ধান্ধার ধনতন্ত্রের রাজনীতি হটাও ; চাই প্রগতিশীল রাজনীতির ঐক্য
রুহুল কুদ্দস বাবুল
বামপন্থী নেতৃত্ব সর্বদাই উঠে এসেছে গণ-আন্দোলন এবং আদর্শগত ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এখন প্রগতির মঞ্চে প্রাণোচ্ছলতা, উদ্যম এবং নতুন রক্তের প্রবাহ থমকে গেছে। ফলে দেশের প্রগতিশীল আন্দোলন এখন গতিহীন, ক্ষয়িষ্ণু ৷ কাণ্ডারী যারাই আছেন তারা আদর্শগত ও রাজনৈতিক প্রশ্নে নিজেদের বিভক্তি করছেন। তৈরী হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তত্ত্ব চর্চাকেন্দ্র। গণবিচ্ছিন্ন হচ্ছে আদর্শের রাজনীতি। ফলে আদর্শিক রাজনীতির শূন্যস্থানে ঢুকে পড়ছে সভ্যতা, প্রগতি ও গণতন্ত্র বিরুধী অপশক্তি।
আবহমান কাল থেকেই গণমানুষের ভ্রান্ত আবেগের উপর ভর করেই চলে আসছে শাসন শোষনের রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধ এই সর্বনাসা কৌশলে চরম আঘাত করেছিল। মুক্তির পথ পরিষ্কার হয়েছিল। ৭৫-এর ১৫ আগষ্টের প্রতিবিপ্লব সবকিছু তছনছ করে দেয়। আবার সেই কায়েমী স্বার্থবাদী অপশক্তির হাতে চলে যায় ক্ষমতা রুজ্জু। হিটলার-মুসোলিনির উত্থান ঘটেছিল গণমানুষের ভ্রান্ত আবেগে উসকানি দিয়েই। সে পথই অনুসরণ করছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ গণতন্ত্র রোগাক্রান্ত, নির্বাচন ব্যাবস্থা লণ্ডভণ্ড। নেই জবাবদিহিমূলক শাসন । সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা কেতাবে আছে চর্চায় উল্টোধারা। চলছে দুর্নীতিগ্রস্থ লুটেরা আমলাতান্ত্রিক দুঃশাসন। একজন রাজনীতিবিদ প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে এসব আরও স্পষ্ট হয় যখন তাঁর ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে এভাবে-“অর্থনীতি ও বাজার- এ দুই জায়গায়ই তৈরি হয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছে এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মানুষ বাজার করতে গিয়ে এখন কাঁদছে। এই সিন্ডিকেট ধরতে না পারলে এবং ভাঙতে না পারলে আমাদের মতো মন্ত্রীদের দায়িত্বে থাকা উচিত না। শুধু তাই নয়, আমলারা যা বলেন, মন্ত্রীদের সেটাই করতে হয়। মন্ত্রী দুর্বল আর সচিব সবল হলে সেখানে মন্ত্রীর কোনো ভূমিকা থাকে না।”-(শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমদ মজুমদার)
এই সিণ্ডিকেট ভাংতে পারার সাধ্য তাঁর নেই। কারণ দল পুঁজিবাদী ব্যাবস্থার অনুসারী। পুঁজিবাদ শুধুই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা না, পুঁজিবাদ একটা সংস্কৃতি – একটা দর্শন। কিন্তু তাঁর দল সেখানেও পৌছতে পারেনি। তারা এখনও অবস্থান করছে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এ মানে ‘ধান্দার ধনতন্ত্রে’। লুটেরা উন্নয়ন দর্শনের কৌশল হচ্ছে গণতন্ত্রের নামে পুঁজির দলীয় স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে আইনের শাসন অনুপস্থিত থাকে , রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা পায়, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্মীয় মৌলবাদ ও চরমপন্থি রাজনীতি বিকাশের উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়। ‘ধান্ধার ধমতন্ত্র’ এই পুঁজিবাদ যাবতীয় অবগুণ্ঠন ছিঁড়ে ফেলে নিজের লুটেরা চরিত্রকেই সামনে এনেছে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিসর্জন দিয়েছে। “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যাওয়ার অর্থ হলো স্বাধীনতাযুদ্ধে সাধারণ মানুষ যে জীবন দিয়েছে তাদের ঋণকে সম্মান জানাতে ব্যর্থ হওয়া। প্রকৃত অর্থে জনগণের এই ব্যাপক অংশগ্রহণই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। ..একটি আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সমাজ বিনির্মাণের প্রয়োজনীয় উপাদান ও গণতান্ত্রিক অধিকার সাধারণ মানুষের হাতে ন্যাস্ত করতে হবে। কিন্তু আমরা তার বদলে অধিকতর অযোগ্য সমাজ তৈরি করেছি, যেখানে স্বাধীনতার সুফল খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষের কাছে পুঞ্জীভূত হয়েছে এবং তারা সমকালীন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে।”(From Two Economies To Two Nations: My Journey to Bangladesh/রেহমান সোবহান)
যারা চোখ থাকতে চোখে দেখেনা, কান থাকতে কানে শোনেনা শুধু তারা ছাড়া বাকিরা বুঝতেছে, দেখতেছে কিন্তু তাদের দেখা বোঝা আর শেষ হচ্ছেনা, তারা এখনও তত্ত্বজ্ঞ্যান অর্জনেই ব্যস্ত।
দুটো ‘ধান্ধার ধনতন্ত্র’ দলের বৃত্তে দেশের সরকার ও রাজনীতি বন্দি। ফলে অনাচার-লুটপাট ও দুর্যোগের বেড়াজালে দেশ ও জনগণ দিন দিন নিমজ্জিত হচ্ছে।
তাই এ বৃত্ত ভাঙবার বা ব্যাবস্থা বদলের লড়াইটা তাদেরই করতে হবে যারা পোড়খাওয়া দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অবিচল তাদেরই। অর্থাৎ সমাজবদলের দর্শন নির্মাণে যারা দীক্ষা নিয়েছে তাদেরই করতে হবে।
কায়েমী স্বার্থের অন্তর্জাল ছিন্ন করতে জনগণের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য প্রগতিপন্থি এই রাজনীতৈক শক্তির উত্থান জরুরী।
সভ্যতা, প্রগতি ও গণতন্ত্রবিরুধী সমস্ত অপশক্তির মূলে আঘাত করতে সক্ষম একটা ইস্পাতদৃঢ় রাজনৈতিক শক্তি সমাবেশ দরকার।
সদ্য প্রয়াত জননেতা পংকজ ভট্টাচার্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সমাপ্তি টানবো-“মানুষ বিকল্প চায়; যারা মানুষের দুঃখ নিয়ে মশকরা করবে না; দুঃসহ অবস্থা থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবে। ব্যাপকভিত্তিক দায়বদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটাতে হবে, ভোটের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবে। আশা করি, বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে।”
রুহুল কুদ্দস বাবুল: রাজনীতিক, সাবেক ছাত্রনেতা।