গোপন সীমানা
শামীম আহমদ তালুকদার
পর্ব-৪
স্বপ্নের নগরী লন্ডন শহর ভ্রমনের স্বপ্ন আমাকে শুধু ঘায়েলই করেনি, ক্ষত বিক্ষত করে জানতে চেয়েছে লন্ডন যাওয়ার স্বপ্ন কি আর দেখবে ? রক্তে লাল এ আহত হৃদয় নিরবে নিবৃতে হ্যা বলেছে। তার যেমন ভুল ছিলনা তেমনি ভুল আমারও ছিলনা। আমরা দুজনেই সম্পর্ক পরায়ন ছিলাম। সে রক্তের সম্পর্কের অনুভূতি দিচ্ছিল, আর আমি ভালবাসাকে হৃদয়ে লুকিয়ে পথ চলেছি। চার কদম সে চলেছে আমিও চার কদম চলেছি। পার্থক্য শুধু এখানেই ছিল, আমি পথ চলেছি দুরত্ব কমেছে আর তার পথ চলায় দুরত্ব বেড়েই গেছে। আসলে কারও প্রেমের প্রতিক্ষার চেয়ে ভবঘুড়ে থাকাই ভাল। কারও প্রেমে নিজেকে অশান্ত করা চরম বোকামী। যেখানে চেয়ে অধিকার আদায় করতে হয় সেটা সম্পর্ক হতেই পারেনা। যে ভালবাসাকে ঘুম জাগানিয়া গান শুনাতে হয় সেটা ভালবাসা হতে পারেনা। প্রেমতো এক নির্বাক অনুভূতি। ভাষায় যদি প্রকাশ করতে হয় তাহলে সেই অনুভূতিই বা কি ? তবুও অশান্ত এই মন আনমনে স্বপ্ন দেখে। রং তুলিতে মোহিনীর ছবি অংকন করে। আসলে স্বপ্ন দেখে বলেই মানুষ বেঁচে আছে। স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বেঁচে থাকতে পারেনা।
বাবা, মা, ভাই-বোনদের পাশে তিন বছর পর এসে স্বর্গীয় সুখ অনুভব করেছি। বিশেষ করে বলবো বাবা মানেই আপনজন, বাবা মানেই নির্ভরতা, বাবা মানেই প্রখর রোদে শীতল ছায়া দেয়া উঁচু বটবৃক্ষ। বাবার বুক পরম নির্ভরতার, যেখানে এক নিমিষেই পৃথিবীর সব ভয়কে জয় করে নিতে পারে সন্তান। অনেক আদর-একটু শাষন, আশ্রয় প্রশ্রয় আর মমতায় মাখা বাবা স¯েœহে সন্তানকে আগলে রাখেন বুকে। তাই বলা হয়ে থাকে বাবা মানে সব আবদারের এক অফুরন্ত ভা-ার। বাবা আবারো নতুন করে সাহস সঞ্চার ও স্বপ্ন দেখতে শিখিয়ে দিলেন।
বাড়িতে ফেরার খবর পেয়ে আতœীয় স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি ¯েœহের পরশে একে একে সাবাই দেখতে আসেন। প্রবাসের দিনগুলো কেমন কেটেছে এমন গল্প করেই আনন্দে সময় কাটছে। হঠাৎ আসলেন আমাদের সবার প্রিয় জাহির চাচা। তিনি আমার কাছ থেকে প্রবাস জীবনের গল্প শুনলেন। এর পর একটি গল্প বলার জন্য তার কাছে আবদার করলাম। তিনি না বলতে পারছেননা। মৃদু হেঁসে গল্প শুরু করলেন।
