কত গাঁথা- কত সুর: পর্ব-৬
সৈয়দ জগলুল পাশা
পর্ব-৫: ট্রানজিটঃ ব্যাংকক – সিংগাপুর
১৯৮৯ সাল। ইন্দোনেশিয়া যাবো একটা স্টাডি টুরে। ১৫ জনের এক দল। তন্মধে ১০ জন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, বাকীরা সরকারী কর্মকর্তা। অনেক উৎসাহ নিয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। আমি তখন স্থানীয় সরকার বিভাগের সহকারী সচিব। সরকারের অতান্ত ডাকসাইটে ব্যক্তিত্ববান আমলা দলনেতা শ্রদ্ধেয় আব্দুর রউফ তখন উপ সচিব। আমরা এর ৩/৪ মাস আগেই যাবার কথা ছিল স্বল্প মূল্যের সেনিটেশন প্রকল্পের আওতায় ভারতের কয়েক জায়গায়। মাননীয় মন্ত্রী জনাব নাজিউর রহমানের কাছে যখন নথি পেশ করা হল, তখন তিনি আদেশ দিলেন- ” পায়খানা দেখার জন্য ভারত যাবার প্রয়োজন নাই”। আমার বন্ধু মন্ত্রীর একান্ত সচিব পিউস কস্টাও চেষ্টা করে বিফল। মাননীয় মন্ত্রী ও এলজিইডি প্রধান জনাব কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী দুজনেই আমাকে স্নেহ করতেন। ঐ সময়ে মাননীয় মন্ত্রীর একদিনকার কথা একটু বলি। একটি নথি অনুমোদনের জন্য যুগ্ম সচিব জনাব হাফিজ উদ্দিন খান ও উপসচিব জনাব বদিউজ্জামান সারসহ ঘর ভর্তি মানুষের মাঝে গেলাম তাঁর রুমে। মন্ত্রী মহোদয় সবাইকে আমার হাতের লেখা নোট শীট দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – জানেন এত সুন্দর হাতের লেখা দিয়ে কি করা যায়। উনার মন্তব্যের জন্যই সবাই অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, এ ধরনের হাতের লেখা দিয়ে প্রেম করা যায়। আরো ঘটনা অন্য প্রসঙ্গ এলে বলবো।
পরে কর্মসূচী পরিবর্তন করলেন জনাব কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং আমাদের পাঠানো হয় ইন্দোনেশিয়া। যাবার রুট ঠিক হল ব্যাংকক ও সিংগাপুর হয়ে। দু’রাত থাকা হল দু’জায়গায়। ব্যাংকক তখনো বেশী বাংগালী অধ্যুষিত হয়নি। বাংগালীদের অনেকে জাপান যাত্রার আশায় ব্যাংককে ট্রানজিট করতে হত। বামরুনগ্রাদ নামক বিশ্বের নামকরা হাসপাতাল ১৯৮০ সালে প্রতিষ্টিত হলেও তখনো অত জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। এখনকার ব্যাংকক ঝাঁকিয়ে বসেছেন বাংগালীরা। এ কাহিনী পরে বলবো। থাইল্যান্ডের ভিসা লাগতো না সে সময়। জাপান যারা পাড়ি জমাতে পারেননি – তাঁরা অনেকে থেকে গেলেন থাইল্যান্ডে । পরবর্তীতে এভাবে গড়ে উঠে আমাদের কমিউনিটি। এক বিকেলে ব্যাংককে আসলে আমাদের বিশেষ কিছু দেখা হয়নি। আমাদের দলের সদস্যদের ভাত ছাড়া চলবেনা। সেখানে সম্ভবতঃ তখন বাংলা খাবার রেষ্টুরেন্ট একটা – এক মার্কেট এলাকায়। সফরসংগী এলজিইডি নির্বাহী প্রকৌশলী ( পরবর্তীকালে এমপি) আগে ভ্রমন করায় চিনতেন। তিনি নিয়ে গেলেন বেবি টেকসির মত টুক টুক যানবাহনে গ্রুপ করে। টুক টুক চালকরা দুষ্টু, যেখানে সেখানে নিতে চায়, পথ লম্বা করে ইত্যাদি। রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড চক দিয়ে লেখা। এক বাংগালী ভদ্রলোক থাই রমনী বিয়ে করে রেষ্টুরেন্ট চালান দুজনে। ভাত, কই মাছ ও ডাল পেয়ে ভেতো বাংগালীরা ঢেঁকুর তুললো। রিভার সাইড এলাকা খুব সুন্দর। বাধাই করা নদীতীর জুড়ে আছে উন্মুক্ত রেস্তোরাঁ ও বার। মার্কেটে কুমিরের চামড়ার একজোড়া জুতার দাম ৬০০০ টাকা দেখে চক্ষু চড়ক গাছ তখন। হোটেলে ফিরে ঘুম।
পরদিন সকালে কোয়ান্টাস বিমানে থাইল্যান্ড থেকে মধাহ্নে সিংগাপুর। প্রেসিডেন্ট হোটেলে পৌছে চেক ইন এরপর লেট লাঞ্চ হলো, বুফে। আমরা সবাই যার যার মত প্লেটে খাবার নিচ্ছি, খাচ্ছি। একজন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আরেকজন চেয়ারম্যানকে দেখিয়ে বললেন, উনি খুব মজা করে পোর্ক খাচ্ছেন। মনোয়ার ভাই ও রউফ সারের গাইডেন্সে আমরা ওটা নিইনি। সম্মিলিত সিদ্ধান্তে তাঁকে তৎক্ষনাত বাধা বা কিছু জানানো হল না। কিন্তু রুমে যাবার পর সহযাত্রী কেউ একজন তাকে বলে ফেললেন। আর যায় কোথায়! ভদ্রলোক বমি করতে করতে কাহিল- অনেক দূর্বল হয়ে গেলেন।পুরো সফর বাকী- সেলাইন খাইয়ে ভাল রাখা হল তাকে । অতঃপর আমাদের দু’সপ্তাহের সফরে ভদ্রলোক মুলতঃ ফলাহারই করলেন, কখনো কখনো সাদা ভাত মাত্র। মনোয়ার ভাই রোপ ওয়ে দিয়ে নিয়ে গেলেন সন্তোষা আইলেন্ড-থিমপার্ক। সন্তোষায় সব বয়সের মানুষের বিনোদনের সব সুযোগ সুবিধা রয়েছে। বীচ, রিসোর্ট, ক্রুজিং, স্কাই ট্রেন, রেষ্টুরেন্ট, রোপ লাইন। আমরা ট্রেন চড়েছি।বাংগালীদের আকর্ষণ মোস্তফা মোস্তফা এর দোকান এযাত্রা ফেরার পথে দেখা হল। সিংগাপুর ব্যাংককে আরো ভ্রমণ পরে লিখা হবে। তবে প্রথম যাত্রার ট্রানজিট শেষে আমরা গারুদা ইন্টারন্যাশনাল বিমানে রওয়ানা হলাম আমাদের মুল গন্তব্যে – জাকার্তা।
(সৈয়দ জগলুল পাশা: লেখক, সমাজকর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা)