পথের গল্প (শেষ অংশ)

 রেনু লুৎফা


(গত পর্বের পর)

মহিলার বিরুদ্ধে অফিসিয়ালি অভিযোগ করা হলো ইন্সটিটিউট এর পক্ষ থেকে মৌলানাও বাদ গেলেন না।
এই ঘটনার পর থেকেই আমার সহকর্মীর অবস্থা অস্বাভাবিক হয়ে উঠে। সর্বদা হাসি খুশী থাকা মানুষ টির বিরাট পরিবর্তন দেখা দিল অপরিচিত কেউ পাশে আসলেই ভয় পেতেন,চমকে উঠতেন। একা একা কোথাও যেতে নার্ভাস হয়ে পড়তেন। একসময় কঠিন ডিপ্রেশনে চলে যান। পূনরায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে তার বছর দুয়েক সময় লাগে।
অভিযুক্ত মহিলা কোর্টে উপস্থিত হয়ে দোষ স্বীকার করেছেন। কোর্ট তাকে ১২০ পাউন্ড জরিমানা করেছে এবং আমার সহকর্মীর ২০০মিটার এর মধ্যে আসতে বারন করেছ। মহিলার ছেলে অত্যন্ত কায়মনে ক্ষমা চেয়ে একখানা চিঠি লিখেছেন কোর্টে।
কিত্তু মৌলানা লাপাত্তা! মৌলানার বাসায় কয়েক দফা অভিযান চালিয়েও তাকে পাওয়া গেলো না। পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার অনুরোধেও গা করলেন না। পুলিশ মনে করলো তিনি সম্ভবত অন্যকোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তবে তারা নিশ্চয়তা দিলেন মৌলানাকে তারা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ছাড়বেন।

আমি মৌলানাকে কখনো দেখি নি। তবু্ও পথে ঘাটে চলতে গিয়ে তাদের পোষাক পরা কাউকে দেখলেই মনে মনে বলি এই বুঝি সেই মৌলানা। সেই সাথে নিজের মনের মধ্যে ধীরে ধীরে এক ধরনের ঘৃনা জমা হতে থাকে। মানুষ কি করে ধর্মের আলখেল্লা পরে মানুষ ঠকাতে পারে? যদিও যুগ যুগ ধরে তাই চলে আসছে।

কিছুদিন পর জানা গেল মৌলানাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বেকার ভাতার অফিস থেকে ইতিমধ্যে কোর্টের তারিখ আসলো। স্টিফেন আমাকে ছুটি নিয়ে আমার সহকর্মীর সাথে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। আমার কোন দায়িত্ব নেই শুধু সংগী হিসেবে যাওয়া।

এই প্রথম আমি মৌলানাকে দেখি। ছোটখাটো ধুর্ত চেহারার লোক। বেশভূষার কারনে বয়স ঠাহর করা গেলো না, ৫০ বা ৬০ও হতে পারে। মুখ ভর্তি দাড়ি নয়। থুথিতে একগুচ্ছ সাদা পাকা দাড়ি। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবির উপর একটি সৌদি চাদর ছড়ানো। মাথায় টুপি। কিছুক্ষন পরপর জোরে জোরে সুবহান আল্লাহ পড়ছেন। বিচারক তাকে চুপ করার জন্য আদেশ করলেন।
কোর্টে মৌলানা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ৪খানা সনদ পত্র জোগান দিয়েছেন। তিনি লন্ডনের একটি মসজিদে জুম্মার নামাজের ইমামতি করেন। কমিউনিটিতে তার প্রচুর সম্মান রয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। একটি সনদ পত্রে সই করেছেন কমিউনিটির একজন গন্যমান্য ব্যক্তি, যিনি রানীর কাছ থেকে নিজেও একখানা তাবেদারীর মানপত্র পেয়েছেন!
মৌলানা নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার যুক্তিতে বলেছেন, তিনি পয়সার বিনিময়ে কাউকে পানি পড়ে দেন না। তিনি আলীম ব্যক্তি, কমিউনিটির কল্যানে তিনি ইসলামী ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে থাকেন। লোকজন ইচ্ছে করে তাকে টাকা পয়সা দান করেন। তিনি কোরআন হাদিসের আলোকে চলেন। এই পানি তিনি কাউকে ছোড়ার জন্য দেন নি, দিয়েছিলেন মহিলার অশান্ত মনকে শান্ত করার জন্য। মহিলা বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করলেন এই সব আয়ের ট্যাক্স আদায় করেন কি না। মৌলানা জানালেন ট্যাক্স দেওয়ার মতো আয় তিনি করেন না। পুলিশ ও ইন্সটিটিউট এর পক্ষ থেকে মৌলানাকে জরিমানা সহ জেল হাজতে পুরার যুক্তি দেখানো হলো। মৌলানার ব্যারিস্টার এর বিরোধিতা করে তার যুক্তি তোলে ধরলেন।
অবশেষে মৌলানার ৭দিনের জেল এবং ৮শ পাউন্ড জরিমানা করা হয় এবং ঐ দিনই তাকে হাজতে পাঠানো হয়। মৌলানার ব্যারিস্টার তাকে ঐ দিন হাজতে না পাঠিয়ে এক সপ্তাহ পরে পাঠানোর প্রস্তাব দিলেও বিচারক তা গোচরে নেননি। পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ানোই তার কাল হয়েছিল। হেইট ক্রাইম আইনটি তখনো পাশ করা হয়নি নইলে শাস্তি আরো কঠোর হতো।

You might also like