কত গাঁথা-কত সুর: পর্ব-২
সৈয়দ জগলুল পাশা
(ভ্রমনকাহিনীর ধারাবাহিক পর্ব)
পর্ব-২: ভারত
তিন ভাই একসাথে ভারত ভ্রমণ করার পরিকল্পনা হলো অনুজ নাহাস পাশা ও বেলাল আহমদ এর সাথে। ওরা তখন তাদের ৩/৪ বছরের প্রবাস জীবন শেষে দেশে এসেছে কয়েক মাসের জন্য। আমি পড়াশোনা শেষে তখনো পিতার হোটেলের বর্ডার, সমাজ বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর। ঠিক হলো ওরা লন্ডন যাবার সময়ে ৩/৪ দিন আমরা কলকাতায় কাটাবো, আমি ফিরবো বাড়তি সময় কাটিয়ে। সে অনুযায়ী বিমান যাত্রা। অন্য অনেকের মত বিমান বন্দর ডিউটি ফ্রি থেকে পাটের সুশোভিত মোড়কে হুইস্কির বোতল নেয়া হল। ওখানে ভালো দামে বিক্রি হয়।তেমনি মার্কিন ডলার ও। অবশ্য ভালো বারগেইন করতে না পারায় আমরা লাভ করতে পারিনি। নিউমার্কেট এর পাশের লেইটন হোটেলে আমরা উঠি।সব কাছাকাছি।
বিবাদীবাগ এর পর্যটন অফিসের টিকিট এ জৈন মন্দির, দক্ষিণেশ্বর, হাওড়া ও বোটানিকেল গার্ডেন দেখা হয়ে গেল। কফি হাউসে কফি খাওয়া ও কলেজ স্ট্রিট এর বই আমাদের খুব ভালো লাগলো। প্রাচীন বাংলা স্ংবাদ পত্র ‘সমাচার দর্পন ‘ এর দেড়শত বর্ষ সংখার রেপ্লিকা প্রকাশনা পেয়ে গেলাম আমরা। ভাল খাবার রেষ্টুরেন্ট আমরি আমাদের প্রিয় হয়ে উঠলো। প্রগতিশীলতার আকর্ষণে আমরা কমিউনিস্ট মুখপত্র কালান্তর পত্রিকা অফিসে যাই। মুলত সাহিত্যিক রনেশ দাশ গুপ্ত কে দেখতে। পত্রিকা অফিস মেসে থাকতেন ৩ জন, ৭২ বছরের রনেশদাই সবচেয়ে ছোট। বেচেলর বিপ্লবী বাকীরা জোতি দাস গুপ্ত ও কালান্তর সম্পাদক ৭৪ উর্ধ। এ সান্নিধ আলাদা লিখতে হবে। আমাদের পেয়ে তাদের খুব ভালো লাগলো। নাহাস রা যে কদিন ছিল একটু ঘোরাঘুরি পরে আমরা ফলমূল নিয়ে তাদের কাছে চলে যেতাম। তৃতীয় দিনে নাহাস বেলাল চলে যায় এবং আমিও রাজধানী এক্সপ্রেস ধরে দিল্লি রওয়ানা হই।
আঠারো ঘন্টার জার্নি দিল্লির। সহযাত্রী পেয়ে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল মান্নান কে।তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে যাচ্ছিলেন।
দিল্লিতে পৌঁছে দালালের সহায়তায় হোটেল পেলাম স্টেশনের কাছে। বিশ্বস্ত, বকশিস দু’টাকা। আগেই নাহিদ ভাই দিল্লির বর্ননা ও বেড়ানোর টিপস আামাকে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে রেলস্টেশনে রাত্রি যাপন, লকারে জিনিস রেখে ঘুরে বেড়ানো, লাইট এন্ড সাউন্ড প্রোগ্রাম দেখা ইত্যাদি।
প্রথম বিকেলে ই দেখা হল ঐতিহাসিক লাল কেল্লার লাইট এ্ন্ড সাউন্ড প্রোগ্রাম ; বেগম জাহানারার মিনাবাজার ও অবশেষে চাঁদনী চক। লাইট এন্ড সাউন্ড এ কেল্লার বাদশাহী প্রাসাদের সামনে ওপেন এয়ারে আসন বসানো। সন্ধ্যায় দুটো শো হয়। মোগল ও বাদশাহী শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রাসাদ ও পরিবেশে লাইট প্রক্ষেপণ করে তুলে ধরা হয় ইতিহাস। যখন নুপুর নিক্ষণ বাজে মনে হয় এই বুঝি তা আমার সামনে। যখন ঘোড়ায় চড়া সেনার ঘোড়ার আওয়াজ হয় তখন -এই তৈমুর লং এলো বলে ভয় হয়।
দিল্লিকে সাতটি ঐতিহাসিক পর্যায়ের শহর বলা হয়। টুরিজম বাসে দেখা হল ১১৯৩ সালে স্থাপিত ৭৩ মিটার উচু কুতুব মিনার, লাল কেল্লা, ১৭ শতকের জয়পুরের মহারাজার স্থাপিত প্রাচীন সূর্যঘড়ি যন্তর মন্তর, জুমা মসজিদ, তিনশো একর জুড়ে থাকা ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন,খৃষ্টপূর্ব ২৩০ শতকের সম্রাট অশোক স্তম্ভ- যদিও আমি সৌভাগ্য প্রতিকরুপে পেছনে জড়াতে পারিনি তাকে, মহাত্মা গান্ধীর মেমোরিয়াল রাজঘাট ও জহরলাল নেহেরুর স্মরনী শান্তিভানা, কনট প্লেস এবং অসম্ভব বারগেইনের আন্ডারগ্রাউন্ড পালিকা বাজার। একদিন যাওয়া হলো আগ্রা দর্শনে। সম্রাট আকবরের সমাধি সৌধ সিকান্দ্রার ঔজ্জ্বল্য দেখে স্তম্ভিত। তাজমহল দেখে অনেক ভাল লাগে। জামিতিক নকশা, সুশোভিত গেট, মার্বেল ও মনি মুক্তার কাজ, সামনের ফোয়ারা, অদুরের মহল ও মসজিদ আকর্ষণ করে। বেসমেন্ট তলায় সম্রাট ও মমতাজ মহলের মুল সমাধিতে কেউ কেউ ভাংতি টাকা দিয়েছে দেখে খারাপ লাগে। তাজকে পেছনে রেখে তরুণী এগিয়ে এসে সংগ দেয় ছবি তুলতে।
মধ্যাহ্ন ভোজের পর যাত্রা হল -সম্রাট আকবরের প্রাসাদ ফতেহপুর সিক্রি অভিমুখে। পাচ তলা প্রাসাদের বৈচিত্র অনেক। বিশাল বুলন্দ দরজা গেট, হজরত সেলিম চিশতির মাজার, রাণীজুধা বাই কে নিয়ে দেখা পাশা খেলার কোর্টের নর্তকীদের নৃত্যায়োজন এবং অসংখ্য মনি মুক্তা খচিত প্রাসাদের দেয়াল দেখে অপচয়ের সীমাহীন সেচ্চাচারিতা প্রত্যক্ষ করা হল।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধ কালীন সময়ে বিশাল কেম্পাস দেখালেন ড মান্নান ভাই একদিন। অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক তালিকা তথা বিশ্বখাত পন্ডিতদের নাম দেখে বিস্ময়ে বিমুঢ়। মান্নান ভাই নিয়ে গেলেন দিল্লিতে আরেক পিএইচডি গবেষনারত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এর বাসায়। ভাবী খাওয়ালেন দিল্লি কা লাড্ডু। ইতোমধ্যে আমার শাহী বিরিয়ানিও খাওয়া হয়ে গেছে। নাহিদ ভাই বলেছিলেন রাস্তার পাশের দোকানে মেংগো জুস খেয়ে দেখ। সত্যি – এমন মজার আমের জুস এর স্বাধ আর জীবনে কোথাও পাওয়া হয়নি। লকারে লাগেজ রেখে এরপর আজমীর যাত্রা -যা অন্য সময় লিখবো। আজমির থেকে ফিরে আর হোটেল নিইনি।ওস্তাদের পরামর্শমত স্টেশনে প্লাটফর্মে শুয়ে রাত কাটিয়ে মোম্বাই যাত্রা শুরু । এ যাত্রায় পেছনে অনুরণিত হতে থাকলো ” দিল্লি কা লাড্ডু যো বিহি খায়া ও বিহি পস্তায়া – আওর যো বিহি নেহী খায়া ওবিহি পস্তায়া”! (চলবে)
(সৈয়দ জগলুল পাশা: লেখক, সমাজকর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা)