আমার মৃত্যু ভাবনা…

 সৈয়দ মনসুর উদ্দিন

গ্রামের বাড়ী চাড়াভাঙ্গা থেকে পার্শ্ববর্তী বেলঘর গ্রামের দূরত্ব মাইল খানেক। সেই দূরত্বের মাঝামাঝিতে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত আর আসা যাবার পথ। পাশে ছোট খাল। এই খালের পাড়ে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে ছোট শ্মশানের বিশাল মঠ। রাত নামলেই সেখান থেকে ভূত-পেত্নী নেমে আসার গল্প। আমাদের ছেলে বেলার অন্তহীন কৌতুহল।

কৌতুহল ভরে বেশকবারই দেখেছি ঘন্টা বাজিয়ে পুরোহিতরা কাঁধে করে মরদেহ নিয়ে যাচ্ছেন সেই মঠে। তারপর কি হতো জানতাম না। আক্রমণাত্মক পারিবারিক শাসনে সংকুচিত প্রথম জীবনে এর কাছে যাবার সুযোগ ছিলো না। ক্ষণিক পরে দেখতাম কুন্ডলী পাকিয়ে আকাশের উদ্দেশ্যে ছুটছে কাল ধোঁয়া আর সেই ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় জীবন মিশে যেত অনন্তে।

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দূরের শ্মশানে অচেনা জীবনের শেষ আয়োজন দেখলেও মনের মধ্যে খুব একটা দাগ কাটতো না।

ক্লাশ ফাইভে পড়ার সময় আমার এক চাচার লাশের সাথে কবরের কিছুটা কাছাকাছি গিয়েছিলাম প্রথমবার। সেসময় আপনজন চলে যাবার কষ্ট পেলেও চিন্তায় মৃত্যু তেমন জায়গা পায়নি তখনো।

ভাবখানা এমন ছিলো- এতো আমার কোন বিষয় নয়। কল্পলোকের ব্যাপার স্যাপার।

মৃত্যুর সাথে এরপর বড় পরিচয় ঘটে ১৯৯৯ সালে বাবা এবং ২০১৩ সালে মা চলে যাবার পর- দূর থেকে। আমি লন্ডনে। ছেলে হয়ে সাদা কাফনে মোড়ানো মা বাবাকে দেখতে কেমন লাগে আমি জানি না। জানতেও চাই না। কর্মের নির্ধারিত ছুটির সাথে জীবনের ছুটি কখনো মিলে না। যদি রেখে আসতে হয় এই আতংকে যাচ্ছি যাব করে আর যাওয়া হয়নি। আকস্মিকতার কারনে বাবার ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে উঠেনি। হয়তো ‘বিদেশ গিয়ে নবাবজাদা হবার’ অভিশাপ! কষ্টের গভীরতা কল্পনা করে মনে হয় এটা আমার এক ধরনের সৌভাগ্যও বটে! দুজনই আমার কাছে এখনো যে জীবিত। বাবা বাংলা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আর মা খাটে বসে বলছেন ‘আবার কোনদিন আইবি’।

মৃত্যু আমারও একটি বিষয় এবং এটা কেবলই সময়ের ব্যাপার এই ভাবনা প্রবলভাবে শুরু হয় ২০১৪ সালের ২৫ অক্টোবর একটি মৃত্যুরই বৃহ্ৎ পটভূমিতে দাঁড়িয়ে।

বলা চলে কল্পনাজগতের সাথে দূরত্ব ঘুচিয়ে মৃত্যুর সাথে আমার প্রথম সরাসরি পরিচয় ঘটে সেদিন। হঠাৎ করেই ঐদিনের মৃত্যুর বিশেষ রূপ যে অনিঃশেষ ভাব জাগ্রত করেছিলো তা আমার মনোজগতে আজো ঘুরে বেড়ায়, থমকে দেয় এবং প্রশ্ন করে- যা এর আগে কখনো হয়নি।

লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীর সেলসম্যানের সাথে কথোপকথনে জীবিত থাকার চেয়ে মরে যাওয়াটাই উত্তম (!) যেমন মনে হয়, তেমনি বিলাতের অধিকাংশ সিমেট্রি বা কবরস্থান দেখলেও আমার তাই মনে হয়। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। ছিমছাম, সাজানো গোছানো, অপূর্ব সুন্দর। ইংরেজদের বেডরুম আর সিমেট্রির প্রশংসা না করে উপায় নেই।

