মাতাল বাঁশি
হামিদ মোহাম্মদ
সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)
(উৎসর্গ: অসাম্প্রদায়িক মাতৃভূমি নির্মাণের উদ্দেশ্যে)
॥পাঁচ ॥
বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার টান তৈরির জন্য বাবা আহমেদ আজাদ এবং মা সেলিনা আজাদ অন্যতম জাদুঘর। তাদের ভেতর যে গল্প এবং কাহিনি এমনকি লড়াই, যুদ্ধস্মৃতি, আগুন হয়ে আছে, সে সব অতলগামী। তাদের মুখে শোনা তার বা তাদের সময়ের কাহিনি। যদিও আমি পনের বছর বয়সে দেশ ছাড়ি, কিন্তু কিছু রঙিন দৃশ্য বা স্মৃতি ছাড়া তেমন কিছুই আমাকে সে সময় আচ্ছন্ন করতে পারেনি বা গভীর কোন গাঁথাকাহিনি মনে নেই তখনকার। নিরিবিলি সময় পেলেই বাবা ডুবে যান তার জীবন সন্ধানে। আর আমি সেই সন্ধানি জগতের একজন হয়ে বোধ হয়ে শুনি সব।
খাদিমনগর জায়গাটা অদ্ভুত সুন্দর। সিলেটের রমণীয় অসাধারণ এ জায়াগাটি প্রকৃতিপ্রেমিদের জন্য আকর্ষণীয়। এখানে সবুজ প্রকৃতির কোলে নান্দনিক জাকরিয়া সিটি ও নাজিমগড় রির্সোট রয়েছে। কর্নেল(অব)এ আর চৌধুরী গ্রীনহিল নামে অপূর্ব সুন্দর বাড়ি করেছেন টিলার উপর। প্রবাসী শফিকুর রহমান চৌধুরীর পরিবারের একটি বাড়ি এতোটাই নান্দনিক,এরকম সুন্দর বাড়ি বাংলাদেশে কেন, উন্œত কোন দেশে কয়টা আছে, জানা নেই। কমপক্ষে দশ একর জায়গাজুড়ে বাড়ির আঙিনায় বিশাল লেক, হাজারো জাতের ফলফুলের বাগান, দীর্ঘ লন, আকাশ উপুড় হওয়া দৃশ্য। সদ্য নির্মাণ করেছেন প্রবাসী মাহতাবুর রহমান নাসির তিন কোটি টাকা ব্যয়ে রাজকীয় আভিজাত্যভরা সৌন্দর্যের একটি বাড়ি। মোটকথা, এ এলাকায় সাজানো গোছানো শতাধিক বাড়ি করেছেন প্রকৃতিপ্রেমী সিলেটের লোক, প্রবাসীরাও। করেছেন ছোট ছোট ফলের বাগানসমেত ঝুলনাসহ, পুকুর আর বাগান বাড়ি। টিলাগুলোকে দেখলে মনে হয় হেলান দেয়া সবুজ পৃথিবী। প্রতিটি বাড়িতে ঘন সুপারি গাছ। বিভিন্নজাতের বাঁশের বাগান, প্রতিটি বাঁশ মমতায় জড়িয়ে রয়েছে, বাতাসে দুলছে, রিনিঝিনি শব্দ ঝরছে পাতার। রয়েছে জঙলি গাছ ও লতাপাতায় ঘেরা নুয়ে পড়া বন। সিলেট থেকে যে সড়কটি পূব দিকে ছুটে গেছে তামাবিল জাফলংয়ে, সেটির পাশেই খাদিমনগর এলাকাটি, সংক্ষেপে খাদিম বলা হয়। আরও রয়েছে সবুজ চাবাগান। খাদিমের পাশেই আছে হজরত শাহজালালের সঙ্গী হজরত শাহপরানের মাজার। এই সড়কের পাশে রয়েছে বিআরডিবির ট্রেনিং ইন্সটিটিউট বিআরডিটিআই,বিসিক শিল্পনগরী, জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট। খাদিম থেকেই বাইপাস সড়ক গেছে মহাসড়কে মিশে শাহপরান সেতু দিয়ে,যা সুরমা পাড়ি দিয়েছে এক লাফে।
