লন্ডনে ‘নারী নির্যাতন বিরোধী মঞ্চ’ এর আয়োজনে প্রতিবাদী অনুষ্ঠান

নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
বার্তা সম্পাদক, সত‍্যবাণী

লন্ডন: দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া রুখতে পারেনি নারী জাগরণ। গতকাল ২৬ শে মে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংগঠিত নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিলেন বিপুল সংখ্যক নারী পুরুষ এবং নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা।

বাচিক শিল্পী মুনীরা পারভীনের প্রাণবন্ত উপস্থাপনা এবং সাংবাদিক নিলুফা ইয়াসমীন হাসানের সূচনা বক্তব্য, দলীয় নৃত্য, পথ নাটক, দলীয় সংগীত, বৃন্ত আবৃত্তি এবং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আলোচক অর্থনীতিবিদ ড.সেলিম জাহান, ড. হাসনীন চৌধুরী, ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন, সৈয়দ এনাম, পুষ্পিতা গুপ্ত, স্নিগ্ধা মিষ্টি ও অন্যান্য বক্তাদের জোড়ালো বক্তব্যের মাধ্যমে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হয়েছে।

নারী নির্যাতন বন্ধে বিভিন্ন শ্লোগান সম্মিলিত পোস্টার-ফেস্টুন হাতে নিয়ে উপস্থিত সকলে শোভাযাত্রা সহকারে জাগরণের গান পরিবেশন করে ঐতিহাসিক আলতাব আলী পার্ক প্রদক্ষিণ করেন।

একাত্তরের কন্ঠযোদ্ধা হিমাংশু গোস্বামী অনুষ্ঠানে একক সংগীত পরিবেশন করেন।

‘জাগো নারী জাগো’ ও ‘ভয় কি মরনে’ গানের সাথে নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন বুলবুল অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস বাফা ইউ কে’র শিল্পীবৃন্দ। বাংলাদেশের নৃত্যে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত নৃত্য শিল্পী রুবাইয়াত শারমিন ঝরা, কাজী ফারহানা আখতার ও মেহেবুবা লিথি।

পথ নাটকে অংশগ্রহণ করেছেন, মাহফুজা তালুকদার, ইফফাত আরা খানম, নূরুল ইসলাম, মুজিবুল হক মণি, হেলেন ইসলাম, হীরন বেগ ও মতিউর তাজ।

বৃন্ত আবৃত্তিতে অংশ গ্রহণ করেছেন ঊর্মি মাযহার, শাহাবুদ্দিন বাচ্চু, স্মৃতি আজাদ, ধনঞ্জয় পাল ও শতরূপা চৌধুরী।

একক কবিতা আবৃত্তি করেন কবি শামীম আজাদ, ডেভিড লী মর্গ্যান ও জাসমীন চৌধুরী। ঢোল বাজিয়েছেন সোহেল।

অনুষ্ঠানের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আয়োজকদের পক্ষে মাহফুজা তালুকদার।

সম্মিলিতভাবে দেশাত্ববোধক গান পরিবেশন এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাধ্যমে প্রতিবাদ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনুষ্ঠানে সংহতি জানিয়ে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন লোকমান হোসেন, আবু মুসা হাসান, গৌস সুলতান, মেফতাহুল ইসলাম ও ফয়জুর রহমান খান। আরো যারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন, মাহমুদ এ রউফ, ড. আনসার আহমেদ উল্লাহ, সত‍্যবাণী সম্পাদক সৈয়দ আনাস পাশা, কাউন্সিলার সৈয়দা সায়মা আহমেদ, প্রশান্ত দত্ত পুরকায়স্থ, হামিদ মোহাম্মদ, মাহমুদ হাসান মিঠু, আলিমুজ্জামান, আহবাব হোসেন, জান্নাত, সৈয়দ হামিদুল হক, অসীমা দে, সত্যব্রত দাস, নিধি প্রমুখ।

ড. সেলিম জাহান বলেন, পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ন্যায্যতার ভিত্তিতে হতে হবে। রাজনৈতিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে যুথবদ্ধভাবে নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে আমরা যুদ্ধ করেছি, সেখানে বিভাজন ছিলনা। যখন সুযোগের ব্যাপার আসে তখন নারীকে বঞ্চিত কর হয়, নির্যাতন করা হচ্ছে, সহিংস আচরণ করা হয়। এই লড়াইটা সবার। নারী-পুরুষ সবাইকে মানবাধিকারের জন্য একসাথে কাজ করতে হবে।

সমাবেশে বাংলাদেশে চলমান নারী নির্যাতনের তীব্র সমালোচনা করে ড. নাজনীন হাসনাইন বলেন, আসুন আজ আমরা সমবেতভাবে আওয়াজ তুলি, যথেষ্ঠ হয়েছে, আর নয়, নৃশংসতা বন্ধ কর, নীরবতার অবসান ঘটাও, বর্বরতা বন্ধ কর ।

ড. হাসনাইন তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের সর্বত্র বহু নারী ও মেয়েরা মুক্তভাবে বসবাস করতে পারছেন না, তারা বসবাস করছেন ভীতির মধ্যে। অথচ এরাই হচ্ছে আমাদেশের জাতির প্রাণ। নারী সমাজই আমাদের পরিবারকে লালন পালন করেন, আমাদের অসুখ বিসুখে সেবা শুশ্রূষা করেন, তারই আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। কিন্তু তথাপি তারা প্রতিদিন ভর্ৎসনার শিকার হচ্ছেন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, আমাদের আজ পরিস্কারভাবে বুঝতে হবে যে, এইগুলো আমাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক বিষয় নয়- এগোলো হচ্ছে নৃশংসতা ও বর্বরতা । তিনি বলেন, এগুলো শুধুমাত্র নারী এবং মেয়েদের বিষয় নয়, এই বর্বরতা আমাদের জাতীয় জরুরি অবস্থার শামিল, মানবতার প্রতি আঘাত এবং বাংলাদেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই বর্বরতাকে জাতীয় জরুরি অবস্থা বিবেচনা করেই মোকাবেলা করতে হবে। কারন অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠী যদি এইধরনের আতঙ্কের মধ্যে বাস করে, তাহলে আমরা শান্তিপূর্ণ সমবৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়তে পারবোনা। জাতিসংগের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের ভাষায়, উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়নের চেয়ে অন্য কোন উপায় নাই। তিনি বলেন, ‘নারী জাগলে বাংলাদেশ জাগে, নারী সসম্মানে বাঁচলে দেশের ভবিষ্যত হয় উজ্জ্বল।’

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বর্তমানে নারীরা বাড়ীতে, কর্মক্ষত্রে, বাসে, লঞ্চে নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতিকৃতিতে জূতো পেটা, নারীর বস্ত্র হরনে সমগ্র নারী জাতি অপমানিত। দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীদের পেশা, পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজ-সজ্জা, মাথায় কাপড় না দেয়া, একা একা ঘোরাফেরা বা বেড়ানো নিয়ে প্রকাশ্য জনসমক্ষে হয়রানি, নির্যাতন ও মারপিট করা হচ্ছে। কিছু মানুষ একত্রিত হয়ে এগুলো করছে আর অনেক মানুষ সেটা নীরবে দেখছে। অনেকে তাতে উৎসাহ যোগাচ্ছে, মোবাইলে লাইভ করছে, ছবি তুলে বা ভিডিও করে ভাইরাল করছে। অনেকে আবার এগুলোকে জনতার বিচার বলেও দাবি করছে।

সকল বয়সের, সকল শ্রেণি-পেশার নারীই প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে, রাস্তা-ঘাটে, যানবাহনে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, এমন কি আনন্দানুষ্ঠানেও যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণসহ নানা ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বা এই আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকছে। এটা নতুন কোন বিষয় নয় কিন্তু নারীর উপর এই অপরাধ আমরা চাই না, তাই এর বিরুদ্ধে আমরা আওয়াজ তুলছি, নারীর উপর সকল ধরনের হয়রানি, নির্যাতন, সহিংসতা, অবিচার প্রতিরোধ ও প্রতিকারে জোরালো ভূমিকা রাখে, কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং প্রত্যেক অপরাধীর বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে। সহিংসতামুক্ত নারীর জীবন হউক, নারীর অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত হউক।

You might also like