গল্প:: আণ্ডা

ময়নুর রহমান বাবুল 

 

তার নাম টুকন। তার নিজের সম্পর্কে কেবল এইটুকুই সে জানে। এর চেয়ে বেশি কিছুই জানে না। কারন তার বুঝতে পারার বয়স হওয়ার পর থেকেই সে দেখে আসছে তার নাম টুকন। কে তার বাবা, কে তার মা বা অন্য কেউ, কোনও আত্মীয়, এসব সে কিছুই জানে না। দেখেনিও কখনো। আজ এখানে, কাল ওখানে থাকে। রেলওয়ে ষ্টেশনে কিংবা পরিত্যক্ত কোন বিল্ডিং এর বারান্দায় অথবা কোঠরিতে। কখনো বেশি শীতের দিনে বা মেঘ বৃষ্টি বাদলে মালবাহী ট্রেনের ভাঙ্গা ওয়াগনের ভেতর বা কোন টং দোকানের নিচে। টুকন অন্য মানুষের মা বাবা দেখেছে। এমনকি পশু পাখিরও মা বা কোন কোন ক্ষেত্রে বাবা থাকতেও দেখছে। অন্য লোকদের ঘর বাড়ি দেখেছে। কিন্তু কখনো নিজের কোন বাবা মা বা ঘর বাড়ি দেখেনি, পায়নি। তার ঘর বাড়ি যেমন নাই। তেমনি কোন বাবা মাও তার নাই বা ছিল না বলেই সে মনে করে।

টুকন কখনো কারো দয়া বা অনুকম্পায় খাবার দাবার পায়। খায়, বাঁচে। আবার কখনো কাগজ কুড়ায়, খালি বোতল কুড়িয়ে এগুলো বিক্রি করে যা পায়, তা দিয়ে খাবার কিনে খায়। আবার কখনো রিক্সা ঠেলে। যে কেউ, বা যে কোন লোকের এটা ওটা কাজে, ব্যাগ ঝুড়ি বহনে সহযোগীতা করে দু’চার টাকা পায় তাতেই সকালের বা সন্ধ্যার খাবারটার একটা সুরাহা হয়ে যায়।

মা বাবা ঘর বাড়ি বলতে যেমন কিছুই বুঝে না টুকন। ঠিক তেমনি কেবল ক্ষুধা লাগলে খাবার খেতে হয় এবং তার জন্যই শুধু কিছু কাজ করতে হয় বা টাকা রোজগার করতে হয়। কারন কিছু খেতে হলেই পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। পয়সা ছাড়া কেউ কিছু বিক্রি করে না। দেয়ও না। এটুকুই  কেবল সে খুব ভালো করেই বুঝে।

টুকন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শহরের বড় বড় ইমারতগুলো দেখে। সুন্দর সুন্দর গাড়িগুলো দেখে। হৃষ্ট-পুষ্ট মানুষগুলোকে দেখে। তার মতো কিশোর বয়সের চকচকা কাপড় জামা পরা ছেলে মেয়েগুলোকে দেখে।

সেদিন মাংসের দোকানের সামন দিয়ে যাবার সময় এক ভদ্রলোক ডাক দেন টুকনকে। তার ক্রয়করা মাংসের ব্যাগটা তার সাথে গিয়ে বাসায় পৌঁছে দিতে বলেন। টুকন মাংস ভর্তি পাটের থলেটা কাঁধে করে নিয়ে যায়। লোকটির পিঁচু পিঁচু যায় আর ভাবে, আহ, রান্না মাংস দিয়ে গরম গরম ভাত খেতে না জানি কেমন স্বাদ লাগে ! এরকম ভাবতে ভাবতে যায় আর টুকনের নাকে মাংসের তরকারীর ঘ্রাণ এসে লাগে। টুকন যেতে যেতে আরও ভাবছিল, আহা ! রান্নাকরা মাংস দিয়ে যদি লোকটি তাকে এ বেলা চারটে ভাত খেতে দিত। তা হ’লে সে রান্না না হওয়া পর্যন্ত ভদ্রলোকের বাসায় এটা ওটা কাজ বা ফুট-ফরমায়েস খাটতো এবং অপেক্ষা করতো। রান্না হ’লে পেট ভারে চারটে খাবার খেয়ে আসতো। কিন্তু বাসায় পৌঁছেই ভদ্রলোক তাকে পাঁচটাকা পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় করে দেন। অবশ্য এরকম অনেক ঘটনাই টুকনের জীবনে হরহামেশা ঘটে থাকে।

একবার এক ভদ্রমহিলার বাসায় কেবল দু’বেলা খাবার খাওয়ার বিনিময়ে বাসার কাজ করার আবদার করে। কিন্তু সরকারের আইন না কি কী যেন আছে, ছোটদের বা কিশোর বয়স অর্থাৎ টুকনের বয়সিদের কাজ করালে মামলা হয়ে যাবে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। এ বয়স নাকি লেখা পড়া করার। কাজ করার নয়। কিন্তু টুকনকে লেখা পড়া কে করাবে ? আইন আবার কি ? এসব তেমন কিছুই বুঝে না টুকন।

অবশ্য নগরীর রাজপথ কাঁপানো বড় বড় মিছিল, উদ্দ্যান চমকানো উঁচু উঁচু মাচাং বেঁধে বড় বড় রাজা বাদশা বা নেতা মন্ত্রিগণ বক্তৃতা দিতে টুকন দেখেছে। তাদের বক্তৃতা শুনেছে। তারা কী সব বলে এগুলো অবশ্য টুকন তেমন কিছু বুঝে না। ইদানিং সে শুনেছে, শহরের এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত ট্রেন চলবে। এটা নাকি শহুরে ট্রেন। দেশের কোন্ এক শহরের নদীর নিচ দিয়ে নাকি সুড়ঙ্গ পথ তৈরী হবে। মাথার উপর দিয়ে যে বড় বড় লম্বা লম্বা সেতুর মতো দ্বিতলা রাস্তায় তো গাড়ি যে চলছে সেতো টুকন নিজের চোখেই দেখতে পারছে গত ক’বছর ধরে। সেদিন এক ড্রাইভারের ডাকে ইট ভর্তি এক ট্রাকে করে ইট নামানোর জন্য টুকন মাওয়া ফেরীঘাটে যায়। সেখানে বড় নদীর উপর এতো লম্বা একটা সেতু তৈরী হচ্ছে তা নিজ চোখে দেখে। এতো লম্বা সেতু পানির উপর ! টুকনের চোখ এতো দূর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে না। টুকনের দু’চোখ রোদের ঝলমলানি আর নদীর পানিতে ঢেউ খেলা দেখে কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসে। গেল বছর একদিন হঠাৎ সবাই একসাথে চিৎকার দিয়ে চ্যাচিয়ে উঠে। টুকন দৌঁড়ে গিয়ে এর ওর কাছে জানতে চায় কী হয়েছে ? কেউ কিছু বলে না। টুকনের কথা আর কে কানে লয় ! তবু অবশেষে একজন বলে, ‘আরে রে টুকন, আমাদের সরকার আছমানে আরেকটা টেলিভিশন পাঠাইছে। এটারে স্যাটেলাইট কয়..’। এসব কথা টুকন শুধু শুনে। আসমানে আবার টেলিভিশন দেখবো কে? এসব তেমন কিছু সে বুঝে না। টুকন তেমনটা হয়তো বুঝতেও চায় না। বিষয়টা এমনই যে, যার একবেলা খাবারই জোটে না, তার আবার কীসের আযান আর কীসের উলুধ্বনি !

