আজ শহীদ আলতাব আলীর ৪২তম শাহাদাত বার্ষিকী
শেখ মহিতুর রহমান বাবলু
শহীদ আলতাব আলী।ব্রিটেনে বাংলাদেশিদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক।বাড়ী সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকে।পেশায় ছিলেন একজন বস্ত্র শ্রমিক।টগবগে যুবক। চোখে মুখে এক সাগর স্বপ্ন।১৯৬৯ সালে জীবিকার তাগিদে বাংলাদেশ থেকে আসেন সাগর পাড়ের লন্ডনে।নিজের ও পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে।১৯৭৮ সালের ৪মে।সেদিন ছিল স্থানীয় সরকার নির্বাচন।মার্গারেট থাসার ক্ষমতায় আসার বছর।প্রথম ভোটাধিকার পেয়ে ভোট দিতে যাবেন আলতাব ।কত স্বপ্ন কত আকাঙ্খা।কিন্তু না তার আর ভোট দেয়া হলো না।স্বপ্নগুলো থেতলে গেলো লন্ডনের রাজপথের কালো আলকাতরায় মিশে।সেদিন কাজ শেষে বাজার নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন আলতাব আলী।পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে অজ্ঞাত তিনজন কিশোর পিছু নিলেন তার।কিছু বুঝে উঠবার আগেই পিছন থেকে অতর্কিত বর্ণবাদী হামলার শিকার হলেন আলতাব। ছুরির আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হলো তার ঘাড় সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ।রক্তে ভেজা শরীর নিয়ে আত্মরক্ষায় পালাতে চেষ্টা করলেন।কিন্তু কয়েক মিটার যেতেই ধড়াম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।পাড়ি জমান না ফেরার দেশে । রক্তের বন্যায় রঞ্জিত হয় লন্ডনের পিচ ঢালা কালো পথ।জীবনের সব স্বপ্নের ইতি টানেন শহীদ আলতাব আলী।
পরে পুলিশ সূত্রে জানা যায় সেটি ছিল বর্ণবাদী হামলা। সন্ত্রাসীরা আলতাব আলীকে চিনতো না। অন্য বর্ণের মানুষকে মারাই ছিল এদের উদ্দেশ্য।সত্তরের দশকে ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে ।বহিরাগতরা কোথাও নিরাপদ ছিল না।সন্ধ্যার পর একা একা চলা ছিল ভীষণ বিপদজনক। প্রায় তারা আক্রান্ত হতো বর্ণবাদী হামলার।সরকারি ফ্ল্যাটবাড়িতে যারা থাকতো, তাদের প্রতিবেশিরা তাদের সঙ্গে প্রায়ই দুর্ব্যবহার করত। তারা জানালার কাঁচ ভেঙে দিতো। দরোজার সামনে ,লেটারবক্সের মধ্যে ময়লা আবর্জনা ফেলে দিত । জীবন দুর্বিষহ করে তুলত।বাংলাদেশিদের রেস্তোরায় বিনা পয়সায় খেতে অভিনব পন্থা অবলম্বন করতো।খাবার অর্ডার করতো অনেক। শেষ মুহূর্তে পকেট থেকে চুল নখ বা এই ধরণের কিছু, উচ্ছিষ্ট খাবারে সাথে মিশিয়ে অভিযোগ ছুড়ে দিতে কতৃপক্ষের উপর।তার পর খাবারের বিল না দিয়ে বেরিয়ে যেত রেস্তোরা থেকে।তখন বাংলাদেশিদের ঘরের দরোজায় মূল মূত্র ত্যাগ করা ছিল স্বাভাবিক ঘটনার অংশ বিশেষ। রাতে বাসার জানালা খোলা পেলে নিক্ষেপ করা হতো সিদ্ধ ডিম্ ,পচা ডিম্ ইট পাটকেল ইত্যাদি। পাকিস্তানি ও আফ্রিকানরা এ অত্যাচারের বিপক্ষে সোচ্চার থাকলেও বাংলাদেশিরা থাকতো নীরব।মূলত এ ধরণের অন্যায় অবিচার সহ্য করতে হতো এদেশে বসবাসরত সব নিরীহ অভিবাসীদের ।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এমন অমানবিক নির্যাতনের খবর এদেশের গণমাধমে স্থান পাওয়া ছিল আকাশ কুসুম কল্পনা। বর্ণবাদী হামলার শিকার শুধু যে ব্যক্তিগত বা পারিবারীক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল তা না।বাংলাদেশিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হতো কারণে অকারণে। বর্ণবাদী হামলা রুখে দিতে সন্ধ্যার পর বাংলাদেশী যুবকদের একটা সংঘবদ্ধ দল ব্রিকলেন এলাকায় পাহারা দিতো।ইংলিশ মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বার রেস্তোরার সামনে লেখা থাকতো কুকুর ও কালো মানুষের প্রবেশ নিষেধ ।
শহীদ আলতাব আলীর অকাল মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জেগে উঠলো লন্ডনের নির্যাতিত বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী।প্রতিবাদী হয়ে উঠলো তারা। তখন পৃথিবী এতো প্রযুক্তি নির্ভর ছিল না। সবার হাতে হাতে থাকতো না মুঠো ফোন। কিন্তু তার পরেও মুখে মুখে খবর পৌঁছে গেলো সবার কানে।১৪ মে ১৯৭৮ ডাকা হলো প্রতিবাদ মিছিল।বাংলাদেশিরা ছাড়াও এ প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিলো বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা। বর্ণবাদী হামলায় আলতাব আলীর মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফেটে পড়লো হাজার হাজার মানুষ। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা পেলো । রাজপথে নেমে এলো মানুষ।আলতাব আলীর মৃত্যু এই আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করলো।ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো শহীদ আলতাব আলীর নাম।প্রায় ৭ হাজার মানুষ শহীদ আলতাব আলীর কফিন নিয়ে মিছিল করে রাস্তায় নেমে গেলো ।স্লোগানে স্লোগানে কম্পিত হলো লন্ডনের রাজপথ। তারা লন্ডনের কেন্দ্রে হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কোয়ার প্রদক্ষিণ শেষে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে কফিন মিছিল নিয়ে গেলো। বর্ণবাদের অবসানের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানানো হলো।সত্য যে শহীদ আলতাব আলী আর কোনো দিন ফিরবেন না।তবে লন্ডন তথা ব্রিটেনের রাজপথ অলি গলি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ করে গেলেন তার জীবনের বিনিময়ে।‘কোনো ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন কখনো বৃথা যায় না।’ আলতাব আলীর লাশ নিয়ে লন্ডনের রাজ্ পথে প্রতিবাদীদের মিছিল তারই জলন্ত প্রমান।এ ঘটনার পর অভিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকার সহজ শর্তে নিজ দেশ থেকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে আনার আইন শিথিল করেছিল ।শহীদ আলতাব আলীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৯৮ সালে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে অবস্থিত সেন্ট মেরিস পার্ককে আলতাব আলী পার্ক নামকরণ করা হয়। লন্ডনে একজন বাংলাদেশির নামে পার্ক বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশিদের নতুন সম্মান এন দেয়।বাংলাদেশী বিভিন্ন সংগঠনের দাবির মুখে ১৯৯৯ সালে আলতাব আলীর রক্তের উপর নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। যা দেশের বাইরে বানানো প্রথম শহীদ মিনার।এ শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য স্থানীয় কাউন্সিল সরকারের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের দক্ষিণ অংশে জায়গা বরাদ্দ করলেও শহীদ মিনার তৈরির খরচ প্রবাসী বাংলাদেশিদের বহন করতে হয়েছিল। শহীদ আলতাব আলীর স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে ইস্ট লন্ডন মসজিদ ও আলতাব আলী পার্কের মধ্যবর্তী বাস স্টপ এলডার স্ট্রিটের নাম আলতাব আলীর নামে নামকরণ করা হয়েছে ২০১৮ সালে।
প্রতিবছর আলতাব আলী ফাউন্ডেশন, আলতাব আলী মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট, সুন্দরবন ফাউন্ডেশন ইউকে ,স্বাধীনতা ট্রাষ্ট সহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও কমিউনিটি সংগঠনের সদস্যরা ভয়াল্ এই দিনটিকে স্মরণ করতে সমবেত হন আলতাব আলী উদ্যানের শহীদ মিনারে। ৪ মে কে আলতাব আলী দিবস ঘোষণার পাশাপাশি একে কাউন্সিলের উদ্যোগে পালন করা হচ্ছে গত ২০১৬ সাল থেকে । এদিন আলতাব আলী পার্কে মেয়র এবং বিভিন্ন সংগঠন কতৃক পুস্পস্তবক অর্পন, সংক্ষিপ্ত বক্তব্য এবং কবিতা আবৃত্তি হয়ে থাকে ।বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এবার আলতাব আলীর স্মরণে কোনো অনুষ্ঠান হবে না বলে জানিয়েছেন আলতাব আলী ফাউন্ডেশন সহ বিভিন্ন সংঘটন ।এদিকে সুন্দরবন ফাউন্ডেশন ইউকের এ দিনটি ঘিরে এবছর ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে দেশ বিদেশের এক ঝাঁক গুণী মানুষ নিয়ে আজ শুধুমাত্র একটি অনলাইন স্মরণসভার আয়োজন করেছে তারা ।
লেখক : Editor : Newslife24.com