সেলিনা তরপদারদের বাড়ি খাদিমনগরে এমনি সুন্দর প্রকৃতির আঁচলে মোড়ানো একটি টিলার উপর সবুজে ঘেরা। যে টিলাটি জাফলং বেড়াতে যাওয়া হাজার হাজার মানুষের চোখকে টেনে ধরে। সেলিনা তরপাদাররা বা তাদের পরিবার যখন ঢাকায় থাকতেন, তখন তাদের বাবা আলহাজ আমজাদ হোসেন তরপদার এ বাড়িটি তৈরি করেন। রিটায়ার্ড হলে বাকী জীবন ছেলেমেয়ে নিয়ে কাটাবেন এ বাড়িতে,এ উদ্দেশ বানানো। এটা তাদের বাবার স্বপ্ন। তিন ভাই ও চারবোন তারা। মোট সাতভাইবোন, ‘সপ্তর্ষি’ বললে অপূর্বই লাগে।
তবে ছেলেমেয়েরা যে এ বাড়িতে বসবাস করবে এ নিশ্চয়তা ছিলো না বা ভাবেনওনি তিনি। পড়ালেখা করে কে কোথায় যাবে, কোথায় কে কি চাকরি করবে,পড়ে থাকবে সুন্দরবন না বান্দরবন, না ঢাকার কোন পাড়ায় কে জানে। কিন্তু স্বপ্ন সব সময় স্বপ্ন নয়, বাস্তব হতেই পারে কখনো। তাই এ বাড়িটিতে ছেলেমেয়ে ঘুরফিরে থাকবেন অনেকটা অবকাশ যাপনের মতো, এটুকুই যথেষ্ট, এটাই স্বপ্ন পুরণÑএর চেয়ে বেশি বড় স্বপ্ন দেখেননি রিটায়ার্ড জীবনে আমজাদ হোসেন। সুতরাং এ স্বপ্ন পুরণ হয়েছে ধরে নিতে হবে। সেলিনা তরপদার তাদের বাবার এই স্বপ্নকে ধারণ করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ঔ পাহাড়ি সবুজ বাড়িটি এখন তাদের জীবনজুড়ে একাকার, ভালোবাসার ধন। এ বাড়িটির একটি ঘাসকে মরতে দেখলে কাতর হয়ে ওঠে তারা, কাতর হন বাড়ির সকলেই।
এই টিলাবাড়িটির নাম ‘উপবন‘। ‘উপবন’ নামের বাড়িটি সত্যি সত্যিই স্বপ্নঘেরা,স্বপ্নময় একটি উপবন। বাড়ি বানানোর আগে এতো দুরে, পাহাড় টিলাময় পরিবেশে টিকতে পারা যাবে কিনা সেটা ছিলো সকলের ভয়। কিন্তু পিতার পছন্দের বিরুদ্ধে কেউ যাননি, যেতে ভাবেনও নি। কোন কোন ভাবনাচিন্তার সাথে বাস্তবতার যোগ খুব একটা না থাকলেও অভ্যাসটাই এক সময় স্থায়ী হয়ে যায়। মনের সাথে খাপ খেয়ে যায়, তখন জীবনভর আকড়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। মমতাও বেড়ে যায়, সব কিছুর প্রতি স্বপ্নজুড়ে যায়।
এই উপবনে সংস্কৃতিকর্মীদের আড্ডা বসতো। বাবা বললেন, রীতিমত নিজের বাড়ি মনে করতাম সকলেই। বাড়ির মানুষ, সবাই কী অপুর্ব বন্ধুসুলভ। ভাবতেই পারা যায় না এটা পরের বাড়ি। এ বাড়ির তৃতীয় মেয়ে সেলিনা তরপদার বাড়িটির প্রাণ। সে-ই প্রজাপতির মতো উড়তো, আমরাও উড়তাম।
খাদিমনগর পৌঁছার আগেই সড়কের পাশে দেবপুরের ছোট্ট একটি টিলায় আমাদের নতুন বাড়িটাও। এই এলাকাকে মেজর টিলাও বলা হয়। একজন মেজর র্যাঙ্কের আর্মির মেডিক্যাল কোরের ডাক্তার এলাকার জঙ্গলাকীর্ণ একটি বড় টিলায় প্রথম বসত করেন। এ থেকে লোকমুখে এলাকাটির নাম হয় মেজর টিলা। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেবপুর হিন্দুদের নাম হওয়ার কারণে এই নামটি পাল্টিয়ে তখনকার আর্মির কমান্ডার ইফতেখার রানা এলাকাটির নাম দেয় ইসলামপুর। এই দেবপুরেই আমাদের টিলার নাম ‘পাহাড়িকা‘। বাবা তার গল্পে বললেন, শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় বাড়িতে উঠে টিনের আটচালা ভবনটির নাম দিলাম ‘শ্রাবণী‘। বাড়িতে ওঠার সময় এতো বৃষ্টি ছিলো, বৃষ্টির ফলা ঠেলে ভিজতে ভিজতে মনে হলোÑমাসটি কদম-ফোঁটা শ্রাবণ। মনে মনে বললাম– ওবাড়ি, তুমি আজ থেকে ‘শ্রাবণী‘। বাড়িটির নাম রাখার সমস্যাটাও ঘুছে গেল শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে। আমি এখন পাহাড়িকার ‘শ্রাবণী’র বাসিন্দা।
এই পাহাড়িকার শ্রাবণী‘তেই নিয়মিত সংস্কৃতিকর্মীদেরও আসা-যাওয়া। আড্ডা, মুখোমুখি বসে গল্প, গল্পের বই, কবিতা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে। কবি লেখক গল্পকার কে কি নুতন লিখছেন, কার নতুন বই বেরুলো–তুমুল হৈচৈ।
কৈশোর পেরুনোর পর ফুটতে থাকে মন, হৃদয় ও প্রাণ। জমা হতে থাকে স্মৃতি, অনুভুতি, শিহরণ। স্বপ্ন শুরু হয় এভাবেই। যেটাকে ‘স্বপ্নের লাল ঘুড়ি’ ওড়ানোর সময় বলতে হয়। বোধ হয় প্রেম ও সৌন্দার্যানুভুতি এ সময়েই শুরু হতে থাকে। বড় হয়ে দেখা গেছে, সেই কৈশোর-ই জীবনের উৎকৃষ্ট ভিত বা ভিত্তি। শিহরণ ও স্বপ্ন সামনে ছুটছে অবিরাম। ধরা যাচ্ছে না স্বপ্নকে।
এই সময়টায় মনের ভেতরটাকে কখনো পুষ্পিত বাগান মনে হয়,ফুল ফোটে অবিরাম। আর এ প্রস্ফুটিত ফুল বাগানটা মূলত দৃশ্যহীন। এই বয়সে এই সময়ে কাকে বলা যাবে এ ফুল ফোটার কথা? এ থেকেই কবিতা লেখা শুরু। মেয়েরাও এ সময় রুমাল বানায়, চিরন্তন বাণী লিখে রুমালে। গুনগুনিয়ে গান গায়। দুরের বাঁশিতে কান পাতে।
আমারও,মনের ভেতরেই ছটফট করে নানা কথা, নানা বিষয়। মনে হয় আকাশটা উপুড় হয়ে আছে মাথার উপর। আকাশ থেকে নামছে অবিরল ধারায় অদৃশ্য যে বৃষ্টি। বৃষ্টির মাঝে ভিড় করে কত যে পরী! ভাবতে ভাবতে ঘেমে উঠতাম। সবার বেলায়ও হয়তো এটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এলোমেলো এসব প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি রঙরূপ গন্ধেভরা স্বপ্ন সব মানুষই যতেœ রাখে কোথাও। কিন্তু আমার! নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার যাতনাÑকী তীক্ষè মর্মর ধ্বনি তুলতো কোথায় যেন। আকাশ তখন শুধু আকাশ নয়,নীলÑশূন্যতার প্রতিচ্ছবি, হাহাকার। আবার রঙের চিৎকারও।
গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, নদীতে সাঁতার কাটার বন্ধুদের ফেলে। স্কুলের সাথীরা ছড়িয়ে গেল। একা হয়ে গেলাম। দেখতে দেখতে অনেক বন্ধু জুটলো। এ আরেক জগত। এটা যৌবন।
