ক্ষমতার রাজনীতিতে আদর্শের রাজনীতি নির্বাসনে
রুহুল কুদ্দুস বাবুল
আদর্শের রাজনীতির বদলে ক্ষমতার রাজনীতির অশোভন চর্চায় কর্মি শুধু নয় নেতারাও দিগভ্রান্ত। আমি আরও কয়েকবার লিখেছি আওয়ামীলীগ নেতারা বক্তৃতা শুরু করে জিয়াউর রহমানের মত করে আর শেষ করে বঙ্গবন্ধুর মত। একজন সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুতে দলীয় নেতা কর্মিদের আচরনে বোধোদয় হল মনে হচ্ছে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বের।
বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম সম্পর্কেও এদের ন্যুনতম ধারনা নেই। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র সাম্প্রদায়িক আদর্শ প্রত্যাখান করেই আওয়ামীলীগে জন্ম। আওয়ামীলীগ একটি ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের রাজনৈতিক দল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছেন। পঞ্চাশের দশকেই আওয়ামী লীগ জনগণের সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করে। ৬০ এর দশকে বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রের প্রশ্নে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে শীর্ষে চলে আসেন। স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা তথা মুক্তির সংগ্রামে সমগ্র জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধ হয়। তাঁর নেতৃত্বে, আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে জীবনপণ মুক্তিযুদ্ধ হয়। বাঙালি জাতি বিজয় অর্জন করে, স্বাধীনতালাভ করে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বাঙালি জাতির পথচলার আদর্শ নির্ধারিত হয়ে যায়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহামান সংবিধানে স্বাধীন বাংলাদেশের রাস্ট্রীয় চার মূলনীতি লিপিবদ্ধ করে দেন।
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের দলীয় ঘোষনাপত্রেও সংবিধানের মূলনীতিগুলো আছে। এটাই দলীয় আদর্শ।
আওয়ামীলীগ আজ রাস্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। রাজনৈতিক দল মাত্রই তো রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করবেই এবং ক্ষমতায় যাবে কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের জন্য শুধু ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতা ভোগটাই মূখ্য হওয়া উচিত নয়। জনগণের অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ে মনযোগ থাকা বাঞ্চনীয়। এখন ক্ষমতাসীন হলে ওই দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও যেভাবে ‘ক্ষমতা’ প্রদর্শন করতে থাকে, তাতে মানুষের জীবনযাপনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা ‘ক্ষমতা’কেই আদর্শ মনে করে। তাই যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে কিংবা গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে আছে তাদের উচিত হচ্ছে নিজ নিজ দলের আদর্শ, নীতি, নির্বাচনী ইশতেহার নিয়ে দলীয় নেতা কর্মিদের যথাযথ অবহিত করা।
প্রত্যেক রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগি সংগঠনের নিজস্ব মেনিফেস্টো আছে তাতে দলের আদর্শ ও নীতিমালা লিপিবদ্ধ থাকে। কিন্তু বর্তমানে দলের নেতা কর্মিরা তা চোখেও দেখেনা।
আমি যখন স্কুলের ছাত্র তখন ছাত্রলীগের সদস্য হই ১ টাকা দিয়ে, কলেজে গিয়ে নতুনভাবে সদস্য হই ২ টাকা দিয়ে। যারা সদস্য করলেন সদস্য পদের স্লিপের সাথে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের একটা ঘোষনাপত্রও। এখন সেই চর্চা নেই। জয় বাংলা বলে মিছিলে আসলো আর কিছুদিন পর অমুকভাই তমুকভাই এগিয়ে চল….! শুরু হলো তার রাজনীতি.…!
১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর থেকে দেশের রাজনৈতিক দর্শনে পরিবর্তন আসে। রাজনীতি থেকে অপসৃত হতে থাকে আদর্শ। নীতি-আদর্শ নয়, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াই একমাত্র আদর্শ হয়ে উঠে। শুধু বামপন্থি দল ছাড়া অন্যরা আদর্শিক অবস্থান ত্যাগ করেছে। আওয়ামীলীগের মত দলেও পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের কদর কমে যেতে থাকে। সে জায়গায় বড় হয়ে উঠে অর্থ বিত্ত বৈভব। রাজনীতি চলে যেতে থাকে বণিক আর আমলাদের দখলে। এরা দ্রুত শুধু রাজনীতিবদ বনে যান, এমন কি দলীয় নীতিনির্ধারকও হয়ে যান তারা। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দলটিও আদর্শহীনদের দখলে চলে যাচ্ছে।
আদর্শচ্যুতির কারণে যাদের বহিস্কার করা হচ্ছে তারা তো দলীয় আদর্শ কি তাও জানেনা, জামাতে ইসলামীর আদর্শ, বিএনপির আদর্শ তা জানা তো দূরের কথা। এরা তো কোন আদর্শ ধারন করেনা ! তাদের কাছে নব্য নেতাদেরই আদর্শ মনে করে। তৃণমূলে পর্যায়ে রাজাকারও নেতৃত্বে চলে এসেছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আওয়ামীলীগকে মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শে অটল রাখতে হবে, শুদ্ধি অভিযান হোক সেই উদ্দেশ্যে। তাই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্র মূলধারার রাজনৈতিক কর্মিদের নেতৃত্ব দিতে হবে।
রুহুল কুদ্দুস বাবুল: রাজনীতিক, সাবেক ছাত্রনেতা।
babulrq.syl@gmail.com