চিনা রহস্য অন্ত্যহীন

 দিলীপ মজুমদার

 

করোনাভাইরাস ইউরোপ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ার পরে একটা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দানা বেঁধে ওঠে। প্রথম থেকেই এতে ইন্ধন সঞ্চার করতে থাকেন ডোনাল্ড ট্র্যাম্প। ভাইরাসটিকে ‘চিনা ভাইরাস’ ও ‘উহান ভাইরাস’ নামে অভিহিত করতে থাকেন তিনি। ‘ল্যানসেট’ পত্রিকায় এক বিবৃতি দিয়ে চার্লস ক্যালিসার, ডেনিস ক্যারল, রোনাল্ড বি কোর্লে, লুই এনজুনেস, জোন্না ম্যাজেট, উইলিয়ম বি কারেশ, মাইক টার্নার, ল্যারি ম্যাডফ, বার্নাড রোজিমান প্রমুখ বিজ্ঞানীরা জানান যে ভাইরাসটি মনুষ্যসৃষ্ট নয়। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাও ভাইরাসটিকে মনুষ্যসৃষ্ট নয় বলে ঘোষণা করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আপৎকালীন ডিরেক্টর ড. মাইকেল রায়ানও ভাইরাসটিকে প্রাকৃতিক বলে ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু রহস্যময় ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক সমাপ্ত হয় নি। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ফরাসি বিজ্ঞানী লুক মন্তাজিনিয়র ভাইরাসকে মনুষ্যসৃষ্ট বলে রায় দিয়েছেন, কারণ তিনি এই ভাইরাসে এইচ আই ভির পাশাপাশি ম্যালেরিয়ার জীবাণু দেখতে পান। অতি সম্প্রতি ব্রিটিশ সিক্রেট ইনটেলিজেন্সের সাবেক প্রধান স্যার রিচার্ড ডিয়ারল্যান্ড ‘ দ্য টেলিগ্রাফ’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে করোনাভাইরাস প্রাকৃতিক নয়। অসতর্কতাবশত এক দুর্ঘটনার ফলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বাইরে। বিজ্ঞানী স্টিভেন মশার, ডিমিট্রিয়স পরাশকেভিসও অনভিপ্রেত দুর্ঘটনার কথা বলেছেন। কিন্তু লণ্ডনের সেন্ট জর্জ হাসপাতালের অধ্যাপক আঙ্গাল ডালগ্লেইশ ও নরওয়ের বি সোরেনসেন দাবি করেছেন যে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসে কৃত্রিমভাবে স্পাইক প্রোটিন প্রবেশ করানো হয়েছে, তাই তা এমন প্রাণঘাতী সংক্রমণ ক্ষমতা লাভ করেছে।

করোনার উৎপত্তিকালটাও রহস্যময়। আমরা এতদিন জানতাম ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষদিকে উহানে এই মহাপুরুষের প্রথম আবির্ভাব। কিন্তু প্রথম রোগী কে? তবে ১০ ডিসেম্বর উহান আ্যনিম্যাল মার্কেটের সি-ফুড বিভাগের ৫৭ বছর বয়েসী ব্যবসায়ী উয়ে গুয়িক্সিয়ানের অসুস্থতার খবর জানা যায়। কিন্তু সম্প্রতি হার্ভাড মেডিকেল স্কুলের গবেষকরা উহানের হাসপাতালগুলির পার্কিং লটের উচ্চমানের উপগ্রহ চিত্রের উপর গবেষণা চালিয়ে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ২০১৯ সালের আগস্ট মাস থেকেই কাশি ও ডায়ারিয়া রোগীর ভিড় ছিল হাসপাতালগুলিতে। গবেষক দলের প্রধান জন রাউনস্টেইন বলেছেন, ‘এখন এটা পরিষ্কার যে অনেক আগে থেকেই চিনে সামাজিক বিশৃঙ্খলা  শুরু হয়ে যায়। এর কারণ সম্ভবত সংক্রমণ।’

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চিনা অফিসকে চিন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে উহানে এক নতুন ধরনের নিউমোনিয়া দেখা যাচ্ছে। যদি ধরেই নেওয়া যায় যে নভেম্বরে সংক্রমণ শুরু হয়েছে, তাহলে দেড় মাস বাদে কেন জানানো হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে? ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি ডাঃ লি ওয়েনলিয়াংসহ ৮ জন ডাক্তার সতর্ক করে বলেছিলেন নতুন ভাইরাস মহামারি ঘটাতে পারে। কেন তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হল? কেন চিনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন সমস্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দিলেন নতুন ভাইরাস সম্পর্কে কোন তথ্য প্রকাশ করা যাবে না? এসবই রহস্যময়। আরও রহস্যময় চিনের আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। যেখানে ইউরোপ-আমেরিকা-ভারতের নানা শহরে এই ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে চিনের হুবেই প্রদেশের কিছু অঞ্চল, বিশেষত উহানেই ভাইরাসটি সীমাবদ্ধ। বেইজিং, সাংহাই, নানচিং, ছেতুং, থিয়েনচিন প্রভৃতি কোন শহরে করোনার পদসঞ্চার হল না কেন? উহানে কঠোর লকডাউনের ফলে কি! কিন্তু উহানের লকডাউনের আগে সেখান থেকে ১ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তাঁরা কি কেউ সংক্রমণ ছড়ান নি?  ১৮ জানুয়ারি উহানের যে ভোজসভায় ৫০ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্য প্রদেশের যেসব মানুষ ছিলেন তাঁরা কি ছড়ান নি সংক্রমণ?

