আবুল লেইস মিয়া: কোভিড কেড়ে নিলো আরও এক মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট                 সত্যবাণী

লন্ডন: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত সংগ্রহে লন্ডনের রাজপথের বিরামহীন উচ্চকন্ঠ, তৎকালীন তরুণ সংগঠক আবুল লেইস মিয়া আর নেই। অপ্রতিরোধ্য করোনা ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে তাঁর জীবন প্রদীপ। শুক্রবার লন্ডন সময় বিকেলে লন্ডনের নিউহামস্থ নিজ বাসায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহ ই ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৬ বছর। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ৩ ছেলে ও ২ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজন, রাজনৈতিক সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। জনাব মিয়ার মৃত্যুর ১০ ঘন্টা আগে একই দিনে মৃত্যুবরণ করেন তাঁর বড়ভাই আলহাজ্ব আকদ্দস আলী। প্রয়াত দুই ভাইয়ের জানাজা ও দাফনের বিষয়ে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার মীরপুর ইউনিয়নস্থ শ্রীরামসি গ্রামের সন্তান, মীরপুর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মরহুম মখলিছ মিয়ার দুই ছেলে আবুল লেইস মিয়া ও আকদ্দস আলীর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বিলেতের বাঙালী কমিউনিটিতে।

সদ্য প্রয়াত আবুল লেইস মিয়া একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগ্রহে একজন তরুণ সংগঠক হিসেবে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত ও তহবিল সংগ্রহে মুক্তিযুদ্ধের তৎকালীন অন্যতম শীর্ষ সংগঠক গৌস খানের সাথে ঐসময় তিনি সারা ব্রিটেন চষে বেড়ান। ট্রাফালগার স্কোয়ারসহ ব্রিটেনের প্রতিটি বড় বড় ক্যাম্পেইন সমাবেশে আবুল লেইস মিয়ার ছিলো সরব উপস্থিতি। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে তাঁর ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতাই মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তাঁকে তৎকালীন সিনিয়র নেতাদের নজরে নিয়ে আসে। ১৯৭৫ সালে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর শত ভয়ভীতি উপেক্ষা করে এর প্রতিবাদে আবারও রাজপথে সোচ্চার হন আবুল লেইস মিয়া। ঐসময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবী ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রাখতে নিরলস ভূমিকা পালন করেন তিনি। তার ঐ ভূমিকার পুরস্কার হিসেবেই পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রথমে তাঁকে দলের লন্ডন শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে যুক্তরাজ্য কমিটির সহসভাপতি নির্বাচিত করে। ৭৫ পরবর্তী স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনেই আবুল লেইস মিয়ার ছিলো নেতৃস্থানীয় ভূমিকা।

লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাতরত আবুল লেইস মিয়া

 

বিভিন্ন মহলের শোক
একই দিনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবুল লেইস মিয়া ও তাঁর বড় ভাইয়ের জীবনাবসানে শোকের ছায়া নেমে এসেছে বিলেতের বাঙালী কমিউনিটিতে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠেছে শোকের ঝড়। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, সাবেক এমপি শফিকুর রহমান চৌধুরী, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, যুক্তরাজ্য শাখাসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে গভীর শোক।

যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি সুলতান মাহমুদ শরীফ, সহসভাপতি হরমুজ আলী, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নঈম উদ্দিন রিয়াজ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আহাদ চৌধুরী এক যৌথ শোকবার্তায় প্রয়াত আবুল লেইস মিয়াকে বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের একজন অগ্রণী সংগঠক আখ্যায়িত করে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল ও এর পক্ষে বিশ্বজনমত সংগ্রহে ৭১ এর পুরো সাড়ে নয় মাস আবুল লেইস মিয়া ছুটে বেড়িয়েছেন বিলেতের প্রতিটি শহরে। তাঁর এই অবদান প্রবাসী হিসেবে আমাদেরও গৌরবান্বিত করে’।
সাবেক এমপি ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী তাঁর শোকবার্তায় আবুল লেইস মিয়াকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমৃত্যু অবিচল একজন মানুষ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম তরুণ সংগঠক ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাবেক সহ সভাপতি, লন্ডন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল লেইস মিয়া ‘৭৫ পরবর্তী যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা পালন করেন। আমি ৮০ সালে যুক্তরাজ্যে আসার পর আদর্শিক কারণে যে মানুষটির সাথে প্রথমেই ঘনিষ্ঠতা জন্মায় তিনি আবুল লেইস মিয়া। নতুন দেশে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সভা সমিতিতে তিনিই আমাকে নিয়ে যেতেন। একসাথে বহু বছর কাজ করার মাধ্যমে এক বিশেষ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে তাঁর সাথে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আমৃত্যু অবিচল এই মানুষটি রাজনীতির পাশাপাশি কমিউনিটির বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামেও ছিলেন সোচ্চার। জননেত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র আবুল লেইস মিয়ার অকালে চলে যাওয়া আওয়ামী লীগ এবং কমিউনিটিতে এক বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি করবে। আমি বঙ্গবন্ধু অন্তপ্রান আবুল লেইস মিয়া এবং তাঁর ভাই অত্যন্ত সাদা মনের মানুষ আকদ্দস আলীর রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং তাঁদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।

মরহুম আবুল লেইছকে ‘লিবারেশনের ড্রাইভার’ উল্লেখ করে এমসি কলেজের সাবেক ভিপি এবং সিলেট জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি জনাব নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৭১ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যেসকল তরুণ তুর্কি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন মরহুম আবুল লেইস সাহেব। আওয়ামী লীগ নেতা ও কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব গৌছ খান সহ নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এক শহর থেকে আরেক শহর গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ঐক্যবদ্ধ করতে, তহবিল সংগ্রহ ও আন্দোলন সংগঠনে তাঁর ভূমিকা ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য আনসার আহমেদ উল্লা, যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি নুরউদ্দিন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক জামাল খান তাদের শোকবার্তায় প্রয়াত আবুল লেইস মিয়াকে যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলনের একজন সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী হিসেবে তুলে ধরেন। তারা বলেন, ‘নির্মূল কমিটির যুদ্ধাপরাধী বিরোধী আন্দোলনে তিনি আর্থিকভাবেও সাহায্য করেছেন’।
অন্যান্যের মধ্যে যুক্তরাজ্য যুবলীগের সভাপতি শফিউল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম আহমদ খানও গভীর শোক প্রকাশ করেন আবুল লেইস মিয়ার মৃত্যুতে।
শোক প্রকাশকারীরা তাদের শোকবার্তায় প্রয়াত আবুল লেইস মিয়া ও তাঁর বড় ভাই আকদ্দুস আলীর আত্মার মাগফেরাত কামনা ও তাদের শোক সন্তপ্ত পরিবার পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।

উল্লেখ্য, এর আগে গত সপ্তাহে কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের আরেক ক্যাম্পেনার মজুমদার আলী।

You might also like