নিজের ঘরে ফসল ফলায় কয়জনা
আবু মুসা হাসান
টেলিফোনে কুশল বিনিময় করেই আমার কাছে সবার একটা কমন প্রশ্ন থাকে, এবার আপনার এ্যালটমেন্টের খবর কি? আমি বলি, স্বেচ্ছায় গৃহবন্দী, তাই এ্যালটমেন্টে যাইনা। পরবর্তী প্রশ্ন থাকে, তার মানে এবার বাগান করছেন না? গত চার বছরে সব সামারে ফেসবুকের কল্যানে অথবা আমার এ্যালটমেন্টের প্লটে অতিথি হিসেবে যারা এসেছেন, তাঁদের প্রচারে এবং সর্বোপরি সাপ্তাহিক পত্রিকায় আমার শখের বাগান নিয়ে কবি হামিদ মোহাম্মদ এর সচিত্র ফিচার প্রকাশ করায় পরিচিত জন সবাই জানেন যে, আমি সামারে সব্জী ও ফুলের বাগান করি। তাই, সবাই বাগানের খবর জানতে চায়। আমি যখন বলি, এ্যালটমেন্টে না গেলেও সব্জী বাগান হচ্ছে, ফুলের বাগান হচ্ছে। অবাক হয়ে তাঁরা প্রশ্ন করেন, কিভাবে? আমি বলি ঘরই এখন আমার বাগান। আর এ্যালটমেন্টে না গেলেও আমার প্লট খালি পড়ে নেই, ফুল ও সব্জীর ফলন ঠিকই হচ্ছে।
গত কয়েক বছর ধরে আমাদের বাড়ীর কাছেই একটি এ্যালটমেন্টের প্লটে রকমারী সব্জি আর বাহারী ফুলের গাছ লাগিয়ে আসছি। পশ্চিম লন্ডনের হিলিংডন কাউন্সিলের এই এ্যালটমেন্টে সর্বমোট ৮০টি প্লট আছে। স্থানীয় ইংলিশ বাসিন্দাসহ বিভিন্ন জাতিসত্বার প্রবাসীরা কাউন্সিল থেকে প্লট বরাদ্দ নিয়ে থাকে। সমগ্র বৃটেন জুড়ে বহুবছর আগে থেকেই স্থানীয় সরকারগুলো এ্যালটমেন্ট এর ব্যবস্থাপনা করে আসছে। যারা ফ্লাটে বসবাস করেন তাদেরকেই এসব প্লট বরাদ্দে অগ্রাধিকার দেয়া হয়ে থাকে। মূলত নিজের প্লটে নিজে কাজ করে শরীর, স্বাস্থ্য ও মন সুস্থ রাখার জন্যই এই প্লটগুলো বরাদ্দ দেয়া হয়ে থকে। এগুলোর বাণিজ্যিক ব্যবহার বেআইনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এবং যুদ্ধশেষে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হলে এই এ্যালটমেন্টেগুলো সব্জি ঘাটতি মেটাতে সহায়তা করেছিল।
সে যাই হোক, আমাদের এ্যালটমেন্টে যারা প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে এ্যালটমেন্টের মাঝখানে অবস্থিত কফি হাটে চলে আড্ডা। গ্রুপ গ্রুপ করে আয়োজন করা হয় বারবিকিউ পার্টি। একে অপরের সাহায্যে এগিয়ে আসে। যেমন, সামার আসলেই এ্যালটমেন্ট কমিটির নির্বাচিত চেয়ারম্যান জন পাওয়ার কমিটির পক্ষ থেকে রোটেভেটর (ছোট পাওয়ার টীলার) নিয়ে প্রস্তুত থাকেন। একটা নির্ধারিত ফী এর বিনিময়ে এই ছোট পাওয়ার টীলার দিয়ে জন পরম যত্নের সাথে প্লটের জমি চাষবাদের জন্য তৈরী করে দেন। ৭৬ বছর বয়স্ক এই আইরীশ ভদ্রলোকের শরীরে কোন ক্লান্তি নেই। সারাক্ষণই থাকেন কাজের মধ্যে। নিজের প্লটে কাজ করার পাশাপাশি পুরো এ্যালটমেন্টকে পরিপাটি করে রাখার জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকেন এই হাস্যোজ্জ্বল ব্যাক্তিটি। আমাদের যে কোন কঠিন কাজে সাহায্য করার জন্য দীর্ঘদেহী শ্রীলংকান শীবা হাসিমুখে এগিয়ে আসেন। বছর তিনেক আগে আমাদের প্লটে