মাতাল বাঁশি
হামিদ মোহাম্মদ
(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)
(উৎসর্গ: অসাম্প্রদায়িক মাতৃভূমি নির্মাণের উদ্দেশ্যে)
॥ চার॥
আমি হিথরোর এ্যরাইভাল করিডর দিয়ে হাঁটছি, পরনে মেরুন শাড়ি। মা দেখে ফিক করে হেসে দেবেন জানি। এটি তার বিয়ের পানচিনির শাড়ি। মেরুন রঙটা মা’র মত আমারও পছন্দ এবং এই শাড়িটার প্রতি আলাদা মায়াও,স্মৃতিঘন–তাই মা আমাকে দিয়ে দিয়েছেন। আমি আরো বেশি যত্নে পরতে পারি ভেবেই পরম্পরা এই দান। তাই ফিক করেই হেসে দেবেন ভাবছি এখন।
ছোটবেলা থেকেই শাড়িপরার প্রতি আমার কেন জানি একটি আলাদা জোঁক। সেই পিচ্চি থাকতেই পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পরে মা’র সব শাড়ির ভাঁজ নষ্ট করে দিতাম। তারপর বড় হয়ে কত শাড়ি কিনেছি, নানারঙের, এমনকি বিলেত গিয়েও। যদিও বিলেতে এখন বাঙালি মহিলারা শাড়ি পরে কম, পরে বোরকা। দেখতে ঘিন ঘিন লাগে। তবে আমার মা এবং আমাদের পরিচিত সাংস্কৃতিক ঘরানার মহিলারা অবশ্য আরো বেশি করে বাহারি নকশাদার সুতি শাড়ি পরেন। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে তারা রাঙিয়ে তুলেন। আমিও তাদের এই গোত্রের প্রথম সারির একজন।
সিলেট থেকে আসার আগে আমি অনেক শাড়ি বিক্রি করে সমুদয় টাকা ভাগ করে দিয়েছি আমার বাসার সহকারি দু’ মেয়েকে। তারা প্রথমে বিশ্বাস করতেও পারেনি, তাদের মনে হয়েছে,‘এ কি পাগলামি করছি আমি’। আসলে আমি যে চিরতরে সিলেট ছাড়ছি, এটা তারা ভাবতে পারেনি বলেই তাদের চোখ চড়কগাছ। তবে তাদের নিয়ে এক টেবিলে সকালের নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার খেতাম। যে রেয়াজটি বাংলাদেশে কোথায় চালু নেই। এটি দেখেছি একমাত্র মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট তবারক হোসেইনকে তার ড্রাইভারকে নিয়ে এক টেবিলে খেতে।
যাহোক, তাদের পছন্দ মত অনেক শাড়ি পরার জন্য তাদের হাতে তুলে দিয়েছি। আমি সিলেটে থাকতেই আমার দেয়া শাড়ি পরে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে মেয়েগুলো, চাইছে পা ছূঁয়ে সালাম করতে, আমি দিইনি। বাকী যে শাড়িগুলো আমার সাথে এনেছি, তাও শ’খনেক হবে। খুলেছি ‘ইস্টগ্রাম–শাড়ির এলবাম’। কী অপরূপ সাড়া। এও যে একটি সাহিত্য,নান্দনিক কর্ম তা আমারও চিন্তার বাইরে ছিল। আমি যে সময় যে শাড়ি পরেছি আমার অভ্যাস ছিল অন্তত একটি ছবি তুলে রাখা। আর এই অভাবনীয় ঘটনাটি, ‘ইস্টগ্রাম কাব্য’টি রচিত হয়েছে এই না-বুঝে করা ছবি থেকে। আমার মা’র নিকট থেকে ছবি তোলার এ অভ্যাসটি পাওয়া।
কী হাসি-খুশি মা আমার সব সময় ফুরফুরে থাকার মানুষ। তার ছোটবেলা, ইউনির্ভাসিটির কাল, সর্বত্র তার বিচরণ ছিল একটি শিল্পময়। তিনি এবং দল বেঁধে ঘুরানো বিশ্ববিদালয় মেয়েগুলো কখন যে ডানা মেলে উড়াল দেবে এই ছিল তাদের হাবভাব সব সময়। ভাগ্যিস, তারা কেউ ওড়েননি, তবে উড়ে উড়ে ঢাকা শহর মাতিয়েছেন। পাখি হয়েছেন বা, চুল উড়ছে, বেণী বেঁধেছেন ক্যাম্পাসকে গেঁথে নিয়েছেন বেলি ফুলের থোকায়,কী সব কাব্য উচ্চারণ। মুতের গন্ধভরা আর্টস ভবনের করিডরে নিবিঘ্নে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প। কী গপ, ফুরায় না। এই উচ্ছল, প্রাণক্ষরা ভোমরা আমার মা। দেখতে কে বলে সুন্দরী নয়? আমার তো ঝলসে যায় চোখ। গলা জড়িয়ে আজও যে সুখ পাই, পৃথিবী নত হয়ে আসে কীভাবে যেন। তাকে দেখলে আমি প্রাণ পাই। আমার প্রাণের বন্ধু বা সখা তিনি।
