পথের গল্প
রেনু লুৎফা
ভদ্রলোকের সাথে আমার পরিচয় ১৯৮৮ সালে। পরিচয় হয় বললে আসলে ভুল বলা হবে।মূলত তাঁকে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সেই সময় আমার তখনকার চাকুরীক্ষেত্র কিংসওয়ে কলেজ থেকে হোম অফিসের সহায়তায় একটি কমিউনিটি বেইজড ওপেন লার্নিং সেন্টার খোলা হয় ক্যামডেন এর সাউথ সাইডে। উদ্দেশ্য বাংলাদেশী মহিলাদের কমিউনিটিতে সংযুক্ত করার গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করা।
আমাদের গ্রেইজড সেন্টারের মোট সাড়ে তিন জন বাংলা স্টাফ থেকে বাছাই করে আমাকে সেখানে সপ্তাহে দুইদিন করে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলো। আমাকে বাছাই করার একমাত্র কারণ আমি সিলেটি বলতে পারি এবং ঢাকঢোল পিটিয়ে শিশু ও মা বিষয়ক একখানা রিচার্স পত্র প্রকাশিত হচ্ছে। এই নিয়োগে আমি খুশী। পেপারের যুক্তি এবার বাস্তবে দেখার পালা।
তিড়িং তিড়িং করে অতি আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে যোগ দিলাম। সপ্তাহ খানেক পর টের পেলাম সেন্টারের শিক্ষা বিষয়ক বাংলাদেশী মহিলা কর্মীটি আমাকে সুনজরে দেখছেন না। তিনি নানাভাবে আমাকে অসহযোগীতা করতে শুরু করলেন।সেন্টারের কোন ইনফরমেশনই আমার সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছুক নন। সরাসরি কিছু বলেন না, কিন্ত চাইলেই নানা গড়িমসি করেন। বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও যখন সেন্টারের পুরানো রেজিস্ট্রার গুলো পাওয়া গেল না তখন আর সময় নষ্ট না করে স্থানীয় ই ডি সি তে গিয়ে আমি ভোটার লিস্ট অনুযায়ী বাংলাদেশী মহিলাদের একটি পূর্ণাংগ
লিস্ট তৈরী করে কাজ শুরু করে দিলাম। ঠিক তখনই ভদ্রলোকের সাথে আমার দেখা। যখনই আমি ই ডি সি তে যাই তাঁকে দেখতে পাই। একটা কিছু পড়ছেন। বয়সের ভারে নু’য়ে আছেন। অনুমান করি বয়স আশির কম হবে না, নব্বুইও হতে পারে। পুরু চ্শমা পরে কিছু একটা পড়ছেন।গায়ে মোটা একটি কালো কোট জড়ানো। চেহারা ছুরৎ ও শরীরের গড়ন ভদ্রলোকটিকে আমার কাছে বাংলাদেশী বলেই মনে হয়। আলাপ জমানোর জন্য আশেপাশে এটা ওটা নিয়ে নাড়াচাড়া করি। তিনি চোখ তুলেও তাকান না। আলাপ আর জমে না। আমার আগ্রহ বেড়েই চলে। লন্ডনের জুয়ার দোকানের সামনে বয়স্ক বাংলাদেশীদের দেখে আমার কোন ভাবান্তর না হলেও এই বৃদ্ধ কে লাইব্রেরিতে দেখে আমার জানার আগ্রহ বেড়েই চলে।
ইতিমধ্যে আমাদের প্রজেক্টের কাজ চলতে শুরু করেছে। এক দিন সাহস করে তাঁর সামনে
