কত গাঁথা-কত সুর: পর্ব-৪
সৈয়দ জগলুল পাশা
পর্ব-৪: স্মরণ
১৯৮১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ কলকাতায় কাটছিল। যাবার সময় শ্রদ্ধেয় বরুণদা তাঁর কাকীমাকে চিঠি দিয়েছিলেন। বহু বছর কাকীমাকে দেখা হয়নি তাঁর। এদিকে তাঁর অগ্রজ কাকাতো ভাই – বিখাত গায়ক নির্মলেন্দু চৌধুরীও সম্প্রতি অকালে গত হওয়ায় কাকীমা মর্মাহত তখন। শুধু ভ্রাতুষ্পুত্র উৎপলেন্দু আছে।
১৯২২ সালে ততকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার জামালগন্জ উপজেলার বেহেলীর জমিদার পরিবারে জন্ম হয় নির্মলেন্দু চৌধুরী ও প্রসুন কান্তি রায় তথা বরুণ রায়ের । মাত্র ৪ মাসের পার্থক্য – নির্মলেন্দু ২২ জুলাই আর বরুণ রায় একই বছর ১০ নভেম্বর। জমিদার- কিন্তু কমিউনিস্ট পরিবারে জন্ম তাদের। বরুন রায়ের বাবা করুনা সিন্দু রায় আসাম পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন । নির্মলেন্দু ও বরুন রায় দুজনই কৃতি ছাত্র ছিলেন। পড়াশোনা একসাথেই – সর্বশেষ এম সি কলেজ সিলেটে আই এ পর্যন্ত। অবশ্য বরুণ রায় ভর্তি হয়েছিলেন বিএ তে। প্রাতিষ্টানিক পড়াশোনা আর হয়নি রাজনৈতিক কাজ ও শাসকদের নির্যাতনের জন্য। দুজনেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে গন নাট্য সংগের গান গেয়েছেন সভার মানুষকে উদ্দীপ্ত করতে। এক্ষেত্রে তাদের অগ্রজ অন্যতম সহযোগী ছিলেন -সিলেটের হবিগঞ্জ এর সন্তান -হেমাংগ বিশ্বাস। দশ বছর আগে তাঁর জন্ম ১৯১২ এর ১৪ ডিসেম্বর। ১৯৩০ এর এন্ট্রান্স পাশের পর তিনিও এমসি কলেজের ছাত্র ছিলেন – ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কমিউনিস্ট আন্দোলন কারা ও নির্যাতনের কারনে আর প্রাতিষ্টানিক পড়ালেখা হয়নি । ১৯৪৭ সালে আসামে প্রতিষ্টিত গন নাট সংগের প্রতিষ্টাতা সম্পাদক ছিলেন হেমাংগ বিশ্বাস। তিনি আসাম কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকও ছিলেন। হেমাংগ বিশ্বাস ও ভুপেন হাজারিকা গানে ও সংগ্রামে মাতিয়েছেন আসাম, পশ্চিম বংগ ততা ভারত। সিলেটের মাটির সন্তান হেমাংগ বিশ্বাস, বরুন রায় ও নির্মলেন্দু চৌধুরী – এই তিন গুনীর জীবন নিবেদিত ছিল মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। বরুন রায় পাকিস্তানের যুক্ত ফ্রন্ট নির্বাচন ১৯৫৪ ও বাংলাদেশের ১৯৮৬ এর নির্বাচনে এম পি হয়েছিলেন।বরুন দা’র বিষয়ে আরো বিশদ পরে লিখার ইচ্ছে আছে।
ফিরে আসি নির্মলেন্দুর কথায়। ১৯৫৩ সালে পুলিশের তাঁড়ার পর নির্মলেন্দু চলে যান কলকাতা। যুক্ত হন ততাকার কমিউনিস্ট পার্টির সাথে। ভারতের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তিনি অনেক অবদান রাখেন। রাশিয়া, যুগোস্লাভিয়া, রুমানিয়া, যুক্তরাজ, জাপান সহ বিশ্বের অনেক দেশে গান গেয়ে উপমহাদেশের সংস্কৃতি ও লোক সংগীত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যান। বিশ্বময় পরিচিত করান তার জন্মভূমি সিলেট -সুনামগঞ্জের ভাটি বাংলার লোকজ সংগীত। যুগোস্লাভিয়ার মার্শাল টিটো তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। ওয়ারশো সম্মেলনে সম্মানিত হন গোল্ড মেডেল অর্জন করে।
আমার কলকাতা সফরে নির্মলেন্দু চৌধুরীর স্নেহময়ী মা শ্রীমতী স্নেহলতা চৌধুরী দেবী আমাকে আপন করে নিলেন। অনেক বয়সেও খুব সুন্দরী ও পরিপাটি মহিলা। না খেয়ে আসা গেলোনা। নির্মলেন্দু এর স্ত্রী তখন ছিলেন কিনা আমার মনে নেই। তবে আরেক স্মৃতি আছে। দেখা, আলাপ ও গল্প হলো নির্মলেন্দু দা’র সু সন্তান উৎপলেন্দু চৌধুরীর সাথে। তিনিও তখন লোকজ গান গেয়ে দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। উৎপলেন্দু ও খুব প্রতিভাধর ছিলেন। খালি গলায় বাবার গাওয়া গান গেয়ে জমিয়ে দিলেন। বরুন কাকার প্রতি আবেগময় অনেক শ্রদ্ধা পাঠালেন আমার সাথে। আর কখনো দেখা হয়নি – উৎপলেন্দুর সাথে- তিনিও অকালে বিদায় নিয়েছেন। নির্মলেন্দু চৌধুরী ও উৎপলেন্দু চৌধুরী তাঁদের সংগীত ও সুরে বেঁচে আছেন আমাদের মাঝে। (চলবে)
(সৈয়দ জগলুল পাশা: লেখক, সমাজকর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা)