিউম্যান সার্পোট- বাংলাদেশ’-এর অফিস আছে, এই খোঁজ নিয়ে, সঠিকভাবেই জেনে, পা রাখে ঢাকায় মারিয়েটা।
মারিয়েটা অবাক হয় আউয়াল মুনসী তখন দু সন্তানের জনক। বিশ্বাস করতে না-পারা মারিয়েটা ভাল ব্যবহারও পায়নি। লন্ডনে ফেরে, বলতে গেলে প্রতারিত হয়েই। দু:খে-কষ্টে দিনকে রাত আর রাতকে দিন করেই চলে মারিয়েটার লন্ডনের পরবর্তী দিনগুলো।
মারিয়েটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বেসামাল সাহায্য করেছে। তার ছোট টয়োটা গাড়ি দিয়ে ব্যানার ফেস্টুন ট্রাফালগার স্কয়ার, হাইড পার্ক কর্ণার, পাকিস্তান হাইকমিশন ও ১০ ডাউনিং স্ট্রিটসহ নানা জায়গায় বহন করে নিয়ে দিয়েছে বিক্ষোভ সমাবেশে। তার দান বাঙালি জাতির জন্য এক উজ্জ্বল নক্ষত্রসম। কিন্তু তার দান কোথাও লেখাও নেই, যাদের জানা ছিল তারা কোথাও রক্ষা করেনি। যিনি করার কথা তিনি তো প্রতারণা করেই মুছে দিয়েছেন এই অসামান্য ইতিহাস।
সেই অপার প্রাণশক্তির তরুণীর লাশ একদিন নিজ ভাড়াটে ফ্লাটে পুলিশ অর্ধ গলিত পায়। ধারণা করা হয়, মারিয়েটা আত্মহত্যা করেছে। আজ যে বিশাল প্রতিষ্ঠান ‘হিউম্যান সার্পোট-বাংলাদেশ’ এটা কি এই গল্পের সাথে মেলে? কেউ কি বিশ্বাস করবে?
বাবা বললেন, এই প্রতারক ব্যক্তি এখন বিশ্বনন্দিত ব্যক্তি। আর আমার কাছে এবং আরো অনেকের কাছে তিনি নিন্দিত একজন।
তিনি বললেন, আমার পুত্রসম নাফিস এই প্রতিষ্ঠানে কাজ নেবে, মানে চাকরি! আমার কষ্ট হচ্ছে। তিনি আবার বললেন, অভিজ্ঞতা বা কোন বিষয়ই হয়ত আহা মরি কিছু নয়, তবে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে, তাই মনে রাখার জন্য বললাম এ লোক সম্পর্কে এ মুছে যাওয়া কাহিনি। নাফিস না-জানাই ভাল।
আমি বাবার কাছ থেকে এ গল্প শুনে বিমর্ষ হয়ে পড়ি। ঘর আর বারান্দায় পায়চারি করতে করতে এক পর্যায়ে ক্লান্তি নেমে আসে, ঘুম আসে চোখ ভরে। নাফিস বাইরে থেকে এসে আমাকে ঘুমে দেখে আর জাগায়নি। (চলবে)