সেদিন অনেকের সাথে এমনি একটি সিমেট্রি হ্যানল্টের ‘গার্ডেন অব পিসে’ বিদায় জানাতে গিয়েছিলাম আমার প্রিয় একজন মানুষ- আজাদ ভাইকে। ঢাকা কলেজে আমার শিক্ষক কবি শামীম আজাদের স্বামী।

খুব মনে পড়ছে, দিবাবসানের নরম আলোতে আলোকিত সেদিনের শেষ বিকালটির কথা। দিনের চাঞ্চল্য শেষে শীতের আসন্ন সন্ধ্যায় গম্ভীর, নিস্পন্দ গাছগাছালী। তারই ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা সেই নরম আলোর স্নিগ্ধতায় প্রস্তুত গার্ডেন অব পিসের বিদায় মঞ্চ। একসময় একটি নিষ্ঠুর কালো গাড়ী আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে সেই মঞ্চের পাশে।

ভিতরে রাখা চকচকে কফিনে সবার প্রিয় আজাদ ভাই। গভীর ঘুমে। লেপ, কাঁথা, বালিশ, জাজিম, তোষক কিছুই নেই সাথে। নিশ্চল, নিশ্চুপ, একাকি। সব হিসাব চুকিয়ে পরিচিত জগৎ ছেড়ে চলে যাবার জন্য এসেছেন। এবার আর চিরচেনা স্নিত হাস্যে, হাত নাড়িয়ে নয়।

সুদীর্ঘ বন্ধনের চির অবসান চোখে নিয়ে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে কালো রংয়ের শাড়ি পরিহিতা শামীম আপা দাঁড়িয়ে ছিলেন অস্থির ভাবে – জীবন থেকে জীবনান্তের বিচ্ছেদের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতায়।

বিমর্ষ, বিষন্ন, নিস্তব্দ, নির্বাক আমরা ২৫/৩০ জন জীবন মিলে ঘিরে আছি- জীবনহীন আজাদ ভাইকে। বেশীর ভাগই উনার ভক্ত অথবা আপার ছাত্র।

দাফন পরিচালনাকারী তরুণ মৌলভী সাহেব নির্দেশ দিচ্ছিলেন প্রস্থান কাজে সহায়তাকারীদের। এক সময় আমরা সবাই ধরাধরি করে কফিন নিয়ে আসলাম নির্ধারিত স্থানে। এবার আর নিজে নিজে নয়, আমাদের সহায়তায় কফিন থেকে বের হয়ে এলেন কাফনে মোড়ানো আজাদ ভাই- গম্ভীর পরিবেশে একটা অদৃশ্য ঘন সুগন্ধ ছড়িয়ে। এরপর মা যেমন অনেক সতর্কতায় ঘুমন্ত শিশুকে কোল থেকে বিছানায় রাখেন তেমনি যত্নে কবরে শায়িত করা হলো উনাকে। কাফনের বাঁধন খুলে মাথাটা একটু ঘুরিয়ে দিলেন একজন। আড়াআড়ি করে একটার পর একটা কাঠ দেয়া হলো। মূহুর্তেই ঢেকে গেলেন তিনি। উপস্থিত সবাই একমুঠো করে মাটি দিলাম। এক সময় মেশিনে করে দেয়া হলো মাটি, আরো মাটি…।

ছেলে বেলায় দেখা ধোঁয়ায় মিশে যাওয়া জীবনের মতোই চলনে-বলনে অভিজাত, বিদ্যা, বুদ্ধি আর পেশাগত দক্ষতায় অতুলনীয়, সন্দ্বীপ পুত্র আজাদ ভাইও মিশে গেলেন লন্ডনের মাটিতে- তীব্র বিষাদে, ভয়ংকর নির্জনতায়!

