আমাদের স্বাধীনতা ও সালমা বেগম
মহি জামান
স্বাধীনতার নগ্ন আলো যখন পূর্ব দিগন্তে লাল আভা ছড়িয়ে উদিত হয়হয়। অবগুন্ঠনে ঢাকা লাজে নম্রত গ্রাম্য নববধূর নানা বর্ণের কাঁচের চুড়ির মতো বিজয়ের সূর্য চিকচিক করতে শুরু করছে। সালমার পৃথিবীতে সূর্য তখন অস্তমিত। পৃথিবীর যত বঞ্চনা আর উপেক্ষা যেন তার জীবনের রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধকে বিস্বাদ পান্ডুর করে তুলেছে। দুর্বিসহ জীবনের অক্টোপাস বন্ধনে জড়িয়ে গেল তার সব চাওয়া-পাওয়া।
ছাতকের পাক সেনার ব্যারিকেট থেকে সিপাইরা বেতাউকা গ্রামে এসে একদিন উঠিয়ে নিয়ে গেলো সালমাকে। মিথ্যে অভিযোগ। স্বামী মুক্তিযোদ্ধা। রাত ভর ব্যারাকে রেখে খান সেনার বড় অফিসার তার সমস্থ শরীর খাবলে খেয়েছে। তারপর ছেড়ে দিয়েছে জুনিয়র অফিসারদের হাতে। কয়েক রাত তাকে নিয়ে তাদের মনের ক্ষুধা মিটিয়েছে। শরীরের কোন একটি অঙ্গ হায়ানার ছোবল থেকে রক্ষা করতে পারিনি সালমা। নর-পিচাস এই অফিসারটির সাথে সালমার বাবার কি সুসম্পর্ক। বাবার আকুতি মিনতী কিছুই মেয়ের সম্ভ্রমকে পাষন্ড হায়ানাদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি।
যে বাবা খানসেনাদেরে দেবতার মতো ভক্তি করতেন। যাদেরকে বাড়ী এনে আদর আপ্যায়ন করে নিজেকে ধন্য মনে করতেন সেই দেবতারাই তার মেয়েকে তার সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেল। পরিপূর্ন রক্তিম গোলাপকে কয়েক রাত উপর্যূপরি ধর্ষনের পর একদিন স্বচ্ছ সিক্ত কাগজে মুড়ে দুমড়ে তার দৃষ্টির সামনে পায়ের কাছে ডেলা করে ছুড়ে ফেলেদিল। বনের হিংস্র পশু উচ্ছিষ্ট খাবার ছুড়ে মারে যেমন ঠিক তেমন।
একদিন যে বাবা যাদের তাবেদার সেজে মুক্তিযোদ্ধদের ধরিয়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির রূঢ় হাসিতে নিজের প্রান জোড়াতেন সেই তিনিই নিজের একমাত্র মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে খানসেনাদের দ্বারেদ্বারে ঠুকর খেয়েছেন। পায়ে ধরে ভিক্ষে চেয়েছেন। পাষন্ডদের হৃদয় গলেনি। যে অফিসাররা তার মেয়ের শরীর খাবলে খেয়েছে একদিন বাবাই এদের বাড়ীতে এনে মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েকে দিয়ে আপ্যায়ন করতে দিয়েছিলেন। পাক সেনাদের গর্ব করে বলেছিলেন,
-এ মেরা লারকী হে। খুব আচ্ছি হে। হিঃহিঃহি।
-উস্কা শাদী হ গিয়া ? লোভাতুর দৃষ্টি মেলে এক জোয়ান অফিসার প্রশ্ন করে।
-শাদী দে দিয়া। জামাই বড়া চাকরী করতা হে শহর মে।
-মুক্তিফৌজমেতো নেহি হে ?
-তওবা, তওবা খান সাহেব কিয়া বলরাহে। মেরা খানদানমে কই ইছমে যা ছাকতে।
-এ তো মালুম হে। বাঙাল কই আদমিকো হাম আদমিকো একিন নেহিহে।
-বাঙাল শালা আদমিকো একিন নেহিতো কিয়া হাম আদমিতো বাঙাল নেহি হে। পাকিস্তানী হে।
-সালমা বেগম ঐ পাকিস্তানীদের কেন জানি তখন থেকেই ভয় করছিলেন। তাদের লোলুপ দৃষ্টি সালমা বেগমের প্রতি অঙ্গকে যেন চেটেচেটে খাচ্ছিল। অন্যদৃষ্টি দিয়ে সালমা বেগম ষ্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন তাদের কুদৃষ্টি তার গুমটা,এবং শরীরে লেপটে থাকা সেলওয়ার কামিজ ভেদ করে উদাম শরীরে গিয়ে সূচের মত বিধছে। তড়িৎ সরে এসে তিনি তাদের কুদৃষ্টির আড়াল হন।
-পাকিস্তানীরা এক সাথে হেসে উঠে। তাদের হাসি হায়নার বিধগুটে চিৎকার মনে হয়।
-আপকা লারকী খুব সরমিন্দা হে। খুবসুরতবি। হায়নার একজন সালমার রূপের তারিফ করে।
-ফকির চেয়ারম্যান খুশিতে ডগবগে হয়ে উত্তর দেন
-খান সাহেব যে কিয়া বলতা হে। আবার হাসেন। মনে হয় মেয়ের প্রশংসায় তিনিও খুশি।
এই হায়নারাই পরের দিন সালমা বেগমকে তুলে নিয়ে যায়। সালমার দৃঢ় বিশ্বাস পাকিস্তানী কোন এক হায়ানার রক্তই বইছে তার একমাত্র সন্তান আযমের শরীরে। আযম কখনই স্বামী শামসুদ্দিন সাহেবের সন্তান হতে পারেনা। হলে সে কখনো জামাতের রাজনীতিতে বিশ্বাসী হতো না।
(একটি গল্পের খন্ডিত অংশ)
মহি জামান: অতিথি লেখক, গল্পকার।
–