ব্যাঙ চাষের জন্য একটি ছোট পুকুর বানিয়েছিলাম। বানিয়েছিলাম বললে ভুল হবে। শীবাই বানিয়ে দিয়েছিল। ভাববেন, সব্জি আর ফুল বাগানে ব্যাঙের চাষ কেন? ভয় পাবেন না, খাওয়ার জন্য নয়, প্লটের অবাঞ্চিত অতিথিদের নিধন করার জন্য ব্যাঙ খুবই কার্যকর। দিনের বেলায় ব্যাঙ পানির মধ্যে লুকিয়ে থাকে, আর রাতের আঁধারে বের হয় পোকা-মাকড় শিকারে। আক্ষরিক অর্থেই নাইট গার্ডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ব্যাঙ বাহিনীর মুভমেন্টে খাদক স্লাগ (জোঁক) পালিয়ে যায়।
হাসিখুশী নাইজেলও সদা এগিয়ে আসে সাহায্য করার জন্য। বিশ্বকাপ চলাকালে জো তার এ্যালটমেন্টের শেডের ওপর পূর্তগীজ ফ্ল্যাগ উড়ানোর পর নাইজেল উঁচু করে ইংল্যান্ডের একটি ফ্লাগ উড়িয়ে দিল। কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানিীকে হারিয়ে ক্রোয়েশিয়া জয়লাভ করার পর আমরা সবাই মিল্কাকে ধরলাম আমাদের ট্রীট করানোর জন্য। সার্বিয়ান লিওনা প্রতিবছরই আমাদের টমেটো এবং অন্যান্য সব্জির চারা দেন ।
এবার আসা যাক, প্লট বারাদ্দ নেয়ার কাহিনীতে। বেশ কয়েক বছর আগে আমার বন্ধু সৈয়দ এনাম জানালেন তিনি লাইফ স্টাইল বদলিয়ে ফেলতে চাচ্ছেন। এ্যালটমেন্টে সব্জী বাগান করবেন এবং সেখানেই অধিক সময় কাটাবেন। আমি তার পরিকল্পনায় মুগ্ধ হয়ে তার এ্যালটমেন্টে ‘বর্গা চাষী‘ হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব দিলাম। চুক্তি হলো, আমি কিছু চারা কিনে রোপন করে আসবো, আর এনাম পানি দিবে। আমি মাঝে মধ্যে ছুটির দিনে যেয়ে গাছের পরিচর্যা করে আসবো। যেই কথা সেই কাজ। চুক্তি মোতাবেক চারা রোপন করলাম। পুঁইশাক, লাউশাক, লাউ ও টমেটো খেলাম।
পরবর্তী বছর আমার ছেলে অভী বললো, তোমার যখন বাগান করার এতো শখ, তাহলে তুমি বাসার কাছে এ্যালটমেন্টে প্লট বরাদ্দ নিয়ে নেওনা কেন? আমি বললাম বাবা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অন্যের রেডী করা প্লটে চারা রোপন করে দিয়ে আসা সহজ। নিজের প্লট হলে আমাকেই সব করতে হবে। মাটি কাটা, ঘাস, আগাছা পরিষ্কার করা, এতো সব কঠিন কাজ আমাকে দিয়ে হবেনা। আর তোদের আম্মু পোকা-মাকড় ভয় পায়, আমাকে কোন সাহায্য করতেও পারবেনা। কিন্তু ছেলে নাছোড়বান্দা। আমার মেয়ে তুনিয়াকে রাজী করালো এবারের ফাদার্স ডে গিফট হবে ‘এ্যালটমেন্ট‘। যে কথা সে কাজ। অভী তড়িৎ গতিতে আমার বাসার কাছে কোথায় কোথায় এ্যালটমেন্ট আছে লিঙ্ক পাঠিয়ে দিল। ছেলে মেয়ে দুজনে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে বাগান করার গাইডলাইন সংক্রান্ত একটি মোটা বই, বাগানে বসার এবং হাঁটু গেড়ে কাজ করার টুল, কোদাল, নিড়ানী এবং বাগানে কাজ করার জন্য একটি টি সার্ট পাঠিয়ে দিল। তখন আর না বলার সুযোগ নেই। নীলুও ছেলেমেয়ের কথায় সায় দিল এবং আমাকে রাজী করালো। বল্লো, আমরা যতটুকু পারি ততটুকু কাজই করবো। জায়গা খালি থাকলে অসুবিধা নেই।
বাসার কাউন্সিলে যোগাযোগ করে কয়েকটি এ্যালটমেন্ট সরেজমিনে পরিদর্শন করে হেইজে অবস্থিত স্টেশন রোড এলটমেন্টটি পছন্দ হলো। কাউন্সিল থেকে জানালো যে, এই এলটমেন্টের নির্বাচিত কমিটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে। রবার্ট পাপিনী ছিলেন কমিটির সেক্রেটারী। আমি এবং নীলু এ্যালটমেন্টে যাওয়ার পর রবার্ট কয়েকটি প্লট দেখালেন। আমরা কফি হাটের পাশের অর্ধেক প্লটটি পছন্দ করলাম।
এভাবেই শুরু হয়ে গেল শখের সব্জী বাগান। প্রতিবছর এপ্রিল থেকে শুরু করে আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্লট নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত থাকি। প্রতিবছরই আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুরা দল বেঁধে প্লট থেকে স্বহস্তে সব্জি তুলে নিয়ে যান।
আমার ছোটবেলার বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হায়দার আলী খান লন্ডন সফরে এসে একবার আমাদের এ্যালটমেন্ট দেখতে এসেছিলেন। আশেপাশের প্লটহোল্ডারদের সাথে বাল্যবন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর অবাক বিস্ময়ে মন্তব্য করেছিলেন, এটা দেখছি “মিনি জাতিসংঘ”। এক সামারে লন্ডন সফরে এসে ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাদের একাত্তর সালের গেরিলা গ্রুপের লীডার মাহবুব জামান আমার এ্যালটমেন্টে এসেছিলেন। সাথে ছিলেন কবি হামিদ মোহাম্মদ এবং সৈয়দ এনাম।
বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা নিয়ে এবার ফেব্রুয়ারী মাস থেকেই কাজে লেগে পড়ার পরিকল্পনা এঁটেছিলাম। ডিসেম্বর-জানুয়ারীতে শীতের মৌসুমেই রসুন বুনেছিলাম, তার সাথে নীলু সূর্যমুখী, টিউলিপ, ডেফোডিলস এবং ডালিয়াসহ রং-বেরংয়ের ফুলগাছের বাল্বও লাগিয়েছিল। প্রতি বছরই নীলু বিভিন্ন রংয়ের গোলাপ ডাল রোপন করে, এখন বহু গোলাপ গাছ আছে ।
কিন্তু সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। সর্বনাশা করোনা ভাইরাসের হামলায় বিশ্বব্যাপী যে সংকট শুরু হলো, তার ফলে স্বেচ্ছায় বন্দিত্বের কারনে মার্চ মাস থেকে আর এ্যালটমেন্টে যেতেই পারলামনা। যারা পায়ে হাঁটার দূরত্বে বসবাস করেন অথবা নিজস্ব গাড়ীতে আশা-যাওয়া করেন, এবং রৌদ্রমাখা দিনে ভিটামিন ডি পেতে আগ্রহী, তারা অবশ্য এ্যালটমেন্টে কাজ করছেন অধিক উৎসাহ নিয়ে। আমরা যাবনা বলে আমাদের পার্শ্ববর্তী প্লট হোল্ডার রবার্ট পাপিনী এবং তার সাউথ আফ্রিকান স্ত্রী ক্যাথরিনকে আমাদের প্লটটি ব্যবহার করার অফার দেয়ার পর এই দম্পতি রাজী হয়ে গেল। তারা বেশ দরদ দিয়ে আমাদের প্লটে সব্জি লাগিয়েছে এবং ফুল গাছের চারাগুলোর যত্ন করেছে। অন্য এক প্লটহোল্ডার সোমালিয়ান আনিসা ফেইসটাইমে কল দিয়ে আমাদের পারিপাটি প্লটটি দেখিয়েছে বেশ কয়েক দিন, গোলাপ ও অন্যান্য ফুলে ফুলে ভরে গেছে বাগান।
তবে করোনা ভাইরাসের জন্য এ্যাল্টমেন্টে যেতে পারিনি বলে কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই। আমাদের তিনতলার ফ্লাটেই উদ্যোগ নিলাম। লক ডাউনের মধ্যে যেহেতেু বাসায় কোন গেষ্ট আসার সুযোগ নেই, তাই ঘরকে গ্রীণ হাউস বানিয়ে ফেললাম। কিন্তু সমস্যায় পড়লাম কমপোষ্ট নিয়ে। সব খানে কমপোষ্ট আউট অফ স্টক। তাই বিশেষ ব্যবস্থায় আমাদের এ্যালটমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান জন পাওয়ারের কাছ থেকে দাবাড়ু বন্ধু রঘু কামাথকে দিয়ে কমপোষ্ট এবং টব আনালাম। শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন সব্জীর বীজ বোনা। পুঁই শাক, আলু, মরিচ, টমেটোর সাথে করোলাসহ লাউ, কুমড়ার বিচিও লাগালাম। ঘরে লাউ গাছ! অনেকে অবাক হবেন। অবাক হবার কিছু নেই, আমার লাউ গাছ এখন ঘরের জানালায় বেড়েই চলেছে, কয়েকদিন পরে হয়তো লাউ ধরবে। ইতোমধ্যে গাছে ক্যাপসিকাম ধরেছে।
বন্ধু নবাব উদ্দিন খুব উৎসাহের সাথে বাগানের খোঁজখবর নিতেন। প্রতি বছর আমার বাগানে এসে নিজ হাতে সব্জী তুলে নিয়েছেন। আমার বাগান দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে গত বছর থেকে নিজেই সব্জী বাগান শুরু করেছেন। ড. জাকী রেজাওয়ানা আমাকে ডাকেন কৃষিবিদ বলে। গত বছর ড. জাকী খুবই তোড়জোড় শুরু করেছিল সব্জি বাগান করার জন্য। আমার কাছ থেকে কয়েক দিন ফোন করে ফ্রী কনসালটেন্সী নিলেন। আমিও চারা এবং বীজ সরবরাহ করবো বলে কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু জাকী রেজাওয়ানা শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিলেন। আমি যেদিন ওর জন্য চারা নিয়ে যাব বলে ঠিক করেছিলাম, সেদিনই ফোন করে বল্লেন, কৃষিবিদ চারা আনবেননা, আমাকে দিয়ে হবেনা। তবে পুষ্পিতা গুপ্ত টাওয়ার হ্যামলেটস প্যারেন্টস সেন্টারে আমাদের দাবা ক্লাবে এসে চারা নিয়েছেন। আমাদের দাবাড়ু বন্ধু তারেক খানকেও মরিচ এবং টমেটোর চারা দিয়েছি। তবে রুপী আমিন গত বছর আমাকে লাউ, বেগুন এবং নাগা মরিচসহ বহু চারা দিয়েছিলেন।
সিনিয়র সাংবাদিক আবদুস সাত্তার এবং শাহনাজ সুলতানা প্রেস ক্লাব গ্রুপে লিখেছিলেন যেন আমি ‘লাউ পার্টি‘ দেই। রুপী আমিন তখন অস্ট্রেলিয়ায় হলিডেতে ছিলেন। আমি বললাম, রুপী যেহেতু লাউয়ের চারা দিয়েছে রুপীকে ছাড়া পার্টি হবেনা। রুপী ফিরে আসার পর বললো, হাসান ভাই এই বছর সামার শেষ, পরবর্তী সামারে পার্টি হবে।
তবে, এই সামারে এ্যালটমেন্টে না হলেও পার্টি হবে, পার্টির আয়োজন চলছে। অনুজপ্রতীম সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশার সাথে এবং রূপী আমিনের সাথে কথা বলেছি। আমরা জুম প্রোগ্রামের মাধ্যমে সবাই সবার সব্জী বাগান থেকে পার্টিতে যোগ দিব।
আমার শখের বাগান দেখে আনাস পাশা এবং তার স্ত্রী কলি পাশা এবার এ্যালটমেন্টে প্লট নিয়ে শুরু করে দিয়েছে সব্জী চাষ।
(আবু মুসা হাসান, সাংবাদিক, সত্যবাণীর উপদেষ্টা সম্পাদক)