অনেকে ইউরোপ-আমেরিকার সংকটের জন্য উদারনীতি ও ব্যক্তিস্বাধীনতাকে দায়ী করছেন। এদের ফলে সেসব দেশে একটা ঢিলেঢালা মনোভাব ছিল। কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাই সংক্রমণ এত ব্যাপক হতে পেরেছে সেসব দেশে। কথাটা বেঠিক নয়। কিন্তু এর অন্য একটা দিকও আছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা যেখানে আছে, সেখানে বিরোধী মতও প্রাধান্য পায়।এর ফলে প্রকৃত সত্য সম্বন্ধে একটা ধারনা জন্মায়। ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন বিজ্ঞানী আ্যন্টনি ফাউসি, বা সেখানকার গোয়েন্দা সংস্থা। চিনে এই স্বাধীনতা নেই বলে সেখানে ঠিকঠিক কি হচ্ছে, তা আমরা জানতে পারি না। সেখানে ভিন্ন মত প্রকাশের জন্য ডাঃ লি ওয়েনলিয়াং, সাংবাদিক চেন কুইশি ও  ফ্যাং বিন, বিজ্ঞানী বোটাও জিয়াও ও লি জিয়াওকে সেন্সারড হতে হয়, অনেকে আবার রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যান। রহস্যময় চিনের পাশে আছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অথচ আশ্চর্য, চিন কিন্তু সেই সংস্থাকে ভারতের চেয়ে কম অনুদান দিত। আমেরিকা অনুদান বন্ধ করার হুমকি দিতে চিন সে অনুদান বাড়িয়ে দেয়। মৃতের সংখ্যা নিয়ে চিনের ভুল তথ্যকেও মহাপরিচালক ট্রেডাস আধানম গেব্রেইয়েসুস ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখেছেন। সেটাও রহস্যময়।– 

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট চিনকে একঘরে করার জন্য খুব হম্বিতম্বি করেছিলেন। জর্জ ফ্লেয়েডের হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি নিজেই ফাঁদে পড়ে গিয়েছেন। নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চিন তাঁকে হারাতে চায় বলে মন্তব্য করেছেলেন তিনি, আজ বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সেখানকার আন্দোলনের ঢেউ তাঁকে দিশেহারা করে দিচ্ছে। ৭৩ তম ওয়ার্ল্ড হেল্থ অ্যসেম্বলির প্রথম দিনের অধিবেশনে ১২০ টি দেশ করোনার সঠিক তথ্য দাবি করে, দাবি করে নিরপেক্ষ তদন্তের। অস্ট্রেলিয়ার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর গমগম করে ওঠে। চিনা প্রেসিডেন্ট অনুত্তেজিত কন্ঠে সে দাবিকে অসার বলে মন্তব্য করেন। কোন রহস্যময় কারণে এখনও পর্যন্ত সে তদন্ত গতিবেগ লাভ করেনি, কে জানে! কূটনৈতিক কৌশলেও চিন রহস্যময়।  চিন জানে, বাণিজ্যের কারণে তাকে একঘরে করে দেওয়া মুশকিল। যত গর্জে তত বর্ষে না। সীমান্ত নিয়ে চিনের সঙ্গে যে এমন বিরোধ সৃষ্টি হবে তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভাবতে পারেন নি। শি চিনফিং মোদি সাহেবের সঙ্গে ভাবভাব খেলা খেলে এসেছেন। সবরমতী নদীর ধারে চিনফিংয়ের সঙ্গে দোলে দে দুল, উহানের লেকে নৌবিহার, মল্লপুরমের ঘরোয়া আলাপ.. , মোদি ভেবেছিলেন নেহেরুর ‘হিন্দি চিনি ভাই ভাই’এর নব রূপকার হবেন তিনি। সেই অবসরে চিনফিং ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত। তারপরে এল গালওয়ানের উত্তেজন। ভারতে চিনাদ্রব্য বয়কট করার জিগির তোলা হল। কিন্তু সে কাজ কি এতই সোজা?  বাণিজ্যের নাগপাশে চিন পাকে পাকে জড়িয়ে রেখেছে ভারতকে। আত্মনির্ভরতার শ্লোগান উত্তেজনা সৃষ্টির দিক থেকে ভালো কিন্তু বাস্তব নয়। রহস্যময় চিনের রহস্যময় প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং এইসব মায়াজাল বিস্তার করে রেখেছেন জগৎজুড়ে। মুখে তাঁর মৃদু হাসি সর্বদা। মোনালিসার রহস্যময় হাসির মতো।

লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট। 

You might also like