নগরীর একটা মন্দিরে নাকি কতো মন সোনার গহনা আছে ! সেখানে নাকি দেবতাকে এসব পরানো হয়। আবার পুঁজা শেষে তা খুলে মন্দিরের ভেতরে মাটির নিচে সিন্দুকে রাখা হয়। মন্দিরে লোক আসে আর দেবতার মাথায় নাকি গাইয়া দুধ ঢালে। টুকন কখনো যেমন মায়ের দুধ খেতে পায়নি। তেমনি কখনো গাইয়ের দুধের স্বাদটা কেমন তা বুঝতে পারেনি। শহরে অনেকগুলো বড় বড় মসজিদ আছে। প্রতি জুম্মাবারে লোকে সেখানে সিন্নি পাঠায়। সবাই মিলে আনন্দ করে সেগুলো প্যাকেটে প্যাকেটে করে খায়। কেউ জিলাপিও দেয়। সবাই মিলে তা খায়। টুকন মাঝে মধ্যে এসব খাওয়ার জন্য যায়। কিন্তু কেউ তাকে দেয় না। এগুলো নাকি শুধু নামাজিদের জন্য। টুকন তো নামাজ পড়ে না। নামাজ পড়ার বয়স তার হয়েছে কী না তাও সে বুঝে না। আবার নামাজতো কীভাবে সে পড়বে, তাও জানে না। সে কোন্ ধর্মের ? হিন্দু না মুসলমান তাওতো সে জানে না। ধর্ম জিনিষটা কি ? তারও কিন্তু টুকন কিছুই জানে না, বুঝে না। অবশ্য চিল্লাইয়া চিল্লাইয়া কিছু নেতারা যেমন ভাষন দেয়, ঠিক সেরকম ওয়াজ নসিহতের মহফিল করে কিছু হুজুর মৌলানারাও বক্তৃতা করেন। তারা বেস্ত দোযখ এসব অনেক কথা বলেন। যার মাথামুণ্ডু তেমন কিছুই বুঝতে পারে না টুকন। রেলওয়ে ষ্টেশনে সেদিন রাতে পাটের ছালার কয়েক টুকরা গায়ে জড়িয়ে ছেড়া পলিথিনের কয়েক টুকরা দিয়ে তার উপরটা ঢেকে রেখে ঘুমিয়ে ছিল টুকন। এরই মধ্যে সফেদ কাপড় পরা হোমড়া চোমড়া কিছু লোক আসে। ঘুম থেকে টুকনকে টেনে তুলে তার গায়ে একটা কড়া লাল রঙের কম্বল জড়িয়ে দেয় লোকগুলো। অবশ্য রাত হলে কী হবে ! তারা ঝিলিক ঝিলিক মেরে কিছু ফটোও তুলে। আরো অনেককেই তারা এ রাতে কম্বল দিয়েছে আর ছবি তোলেছে। তাদের মধ্যেই দু’য়েকজন বলাবলি করে ঃ সরকার দেশে অনেক কিছু নাকি এখন করছে। বড় গাঙে লম্বা সেতু তৈরী, সেতো টুকন নিজের চোখেই দেখে এসেছে। শহরের মাটির নিচ দিয়ে রেল লাইন, মাথার উপর দিয়ে লম্বা লম্বা রাস্তা, নদীর নিচ দিয়ে ইন্দুরের মতো গর্ত করে পথ বানানো এসবতো আছেই। সারা দেশে নাকি চারতলা পাঁচতলা উঁচু শত শত মসজিদ তৈরী করেও দিচ্ছে। আল্লার ঘর তৈরী করে দিচ্ছে সরকার। টুকন শুনেছিল আল্লা নাকি সারা দুনিয়ার মালিক, রাজা বাদশা। তা’হলে তাকে আবার ঘর তৈরী করে দিতে হবে কেন ? আল্লা তো সরকারকেই দেবার কথা। এখানে উল্টো সরকাই দিচ্ছে আল্লাকে। এতো এতো আল্লার ঘরের কী দরকার তা টোকনের এই আঠালো ধূলিমাখা চুলে ভরা মাথায় কিছুতেই ঢুকে না। গরীব মানুষকে, গৃহহীন মানুষকে সরকার ঘর তৈরী করে দিচ্ছে। সেতো ভালো কথা। কিন্তু আল্লা ভগবানকে আবার দিতে হবে কেন তা টুকনের বুদ্ধিসীমার বাইরে। এসব ভাবতে ভাবতে টুকন লাল টুকটুকে নতুন কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে পুরনো সেই পলিথিন আর বস্তার টুকরোগুলো অনেক দূরে ফেলে দিয়ে খুব আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ে।

ভোরের মেইল ট্রেনের কর্কশ হর্ন টুকনের নতুন কম্বলের আস্তরণ ভেদ করে দু’টি কানের গহŸরে ধাক্কা দেয়। হুড় মুড় করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে টুকন। কম্বলটা ভাঁজ করতে করতে তা নাকে লাগিয়ে শুঁকে। নতুন কাপড়ের গন্ধটা খুব মজার ! কেমন যেন বড়লোক সাহেবদের গায়ের গন্ধের মত মনে হয়। কম্বলটা একটা পলিথিনের ব্যাগে নিয়ে হাঁটতে থাকে। রাস্তার পাশে ঠেলা গাড়িতে কেরোসিনের চুলা জালিয়ে সকালের নাস্তা তৈরী করে ফেরী করে বিক্রি করা লোকটার ঠেলাগাড়িতে সেদ্ধকরা ডিম সাজানো রয়েছে দেখে টুকনের খেতে খুব ইচ্ছা হয়। কম্বলের ভাঁজ করা ব্যাগ হাতে হাঁটে আর ফেরি করা নাস্তার ঠেলাগাড়ির দিকে তাকায়। এক সময় ঠেলাগাড়ির নাস্তা বিক্রির লোকটিকে সাহস করে জিজ্ঞেস করে,

: এগুলো কি আণ্ডা ?

: হু

: কতো দামে বেচবাইন ?

: হনেরো টেহা। টেহা আছে ?

: নাহ, লাগবো না।

টুকন সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। কয়েক পা আগায় আর পিছন ফিরে ঠেলাগাড়ির দিকে তাকায়।

হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে যায় আর টুকন মনে মনে ভাবে:  আজ যে করেই হোক সে অন্য কোন খাবার খাক্ বা না খাক্ রুজি করে বা টাকা জোগাড় করে একটা আণ্ডা কিনে খাবেই খাবে।

দুপুর গড়িয়ে পড়ে। আজ টুকনের কোন আয় রোজগার হয় না। রাস্তার ধারে মুদির দোকানের ছাদের সাথে ঝুলানো একটা তারের ঝুড়িতে রাখা ডিম দেখতে পায় টুকন। দোকানের আশে পাশে এদিক ওদিক সে ঘুর ঘুর করে। একজন খদ্দের এসে ডিম কিনতে চাইলে দোকানি সেই তারের ঝুড়িতে হাত ঢুকিয়ে ডিম বের করার সময় হঠাৎ তার হাত ফসকে একটা ডিম নিচে পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যায়। টুকন দূর থেকে তা দেখে। টুকনের বুকে ছ্যাৎ করে ওঠে। সে দোকানির কাছে যায়। ডিম মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে যাওয়ার নোংরা স্থানটা সে পরিস্কার করে দিতে চায়। দোকানি সম্মতি দিলে টুকন তার দু’হাতের অঞ্জলিতে তখনো জমে থাকা ডিমের হলুদ কুসুমটা তুলে তার কম্বল রাখা পলিথিন ব্যাগ থেকে আরেকটা ব্যাগ বের করে তার মধ্যে রাখে। দোকানের ভেজা অপরিস্কার স্থানটা সে ভালো করে ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে দেয়।

কুড়িয়ে পাওয়া ডিমের কুসুমটা নিয়ে একটু দূরে গিয়ে তা খাবার জন্য মুখে দেয়। ধূলা বালি মেশানো কুসুম কী  স্বাদের, তা টুকন বুঝতে পারে না। কারন তার দাঁতে দাঁতে কেবল বালির কণা লেগে ঝিন ঝিন করে।

আণ্ডায় এমন  স্বাদ কেন তা টুকনের মাথায় ঢুকে না।

(লেখক: কবি, গল্পকার)

You might also like