কোন এক গ্রামের রাস্তা দিয়ে তিন বন্ধু হেঁটে যাচ্ছিল। পথ চলতে চলতে এক বন্ধু বললেন এই রাস্তা দিয়ে একটা গাভী হেঁটে গিয়েছে। তার এই কথা শুনে অপর বন্ধু বললেন গাভীটি ৭-৮ মাসের গর্ভবতী ছিল। তৃতীয় বন্ধু বললেন গাভীটির এক চোখ অন্ধ ছিল। এদিকে এই রাস্তা দিয়ে হারিয়ে যাওয়া একটি গাভীর সন্ধ্যানে হাঁটছিলেন একজন কৃষক। তিনি ঐ তিন বন্ধুর কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন। কারন তাদের কথাবার্তার সাথে কৃষকের হারিয়ে যাওয়া গাভীটির হুবহু মিল রয়েছে। ঐ তিন বন্ধুর প্রতি কৃষকের সন্দেহ হল। তিন বন্ধুকে নিয়ে রাজা’র দরবারে গেলেন কৃষক। কৃষকের নিকট থেকে রাজা অভিযোগ শুনলেন। ঐ তিন বন্ধু’র নিকট জানতে চাইলেন গরু যদি আপনারা নিয়ে না থাকেন তাহলে কি করে বুঝলেন ঐ গাভীটি ৭-৮ মাসের গর্ভবর্তী, এক চোখ অন্ধ ও এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে গিয়েছে। তিন বন্ধু জবাব দিলেন আমরা (আন্দাজ) অনুমান করে বলেছি। তাদের জবাব শুনে রাজা বললেন তোমাদের মারাত্বক আন্ধাজ। এই মারাত্বক আন্ধাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই। ঐ তিন বন্ধুর একজন বললেন, রাস্তার পাশে ফসলি জমির ধান গাভীটি উপরের অংশে (আগায়) খেয়েছে। যদি ষাড় হত তাহলে ধানের শীষের গোড়া (নিচ) পর্যন্ত খেয়ে নিতো। এতে আন্দাজ করেছি এইটা গাভী ছিল। দ্বিতীয় বন্ধু বললেন, দ’ুপাশেই ফসলি জমিতে ধান লাগানো রয়েছে। কিন্তু গাভীটি এক পাশে খেয়েছে। এর থেকে আন্দাজ করলাম গাভীটির এক চোখ অন্ধ ছিল। এক চোখ অন্ধ না হলে দু’পাশেরই ধান খেয়ে যেতো। তৃতীয় বন্ধু বললো, গাভিটি সামনের দ’ুপায়ের অপেক্ষা পিছনের দুটি পা মাটিতে বেশি ধেবেছে। পেটে বাচ্চা থাকায় ওজন বেশি হওয়াতে পেছনের পা দুটি মাটিতে বেশি ধেবেছে। এর থেকে আন্দাজ করলাম গাভীটি ৭-৮ মাসের গর্ভবর্তী হবে। রাজা চমকে গেলেন। তিন বন্ধ’ুর মারাত্বক আন্দাজের ভূয়ুসী প্রশংসা করলেন। রাজমহলে তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। যতারিতি আপ্যায়ন করা হল।
খাবার খেতে গিয়ে তিন বন্ধ’র মধ্যে কথা বার্তা চলছে। এক বন্ধু বললেন যে মহিলা রুটি তৈরি করেছেন তার মাসিক চলছে। অপর বন্ধু বললেন রাজার জন্মের ঠিক নাই। রাজা একটু দুরে বসে তিন বন্ধুর মধ্যেকার কথা শুনছেন। তিনি অনেকটা ক্ষিপ্ত ও রাগান্নিত হয়েছেন। রাজার যে জন্মের ঠিক নাই এ কথা রাজার অজানা নয়। খাবার শেষে তিন বন্ধুকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। আপনারা বলেছেন রুটি যে মহিলা তৈরি করেছে তার মাসিক চলছে আর রাজার জন্মের ঠিক নাই। এই কথাগুলো কি করে বুঝলেন ?
তিন বন্ধু জবাব দিলেন, যে কয়েকটি রুটি খেয়েছি প্রত্যেকটি রুটির মধ্যখানে শক্ত (গোঠা) ছিল। এতে আন্দাজ করেছি, যে মহিলা রুটি তৈরি করেছেন তার মাসিক চলছে। বাড়ীতে মেহমান আসলে মেহমানের সাথে বসে মেজবানও খাবারা খাওয়া সৌজন্যতাবোধ। কিন্তু আমাদের খাবার দিয়ে আপনি দুরে বসে ছিলেন। এতে আন্দাজ করলাম আপনার জন্মের ঠিক নাই। জন্মের ঠিক থাকলে মেহমানের সাথে বসে খাবার খেতেন। আমার প্রবাসের গল্প শুনে জাহির চাচা কষ্ট পেয়েছেন। সরাসরি গালিও দিতে পারছেননা। তাই গল্প বলে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন কথা দিয়ে যে কথা রক্ষা করেনা তার জন্মের ঠিক নাই।
সমাজবদ্ধ পৃথিবীতে মানুষের জীবনযাত্রায় প্রতিবেশীর গুরুত্ব অপরিসীম। দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনায় এ প্রতিবেশীই মানুষের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবেশির হক বা অধিকারের প্রতি সেভাবেই লক্ষ্য রাখা উচিত যেভাবে প্রতিবেশিদের একজন অপর জনের বিপদ-আপদে সাহায্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদিও আত্মীয় স্বজনের হক বেশি কিন্তু সামাজিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে প্রতিবেশির হক বা গুরুত্বও কম নয়। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে প্রতিবেশির হকের ব্যাপাওে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জেনেছি। প্রতিবেশির হক আদায় না করে দাতা হাতেম তাই হলেও স্বর্গ সুখ সইবেনা। তারা দুনিয়ায় বেহেস্ত লাভ করলেও কিয়ামতের মাঠে মহান আল্লাহর দরবারে জবাব দিহিতা করতে হবে। জন্মের ঠিক না থাকলে কথা দিয়ে কথা রাখবেনা। আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশীর দুঃখ কষ্ট আনন্দ বেদনা বুঝবেনা। দাওয়াত দিয়ে পেট ভরে খাওয়াবে ঠিক কিšুÍ লাথি মেরে বাহির করে দিবে। জহির চাচার গল্প থেকে মানুষ চিনতে পারার কিছু কৌশল রপ্ত করা যায়।
ভাবছি স্বপ্ন আমাকে তাড়া করছে না আমি স্বপ্নকে তাড়া করছি। এবাবেই বাবার ব্যাবসা প্রতিষ্টান দেখা শুনা করে কয়েক মাস কাটিয়ে দিলাম। এর পর ২০০০ সালের শুরুতে আরেকটি ফ্রি ভিসা নিয়ে যাত্রা করলাম সৌদিআরবের জেদ্দা শহরে। শহরের মুছনা বাজার (বাংলাদেশী অধ্যুষিত) এলাকায় বাসার মধ্যে একটি হোমিওপ্যাথি ফার্মেসী চালু করি। সে দেশে হোমিওপ্যাথিক ফার্মেসী করার কোন নিয়ম নেই। অনেকটা লুকিয়েই চিকিৎসা দিতে হত। বেশ ভালই চলছিল। কিন্ত মরার উপর খরার ঘা। কফিল আব্দুল্লাহ সালেহ (তুরমানী) হঠাৎ ফোন করে তায়েফ যেতে বললেন। হোমিওপ্যাথিক ফার্মেসীর সকল ঔষধ পত্র রেখেই চলে গেলাম তায়েফ শহরে।
সৌদি আরবে প্রায় ছয় হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ে তায়েফ নগরী। মক্কা থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুরো তায়েফ শহরটিই গড়ে উঠেছে পাহাড়ের ওপর। অসাধরন রিং রোড। হজরত মুহাম্মদ (সা.) পায়ে হেঁটে বিরান এ পাহাড়ে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে দশ দিন অবস্থান করেছিলেন, হয়েছিলেন রক্তাক্ত। তায়েফ শহরে গিয়ে কফিলের বিল্ডিংয়ের পেইন্টিং এর কাজ শুরু করলাম। তার ভবনের কাজ শেষ করতে প্রায় এক বছর সময় লেগে যায়। ইতোমেধ্য নিজেই কাজ শিখে নিয়েছি। কফিলের সাথে চুক্তি করে তার ঠিকাদরি প্রতিষ্টানের নামে শুরু করি ঠিকাদারি। তায়েফ শহরে বাংলাদেশীরা সংখ্যায় একেবারে নগন্য। স্বল্প সময়ে অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছে। তার মধ্যে ব্রাম্মনবাড়িয়ার আলমগীর হোসেন, কুমিল্লার জিয়া ও হোসেন। আমরা খুব ভাল বন্ধু হতে পেরেছিলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এখনো প্রিয় মানুষগুলোর সাথে যোগাযোগ হয়। অসাধারন এক অনুভূতি, ভাললাগা।