এই মা এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নিরলস কর্মী আমার বাবা দু’জনই ছিলেন এক উড়ন্ত স্বপ্নরাঙা মানুষ। মা বয়সে পাঁচ বছরের ছোট হলেও সাংস্কৃতিক কর্মযোগের ভেতরই গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক, শেষে বিয়ে করে সংসার গড়েন দু’জন। মা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন বাবা বিলেত আইন পড়ায়। আইন-পড়া শেষে দেশে আসেন বাবা আমার মা’র এক সুটকেস প্রেমের চিঠি নিয়ে। হেসে কুটি কুটি দু’জনে। ভাবাই যায় না, এতো চিঠি লিখেছেন মা। বিশ্বাসও হচ্ছিল না প্রথম। শুনেছি মা ও বের করে দেন বাবার দীর্ঘ চিঠির বাণ্ডিল। মা’র অসংখ্যা লেখা তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ও ‘সাপ্তাহিক সন্ধানী’তে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সাংবাদিক হিসেবে স্নেহভাজন ছিলেন কামাল লোহানী, শাহাদাৎ চৌধুরী, শামসুর রাহমান, আহসান হাবিব, বজলুর রহমান, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই সহ ঢাকা কাঁপানো সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের। কখনো ক্যামেরা নিয়ে দৌঁড়, শাড়ি পেঁচে আটকে-পড়া, কুচির গিট লাগার বিড়ম্বনার গল্প করতে করতে মা খুনসুঁটি যেতেন। আমার বড় হওয়ার পথে পথে, বাঁকে বাঁকে বিছিয়ে দেন তার এসব গল্প।
তাদের এসব নানা হৃদয়ভাঙা গল্পই আমাকে পড়া শেষে বাংলাদেশ যেতে অনেকটা তৈরি করে ফেলে। ক্যামব্রিজে পড়ার সময় পরিচয় নাফিস মাহমুদ-এর সাথে। বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা তরুণ। কীভাবে যেন এক দিন চোখে আটকে যায় সে। বাঙালি সংগঠন ‘সৌধ’ সোসাইটি অব ইন্ডিয়ান মিউজিক আয়োজন করেছিল বাংলা পয়েট্রি এণ্ড মিউজিক। অনুষ্ঠানে আমিও পয়েট্রি রিসাইটিংয়ে আমন্ত্রিত ছিলাম। আমন্ত্রণ করেছিলেন সংগঠনের পরিচালক কবি টি এম আহমেদ কায়সার। সেখানে নাফিসের সাথে পরিচয়। বেশ ইংরেজি জানে, সাধারণত বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে হিমশিম খায়,আটকে যায়– দক্ষতা কম, তাই। কিন্তু নাফিস ইংরেজি ভাষায় স্বচ্ছন্দ। খুব অল্প সময়েই পরিচিতিটা বেড়ে যায়। পরে যোগাযোগ গভীর।
দেখলাম সেও পড়ালেখা সমাপ্ত করেই দেশকে ভাবছে। ভাবছে নূন্যতম অবদান রাখার। মা-বাবাকে এক সময় পরিচয় করিয়ে দিয়ে আমি স্বস্তি পেলাম,হয়তো ঘর বাঁধা যাবে।
এইভাবে একদিন হুট করে বাংলাদেশে পৌঁছা। জীবনকে বেঁধে দাঁড়ালাম বাংলাদেশের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতে। আমরা দু’জনই এক মত যে, চিকিৎসার নমে বাংলাদেশে বাণিজ্য চলছে, শিক্ষার নামেও বাণিজ্য চলছে– এ থেকে দেশকে বাঁচানোর উপায় খোঁজা। বাবার প্রস্তুত করা ক্ষেত্র ‘বীরমুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম হাসপাতাল’–এক টাকার হাসপাতাল’ চালু করা আমাকে শক্তি যোগাল। আমি পা রাখি একটি স্বপ্ন নির্মাণে,বলতে গেলে কঠিন পথে।
লড়াই শুরু করেছিলাম দু’জনে এক সাথেই–ভাবনা ছিল নাফিস শুরু করবে বাংলাদেশের শিক্ষার বাণিজ্যকরণ রোধে কাজ আর চিকিৎসা বাণিজ্যকরণ রোধে আমি। আমার মা ও বাবার লড়াই ছিল যে ভিত রচনার, সেখানে কী আমি পৌঁছেছিলাম–এরকম প্রশ্ন এখন আমাকে তছনছ করছে ঝড়ের গতিতে। ছুটলাম তাদের সেই দিনগুলোর পাতা ওল্টাতে। জীবনযুদ্ধ কতই না বিচিত্র। (চলবে)