এক সময় গ্রামের যুবক এলাম শহরে। চোখও ডানা মেললো। চোখের এই ডানা মেলার দিনেই এই সময় হোস্টেল ছেড়ে পেয়িং গেস্টে উঠি, শিবগঞ্জের লাকড়িপাড়া। আগে থেকেই এখানে থাকতেন একরাম উদ্দিন আহমদ। আমার একব্যাচ সিনিয়র হলেও ঘনিষ্ট বন্ধু তিনি।
যুগভেরীর শাপলার মেলায় এ সময় লেখা ছাপা হয়েছে। পাতা খুলে বারবার পড়ি নিজের মুদ্রিত লেখাটি। আনন্দে মন ভরে যায়। ৭৬ সালে যুগভেরী অফিসে শাপলার মেলার অনুষ্ঠান শুরু হয়। নিয়মিত সাহিত্যের অনুষ্ঠান হতো। পরিচয় অনেকের সাথে। মেয়ে কবিরা রিকশায় চড়ে আসতো অনুষ্ঠানে।ওরা তিনচার জন রিকশায় চড়লে হুডখোলা-রিকশা হয়ে উঠতো ফুলদানি। তখন থেকে শহরের সকল রিকশাকে ফুলদানিই মনে হতে থাকে।
‘৭৭/৭৮ সাল। ঈদগার মুন্নানগরের বাসিন্দা হলাম আমরা। এ বাসাটি ভালো লাগলো অন্য কারণেও। এক সময় এ বাসাটিতে থাকতেন কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ও কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। তারা দুজনই ছিলেন এমসি কলেজের টিচার। আলাউদ্দিন আল আজাদ তার বিখ্যাত ‘কয়লা কুড়ানোর দল; গল্প এ বাসায় বসে লিখেন। আর আবদুল মান্নান সৈয়দ-এর বিখ্যাত ‘সাপ‘ গল্পটিও এ বাসায় সৃষ্টি।
আমাদের এ বাসায় আড্ডা জমতো কবিদের। কবি মোয়াজ্জেম হোসেন, মউিদ্দিন শীরু, নুরুজ্জামান মণি,তুষার কর,আজিজ আহমদ সেলিম,একরাম ভাই,আজিজ ভাইসহ আরো অনেকে রাতভর আড্ডা দিতেন। কোন কোন রাত আবৃত্তি করতে করতে ভোর হতো।
আমার বাসায় আড্ডার পর এ রকম এক মধ্যরাতে কবি রোকেয়া খাতুন রুবির বাসায় হানা দিয়েছিলেন ছয় সাতজন তরুণ কবি। দরজায় ঠোকা দিলে রোকেয়া খাতুন রুবি দরজা খোলেন। কি বিষয় এতো রাতে? সহাস্যে সকলের উত্তরÑসেহরি খাবো। রুবি সেহরি খাওয়ান কবিদের। কোন দ্বিধা না দেখিয়ে রান্নবান্না করেছিলো রুবি ও তার বোনেরা। আমরা তিনজন পথিমধ্যে সটকে পড়েছিলাম পেছনে থেকে।
এ সময় সাহিত্যের মধুময় আড্ডা হতো খাদিমনগর, সেলিনা তরপদারদের বাড়ি। অনেক আগে থেকেই উপবন‘র আড্ডায় কবি বেলাল মোহাম্মদ ছিলেন নিয়মিত সদস্য। তিনিই আড্ডার শীর্ষমনি।
কবি বেলাল মোহাম্মদ প্রচলিত ধর্ম নিয়ে ভাবতেন না, মানবতাবাদই ছিলো তার ধর্ম। সেলিনা তরপদারদের পরিবারের সবাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশালধারি। বেলালভাই সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, যিনি বাঙালির দিশা হয়ে ওঠেছিলেন একাত্তরে। স্বাধীনবাংলা বেতারের ¯্রষ্টা ও প্রধান সংগঠক তিনি। উপবন বাড়িটির সদস্যদের মনের মধ্যে একটি নিখাদ ভুবন বা স্নিগ্ধ জায়গা করে নিয়েছিলেন এই কারণেও। তাই,নতুন নতুন সৃষ্টি রহস্য অনুসন্ধান ছিলো এক মোহনায়। এই উচ্ছল দিনগুলোর ভেতরে আমিও ছিলাম– সেলিনা তরপদারদের বাড়ির আড্ডার বন্ধু। (চলবে)