শেষ আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে এর পর তরুণ মওলানা ইংরেজীতে বললেন তাৎপর্যপূর্ণ কথাগুলো- ‘আমাদের মাঝ থেকে একাউটেন্ট সাহেব আজ চলে গেছেন। সবাই স্বাক্ষী তার সাথে কিছুই যায়নি। শুধু গেছে উনার আমল। আমাদেরও একদিন এভাবে যেতে হবে। আমরা সবাই যাতে নেক আমলের চর্চা করি। আসুন তার জন্য দোয়া করি।’

জীবন শেষের স্বাক্ষী হয়ে বেলা শেষের সূর্যে আকাশ রঙ্গিন হতে শুরু করেছে। আর সেই রঙ এসে পড়ছে পাশের হ্যানল্ট ফরেস্টের বিস্তির্ণ সবুজে, বিচিত্র গাছের চূড়ায়। মসৃন কুয়াশায় গম্ভীর হয়ে উঠছে সন্ধ্যা। পাখির দল ডুবন্ত সূর্যকে ধাওয়া করে হারিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের শরীরে। বাইরের ব্যস্ত সড়ক থেকে কত গাড়ীর আসা যাওয়ার শব্দ- কর্ম শেষে কত জীবনের ঘরে ফেরা। ঘরে ঘরে কত নতুন জন্মের অমৃত উৎসব!

আমার কেবলই মনে হতে থাকলো এইতো সেদিন…।

বাবার মৃত্যুর তিনদিন পর বাসায় নিয়ে আপার রান্না করা মাশরুম চিকেন নিজের রান্না বলে চালিয়ে বলছেন— ‘আমরাতো আছি!’ পিতার অবতর্মানে পিতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি বারবারই। নিকটাত্মীয়ার সাথে আমার মাল‍্যদানের জন‍্য উঠৈ পড়ে লেগেছিলেন বহুদিন। কানের কাছে আবার বাজলো — ‘আমরাতো আছি!’

শৃঙ্খলছিন্ন বুনো উন্মাদের মতো অদৃশ্য বেদনা হু হু করে উঠতে থাকল মনের মধ্যে।

এই অদৃশ্য বেদনা রবীন্দ্রনাথকে কুঁড়ে, কুঁড়ে খেয়েছে। ১৩ বছর বয়সে মাকে হারানো দিয়ে শুরু হয়েছিলো তার যন্ত্রণা। ৪০ বছর বয়সে মায়ের মতোই দীর্ঘ অসুস্থায় স্ত্রী, কলেরায় পুত্র, যক্ষায় কন্যা, বার্ধক্যজনিত কারনে বাবার মৃত্যু আর প্রিয় বৌদির রহস্যময় আত্মহনন তাকে সামলাতে হয়েছে। কলকাতার নিমতলি শ্মশান হয়ে উঠেছিল কবির নিয়মিত গন্তব‍্য! ছটফট করেছেন। অসংখ্য গানে, সুরে, গল্পে বলেছেন সেই যন্ত্রনার কথা। মৃত্যুকে এঁকেছেন নানাভাবে।

অভিমান করে চাঁদনী রাতেও ঘরের কোনে পড়ে থাকতে চেয়েছেন, পুত্র শোকে গেয়েছেন-

‘আজ জোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…
আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে…‘

শেষ বয়সে এসে জীবনের যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায়ও মনে করতেন মৃত্যুকে। জীবনের দৌরাত্মকে সারাজীবন বহন করতে হবে না ভেবে প্রীতও হয়েছেন। বলছেন—

‘সমুখে শান্তি-পারাবার
ভাসাও তরণী হে কণর্ধার…!’

অল্প বয়সে মাকে হারানোর স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন, ’যে বিচ্ছেদের প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি, প্রাণশক্তির একটা প্রধান অঙ্গ। শিশুকালে সেই প্রাণশক্তি নবীন ও প্রবল থাকে।… অধিক বয়সে মৃত্যুকে অতিসহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই।’

আমার তো এখন ‘অধিক বয়স‘! কিংবা কাছাকাছি! ভাবনাটা এসেই যায়!

(লন্ডন ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০)

(সৈয়দ মনসুর উদ্দিন: সাংবাদিক, লন্ডন টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাহী মেয়রের রাজনৈতিক উপদেষ্টা) 

You might also like