এরই মধ্যে পাঁচতলা একটি ভবনের কাজের চুক্তি সম্পাদন করেছি। ছয়মাসের মধ্যে কাজ শেষ করে দিতে হবে। বাহির দিকে দুজন শ্রমিক নিয়েছি। এক কক্ষেই থাকি ছয়জন। এরই মধ্যে আব্দুল আলিম নামে কর্মরত এক শ্রমিক ইন্দোনেশিয়ান এক (খাদ্দামা) গৃহপরিচারিকার প্রেমে পড়ে গেলে ঘটে যায় লষ্কাকান্ড। তাদের প্রেম শারীরিক সম্পর্ক পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। এখানেই শেষ নয় ঐ ইন্দোনেশিয়ান প্রেমিকা দুই মাসের অন্তসত্বা। যে দেশে চুরি করলে হাতা কাটা যায়, ‘ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণী উভয়কে একশ’ ঘা করে বেত্রাঘাত করা হয় সেই দেশে এমন জগন্য কাজ। ভাবতেই গা শিউরে উঠে। জিনা বা ব্যভিচার ইসলামসহ পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থে ঘৃণিত ও জঘন্য অপরাধ। আব্দুল আলিমের প্রতি প্রচন্ড একটা ঘৃনারও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্ত এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য কান্না কাটি করছে আব্দুল আলিম। একেবারে নাছোড় বান্দা। কিন্ত কিভাবে এই অপকর্ম সংগঠিত করেছে তার কিছুই বলতে চাইছেনা আব্দুল আলিম। একশ’ ঘা করে বেত্রাঘাত এর ভয়ে বোবা হয়ে গেছে না তাকে ফাঁসানো হয়েছে এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে। তার ঘনিষ্ট এক বন্ধু বলেন, ব্যক্তি জীবনে আব্দুল আলিম বিবাহিত। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান রয়েছে তার। প্রাবাসে আসার আগে ১৭ বছরের কিশোরী মেয়েকে বাল্য বিবাহ দিতে গিয়ে প্রসাশনের নজরে আসে। শেষ পর্যন্ত লুকিয়েই মেয়ের বিয়ে সম্পন্ন করে। আব্দুল আলিম বিয়ে করার আগে এক শিক্ষিকার ছবি বিকৃত করে ফেসবুকে পোষ্ট করে পর্নোগ্রাফী আইনে মামলার আসামীও হয়েছিল। আন্দাজ করছি যদি তা সত্য হয় তবে তার জন্মের ঠিক নাই। ফার্মেসীতে কর্মরত ভারতের এক ফার্মাসিস্টকে ম্যানেজ করে তার প্রেমিকাকে ঔষুধ দেওয়া হলো। কিন্ত তিন পর প্রেমিকা জানালে ঔষধের কার্যকরিতা মিলছেনা। খবর শুনে আব্দুল আলিম অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। ক্ষনিকের আবেগ অনুভূতির ভয়াভয় পরিনাম দেখে আব্দুল আলিম হয়তো অনুতপ্ত। তার চেহারায় এমন চিত্র দেখতে পেলাম। ক্ষমা লাভের মাধ্যম হচ্ছে তওবা। আল্লাহর নিকট খাঁটি তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। শেষ পর্যন্ত আব্দুল আলিম প্রেমিকার হাতে তিন হাজার রিয়াল ধরিয়ে দিয়ে ইন্দোনেশিয়া চলে যেতে বলেন। কিন্ত রিয়াল নেওয়া পরও মেয়েটি তার দেশে ফিরে যায়নি। অন্তসত্বা প্রেমিকার এমন কান্ড দেখে হতবাক সবাই। আব্দুল আলিমকে কাজ বন্ধ করে আত্ম গোপনে চলে গেলেন। এই ঘটনার রহস্য উদঘাটনে সবাই মরিয়া হয়ে উঠলেন।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী