কত গাঁথা- কত সুর: পর্ব-৭
সৈয়দ জগলুল পাশা
পর্ব-৭: ইন্দোনেশিয়া
১৯৮৯ সাল। সিংগাপুরে ট্রানজিট দিন কাটিয়ে চান্গি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে গারোদা ইন্টরনাশনাল বিমানে এসে পৌছলাম জাকার্তা, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী। লম্বা প্রশস্ত পিচ ঢালা পথ দিয়ে আমরা ১৫ জনের দল এসে পৌছলাম ডাউনটাউনের এক মাঝারি হোটেলে। দক্ষিণ এশিয়ার সতেরো হাজার দ্বীপ নিয়ে ১৯ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের ১৪ তম বৃহত দেশ-ইন্দোনেশিয়া। বড় দ্বীপ জাভাতে অবস্তিত রাজধানী, পৃথিবীর দ্বিতীয় জনবহুল শহর জাকার্তা। অনেক বন্দর। আম্মার প্রয়াত শতবর্ষী সারেং বড়মামা, আমাদের নানা, ছোট বেলা তাঁদের বিভিন্ন বন্দরে জাহাজ ভিড়ানোর গল্প বলতে গিয়ে বলতেন – কালি মাটি, হাংকাউ, কইলকাত্তা ও শিংসাপুরের কথা। বড় নানার কালি মাটি হলো ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপ -কালিমান্তান ( বোর্নিয়)।
রাতের ডিনারের জন্য ঘুরতে লাগলাম যে যার মত-আসে পাশে। মনে হলো স্নেকস জাতীয় সামান্য কিছু হলে চলবে। মনোয়ার ভাই নিয়ে ঢুকলেন – সাইনবোর্ডে থুতনিতে এক বুড়োর ছবি দেয়া রেষ্টুরেন্টে।এই প্রথম দুনিয়া জোড়া নামকরা আমেরিকান চেন -কেন্টাকী চিকেন রেষ্টুরেন্টে খাওয়া। জাকার্তায় জেঁকে বসেছে কেন্টাকীর অনেক দোকান। আমিও এরপর থেকে ভক্ত।
পরদিন সকাল থেকে আমাদের কাজ শুরু বস্তিতে বস্তিতে ও স্থানীয় সরকারের সাথে। জাকার্তায় অনেক বস্তি। আমরা বিশ্ববাংক সহায়তায় প্রকল্পের কাজ দেখলাম। সেসব আর না বলি। যেখানে যাই বলে তেরিমাকাসি- এই অঞ্চলে খুব প্রচলিত শব্দ অর্থাৎ ধন্যবাদ ( accepted with thanks)। ওয়েলকাম আকারেও ব্যবহৃত হয়। ইন্দোনেশিয়ান পেলে আমি বলি তেরিমাকাসি।ওরা খুশী হয়ে বলে -সামা সামা অর্থাৎ সমান সমান তোমার জন্য। দুপুরের খাবারের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো মাঝারি এক রেষ্টুরেন্টে। বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে বাইরে লাগানো প্রচার বোর্ডে লেখা – গাদো গাদো। মানে আমাদের বিরানি এর মত নারিকেল তেল দিয়ে রান্না করা খাবার। ওদের জাতীয় খাবারের মত মনে হয়। সিংগাপুরে সহযাত্রীর পোর্ক খাবার ভয় তখনও যায়নি। তবে ইন্দোনেশিয়া প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ, সাধারন ভাবে সব খাবার হালাল। আমি মেনু দেখে চিকেন অর্ডার করলাম, অন্যরাও যার যার। বিশাল বড় আস্ত মুরগী এলো -পুরোটা খাবার জো নেই, ফেরতও দেয়া যাবে না, অন্যরা নিজের অর্ডার সামলাতে ব্যস্ত থাকায় কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারলো না, কেবল কিয়দংশ খেল সবাই । আমি পরেও বিভিন্ন দেশে যত জায়গায় গিয়েছি প্রথম খাবারে সাশ্রয়ী হওয়া যাবে না বলে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়েছে। পরে পথ – ঘাট জানতে হয়। আমার খাবার বিল ছিল পাঁচ হাজার রুপি- শুনে ভয়ের কারণ নেই। ইন্দোনেশিয়া, ইতালি ও তুরস্ক ইত্যাদি দেশের বড় বড় মুদ্রায় ভালোই লাগে-লাখ টাকা নিমেষে খরচের আনন্দ উপভোগে ।
সফরের সরকারি কাজের ফাঁকে অন্য সব আয়োজন। একটু বিরতিতে শহরতলির এক খোলা বাজারে পসরা দেখছিলাম, ভাষা সমস্যার কারণে আমি আর মনোয়ার ভাই কিনতে পারছিলাম না। অদূরে আমাদের সহযাত্রী ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরা অনেক কিনছেন দেখে কাছে গিয়ে তরীকা জানলাম – ‘লাকুম দি নুকুম ওয়ালিয়া দিন’ । দোকানী মহিলাকে পেঁপে দেখিয়ে ইশারায় পাকা কি না জানতে চাইলে আর জিনিস দেখিয়ে নিজের ভাষা বাংলায় সচ্চন্দে -কত দাম জিজ্ঞেস করলে বুঝে যাচ্ছে সকলে।
কৃষি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার প্রেজেন্টেশনে বোর্ডে লিখেছেন ket, gud এজাতীয় শব্দ। এতে কোন অসুবিধা বোধ করেন না তাঁরা।
জাকার্তায় আমরা দেখলাম -তামান মিনি অর্থাৎ মিনি ইন্দোনেশিয়া। দেশের মানচিত্র ছোট করে ভোগোল তুলে ধরে রোপওয়েতে চড়ে তুলে ধরা হয়েছে দেশ। বাংলাদেশে এরকম কবে দেখবো আমার মনে রয়ে গেছে। পথে যেতে দেখা হল স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ও পৃথিবীর তৃতীয় বৃহৎ সুন্নী মসজিদ – ইশতিকলাল মসজিদ। সারা জাকার্তা সুন্দর নির্বিগ্ন ওভারপাসে ভরা। আরও অনেক দেখা বাকি, সেসব জায়গায় গিয়ে লেখবো।
জাকার্তায় তখন জাতিসংঘ সংস্থার কৃষি উপদেষ্টা ছিলেন সিলেটের প্রাক্তন জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ ইরশাদুল হক। ইরশাদুল হক সার যখন এফএও’র উপদেষ্টা, তখন ইন্দোনেশিয়া খাদ্যে স্বনির্ভর হয়নি। তাঁর সাড়ে পাচ বছরের মেয়াদে সে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। উনার সাথে আমার পরিচয় হয় সিলেটে বক্তৃতা, বিতর্ক, রচনা প্রতিযোগিতার বিজয়ী পুরষ্কার -তাঁর হাত থেকে নিতে গিয়ে। আমরা যখন বাকশালের অংগ সংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের সাথে কাজ করি তখন আমি ও বন্ধু ডা এনামূল কবির চৌধুরী (অবশেষে সাম্রাজ্যবাদের শীর্ষ দেশের বাসিন্দা) তাঁর কাছে গিয়েছি – মনোনীত গভর্নর হিসেবে নব গঠিত জেলা বাকশাল সম্পাদকদের সাথে সম্বর্ধনার দাওয়াত দিতে। পরবর্তীতে একসাথে কাজ করাসহ আমার জীবনের বিভিন্ন সময়ে জনাব ইরশাদুল হক সারের সান্নিধ্য ঘুরে ফিরে এসেছে। যাক, জাকার্তা গিয়ে সার কে ফোন করায় ভীষণ খুশী হয়ে দেখা করতে নিজে আসলেন হোটেলে। আরেক দিন নিয়ে গেলেন শপিং মল এলাকায়। জাকার্তায় অনেক বড় বড় শপিং মল- শপ বিশ্বের বিভিন্ন ব্রান্ডের সাথে সেখানকার দোকানও। কাপড় সস্তায় আমি ডিপার্টমেন্টাল ষ্টোর মাতাহারি থেকে কিনলাম। সার আমাকে স্ত্রীর জন্য সোনার চেন কিনতে সহায়তা করলেন। পুরো প্রতিনিধি দলকে উনার বাসায় দাওয়াত দিলেন, তবে আমরা কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁদের সময় দিতে পারিনি। তাছাড়া আমাদের দলনেতা তাঁকে বিশেষ পাত্তা না দেয়ায় আমার খারাপ লেগেছিল বিধায় আর আগ্রহী হইনি।
আরেকজন মানুষ তথা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন এলজিইডি’র সাথে কাজ করা একজন ইউরোপীয় কন্সালটেন্টের দাওয়াত মনোয়ার ভাই উপেক্ষা করতে পারেননি। ভদ্রলোক পুরো দলকে ডিনারে নিয়ে গেলেন হোটেলে। অনেক খাওয়া -দাওয়া হল। ভদ্রলোকের স্ত্রী তখন অন্য কোন দেশে গেছেন। বললেন, এক মেয়ে ইউরোপে পড়ছে, অপর জন উনাদের সাথে । বাংলাদেশে থাকাকালীন ভদ্রমহিলা আমাদের হস্ত শিল্প উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতেন। বিনয়ের সাথে বললেন, তাঁর স্ত্রী থাকলে ডিনার বাসায় হত। তবু জোর করে ডিনারের পর তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। আধুনিক ফ্ল্যাট, কার্ড টাচ করালে খুলে- তখন প্রথম দেখি। বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তাঁর ড্রয়িং রুমে আমাদের বেতের সোফা ও ফার্নিচার দিয়ে সাজানো। দেয়ালে ঝুলছিল বাংলাদেশের শিল্পীদের ছবির ফ্রেম। শো-পিস ছিল আমাদের মৃৎশিল্প, বাঁশি ও অনান্য। দেয়ালে আড়ং এর নকশীকাঁথা’র বড় টেপেস্ট্রি। কোন বিদেশি বাংলাদেশকে এত ভালবাসে দেখে চোঁখ-মন দু’টোই জোড়ালো। ভেতরে মেয়েকে ডাকতে গেলেন – ছোট কিশোরী তখন ঘুমিয়ে গেছে। তবু ঠোঁটে আংগুল ধরে নিঃশব্দে আসার আমন্ত্রণ জানালেন ভেতরে। সব রুমই বাংলাদেশী ইন্টেরিয়র রিফ্লেক্সন ও জিনিস দিয়ে সাজানো। অবশেষে কন্যার দরজা খুললেন -দেখলাম বাংলাদেশের গ্রামীণ এক কৃষ্ণকলি সুন্দর সুশোভিত বিছানায় লেপ গায়ে ঘুমিয়ে আছে। তাঁরা অফিসিয়ালি দত্তক নিয়েছেন যুদ্ধ শিশুকে -তাঁদের বড় মেয়ে থাকার পরও। ( চলবে)।
(সৈয়দ জগলুল পাশা: লেখক, সমাজকর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা)