আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস ও গুরুত্ব: নারীর অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে হোক বিনিয়োগ
‘’নারী দিবস পালন মানে পুরুষের বিরুদ্ধাচারণ নয়। নারী দিবস মানে অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির দিন, সারা বছরের প্রতিশ্রুত প্রতিজ্ঞার মূল্যায়নের দিন এবং ১৮৫৭ সালে যে সব নারী শ্রমিকরা ন্যায্য দাবী আদায়ের আন্দোলন করেছে, তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করার দিন’’
নিলুফা ইয়াসমীন হাসান
নারীর সমঅধিকারের লড়াইয়ের ইতিহাস অল্প দিনের নয়। ‘কেবলই নারী নই, আমিও মানুষ‘ এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে আজন্ম লড়াই করে আসছে সারা পৃথিবীর নারীরা। মানুষ হিসেবে প্রাপ্য অধিকারের দাবীতে সুদীর্ঘকাল থেকে লড়তে হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। নারী যুগ যুগ ধরে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তারপরও তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি এমনকি নারীকে অধঃস্তন করে রাখার মানসিকতার আজও কোন পরিবর্তন হয়নি। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন।
৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। প্রত্যেকটা দিবস পালনের উদ্দেশ্য হলো প্রতিপাদ্য নির্ধারণ, অসংগতি দূর করা, উত্তরণের উপায় উদ্ভাবন। যাদের আত্মত্যাগে কোন কিছু অর্জন করা হয়, তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে করণীয় যথাযথভাবে পালিত হয়েছে কি-না, বাধা থাকলে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় খুঁজে বের করা।
৮ ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন এবং পহেলা মে শ্রমিক দিবস পালন একই উদ্দেশ্যে গাঁথা। পহেলা মে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শ্রমিক আন্দোলনকে স্মরণ করে পালন করা হলেও ৮ই মার্চ নারী শ্রমিকদের আত্মত্যাগকে অবমূল্যায়ন করা হয়, অনেক ক্ষেত্রে ব্যঙ্গ করা হয়।
সকল বৈষম্যের অবসান করে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারী সমান অধিকার ভোগ করার অধিকার অর্জন করাই হলো ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য। ২০২৪ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জাতিসংঘের থীম হলো ‘ইনভেস্ট ইন ওমেন : এক্সিলেরেট প্রোগ্রেস‘। নারীর অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে বিনিয়োগ করুন।
শুধু ৮ই মার্চই নয়, পুরো বছরব্যাপী বিভিন্ন সংগঠন, রাষ্ট্রের নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করতে হবে। নারী-পুরুষের সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর মানবাধিকার অর্জনের লক্ষ্যে নেয়া চলমান প্রতিশ্রুতিসমূহের ওপরও সমভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। শতাব্দীব্যাপী নারীর ন্যায্য অধিকার ও পাওনা আদায়ের জন্য আন্দোলন চললেও, নারী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
নারী-পুরুষের বৈষম্য সত্তেও বর্তমানে যে মেয়েটি তাঁর শ্রমের মজুরী অনেকাংশে পাচ্ছে, যে কর্মজীবী নারীটি ভোগ করছে প্রসবকালীন ছুটি; আগের চেয়ে কিছুটা সুন্দর পরিবেশে যে নারীটি কাজ করছে, এই অর্জনের পেছনে রয়েছে ৮ই মার্চের ইতিহাস।
১৮৫৭ সালে মজুরী বৈষম্য, কর্মঘন্টা নির্ধারণ ও কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিল সূতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে দমন নিপীড়ন। আন্দোলন করার অপরাধে গ্রেফতার হয় বহু নারী। কারাগারে নির্যাতিত হয় অনেকেই। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯০৮ ও ১৯১০ সালে সোসাল ডেমোক্রেটিক নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে নিউইয়র্ক ও কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করার এবং দিবসটি সম-অধিকার দিবস হিসেবে পালিত করার প্রস্তাব করেন ।
১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেছিল। ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৯১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন হয়ে আসছে। ঐ বছরের ১৯শে মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানী ও সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী দিবস এর র্যালীতে ১০ লাখের বেশী নারী-পুরুষ যোগ দিয়েছিল। তারা ভোটের অধিকারের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ লাভের অধিকার এবং কাজের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের বৈষম্যের অবসান ঘটানোর দাবী জানায়।
১৯১৪ সাল থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ই মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হতে লাগলো। অতঃপর ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে ‘ওমেন্স ডে‘ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর দু‘বছর পর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোকে ৮ই মার্চ নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পালন করার জন্য প্রস্তাব দেয়।
১৭৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ ‘সিডও’ গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালে ২০টি দেশ সমর্থন করার পর এটি কার্যকর হয় । বাংলাদেশসহ মোট ১৩২টি দেশ বর্তমানে এর সদস্য। এই সনদের বিশেষ বৈশিষ্ট হলো – এটি নারীর অধিকারের একটি পূর্ণাঙ্গ দলিল। সিডও সনদে ৩০টি ধারা আছে। প্রথম ১৬টি ধারা নারীর প্রতি কত প্রকার বৈষম্য আছে তা বিশ্লেষণ করে। আর পরের ১৪টি ধারা ব্যাখা করে এ বৈষম্যগুলো কীভাবে বিলোপ করা যায় ।
নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৫শে নভেম্বর ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
শতাধিক বছর ধরে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলেও সেই যে মজুরী বৈষম্য, কাজের মানবিক পরিবেশের জন্য লড়াই, তা কিন্তু থেমে নেই। পাহাড়সমান বাধা পেরিয়ে আজ নারী ঘরে-বাইরে অবদান রাখছে। ইদানিং এমন কোন পেশা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যেখানে নারীর পদচারণা নেই, যুদ্ধ বিমান চালনা থেকে শুরু করে, রাষ্ট্র পরিচালনা- সকল ক্ষেত্রে সব পেশাতেই নারী সফল।
একটা সময় ভাবা হতো কিছু পেশা আছে যেখানে নারীর প্রবেশাধিকার নেই, নারীর কমনীয় হাত আর রমনীয় মন ঐসব কঠিন কাজ করতে পারবেনা। নারী আজ কর্মদক্ষতা প্রজ্ঞা দিয়ে প্রমাণ করেছে নারীর পেশা আর পুরুষের পেশা বলে আলাদা কিছু নেই। পাহাড়সমান বাধা পেরিয়ে নারীরা ঘরে বাইরে অবদান রাখছে। সকল ক্ষেত্রে সকল পেশাতেই নারী সফল। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘নারী‘ কবিতায় বলেছেন, সেদিন সুদূর নয়, যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীর জয়।‘
ব্রিটেনে বাঙালী নারী ও মেয়েরা শিক্ষা-দীক্ষা কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের বহু সাক্ষর রেখেছে। হাউজ অব লর্ডস-এ একজন বাঙালী সদস্য এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চার জন বাঙালী এমপি আছেন, এই পাঁচজনই নারী। তাঁরা হলেন: ব্যারোনেস পলা উদ্দিন, রোশনা আরা আলী, টিউলিপ সিদ্দিকী, রূপা হক ও আপসানা বেগম।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতায়নসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে নারীর অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রেও মেয়েরা এগিয়ে। প্রান্তিক নারী এখন অর্থনীতির চালিকা শক্তি। শ্রম বাজারে নারী অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু গার্মেন্টস সেক্টর নয়, গ্রামের সহজ সরল নিরক্ষর নারী খেতে খামারে মাটি কেটে, ইট ভেঙ্গে, নির্মাণ কাজে, শ্রমে-ঘামে বদলে দিচ্ছে তাদের জীবন চিত্র। তবে বিশ্বব্যাপী নারী পুরুষের সমতা অর্জনের কাজ খুবই মন্থর গতিতে চলছে।
তবে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মর্মার্থ অনেকেই বুঝতে চাননা। ৮ই মার্চ পালন নিয়ে নারী-পুরুষ অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘নারী দিবস আছে, পুরুষ দিবস নেই কেন‘ (অনেকেই জানেননা ১৯শে নভেম্বর আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস)। তাদের উদ্দেশ্যে বলতে হয়, নারী দিবস পালন মানে পুরুষের বিরুদ্ধাচারণ নয়। নারী দিবস মানে অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির দিন, সারা বছরের প্রতিশ্রুত প্রতিজ্ঞার মূল্যায়নের দিন এবং ১৮৫৭ সালে যে সব নারী শ্রমিকরা ন্যায্য দাবী আদায়ের আন্দোলন করেছে, তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করার দিন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলতে হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নারীর ভূমিকা ছিল রণক্ষেত্রে এবং সহযোগী হিসেবে। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের সবচেয়ে নির্মম মূল্য দিতে হয়েছিল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীসহ রাজাকার আলবদরদের হাতে নির্যাতিত হয়েছিল নারীরা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও নারীরা পিছিয়ে ছিলেননা। সে সময়ের সংগ্রামী নেত্রী প্রীতিলতা, ইলা মিত্র, কল্পনা দত্তের প্রতি আমরা সব সময় শ্রদ্ধাশীল।
বাংলাদেশের নারী শিক্ষা উন্নয়নে নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার অবদানের কথা উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বেগম রোকেয়ার পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে সুফিয়া কামাল, জাহানারা ঈমাম, নীলিমা ইব্রাহীমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে।
সভ্যতার অগ্রগতি হলেও থেমে নেই নারীর প্রতি নির্যাতন-সহিংসতা। এ অবস্থায় নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে সমাজের ও পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। নারী-পুরুষের সমন্বয়ে সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের সহোযোগিতা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে।
আশা করি, আগামীতে সব অচলায়তন ভেঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করে নারী শক্তির নতুন উজ্জীবনে মহিমান্বিত হবে পৃথিবী। নারী পুরুষের মধ্যে সমতা আনার জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।
নারী দিবসের উদ্দেশ্যঃ
* নারীদের অর্জন ও অবদানের প্রতি সম্মান জানানো।
* নারীদের সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
* নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনকে জোরদার করা।
নারী দিবসের অর্জনঃ
* শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
* কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
* নারীদের ভোটাধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে।
* নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
নারী দিবসের চ্যালেঞ্জঃ
* কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বেতন বৈষম্য বিদ্যমান।
* নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এখনও একটি বড় সমস্যা।
* নারীদের নেতৃত্বের ভূমিকায় পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণ এখনও হয়নি।
নারী দিবসের ভবিষ্যৎঃ
* নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে আরও বেশি কাজ করতে হবে।
* নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
* নারীদের নেতৃত্বের ভূমিকায় আরও বেশি সুযোগ করে দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীদের অর্জন উদযাপন এবং তাদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার একটি দিন। নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, সত্যবাণী