গিয়ে ফিসফিস করে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের বাংলা ইংরাজী লিফলেট এগিয়ে দিলাম তাঁর হাতে।তিনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন, তারপর লিফলেট খানি হাতে নিয়ে খাঁটি সিলেটি ভাষায় জানতে চাইলেন,’ আফনে বাংগালী নি’? ছোট্ট করে জবাব দিলাম ‘জ্বি’। তিনি লিফলেট খানি পড়লেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললেন ‘গুড লাক ইউ নিড ইট’। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “সিওর,বাট এজ লং এজ পিপল লাইক ইউ আর উইথ মি আই উইল বি ওকে”। তিনি খুঁকখুঁক করে হেসে উঠলেন, বললেন “আই এম এ পার্ট অব ফার্ণিচার হিয়ার, আই হ্যাভ সিন এ লট।”তারপর নিজের হাতখানা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আই এম আলী, মজম্মিল আলী”। আমি তাঁর হাত খানি নিজের হাতে নিয়ে বললাম”প্লেজার ইজ মাইন”। তারপর থেকেই যতোবারই দেখা হয়েছে টুকটাক কথা হয়েছে কিন্তু আলাপ এগোয় না। তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখেন।ইতিমধ্যে এলাকার মেয়েদের সাথে আমার বেশ জমে উঠেছে। আমাদের কনফিডেন্স বিল্ডিং এর ছোট ছোট ওয়ার্কশপ গুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং লক্ষ্য করি বারার শুধু সাউথ নয় নর্থ, ইস্ট ও ওয়েষ্ট হতেও মেয়েরা আমাদের প্রজেক্টে যোগ দিতে শুরু করলেন। আমাকে কিছুদিনের জন্য সেখানে ফুলটাইম নিয়োগ দেওয়া হলো। ই ডি সি তে আমার ঘনঘন আসা যাওয়া শুরু হলো। আমার সাথে প্রায়শই একদল মেয়ে থাকেন। আমি ই ডি সি এর লাইব্রেরিতে বসা ভদ্রলোকের সাথে সৌজন্য বিনিময় করি দেখে মেয়েরা একদিন জিজ্ঞেস করে বসলো, আমি লোকটিকে চিনি কি না। চিনি না বলে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তোমরা চিনো কি? একটি মেয়ে জবাব দিলো চিনে না তবে জানে তিনি “মালেশিয়ান বেটির জামাই”।
জবাব টি শুনে পুলকিত হই না। কিছুটা অবাক হই।বাংলাদেশী পুরুষরা স্ত্রীর পরিচয়ে পরিচিত হচ্ছেন! বিষয়টি অবাক করা কিছু না হলেও আমি অবাক হই। ই ডি সি তে একটি কাফে রয়েছে। প্রায়ই আমি ওখানে লাঞ্চ করি। প্রায় প্রতিদিনই তাঁকে জিজ্ঞেস করি লাঞ্চ করবেন কি? এক কাপ চা অর্ডার করবো কি ইত্যাদি। বিগলিত হাসি দিয়ে না করেন। একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার সাথে লাঞ্চ করতে রাজী হলেন। তবে বিল তিনি দিবেন। বললাম ঠিক আছে পরের বার আমি দিব। সেই থেকেই আমাদের পরিচয়।
সিলেট জেলার একটি গ্রামে তাঁর বাড়ি। ইচ্ছে করেই গ্রামটির নাম উল্লেখ করলাম না। দেশ ছেড়েছেন ২১ বছর বয়সে। আর ফিরে যাননি। এক সময় বৃটিশ জাহাজে চাকুরী করতেন। নানা দেশ ঘুরেছেন। কলকাতা, রেংগুন, মালেশিয়া, সিংগাপুর হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে গিয়েছেন। পশ্চিমের কোন দেশও বাদ যায়নি।দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাহাজ সমেত আফ্রিকায় বন্দী ছিলেন ২ বছর। এক সময় জাহাজ থেকে পালিয়ে ২ বছর আমেরিকা ছিলেন কিন্তু থিতু হোন নি। বৃটেনে আছেন ৪০ বছর। শুরুতে ছিলেন লিভারপুল।একদিন কথায় কথায় বললাম, কেমডেনে তো প্রচুর বাংলাদেশী রয়েছেন , রয়েছে প্রচুর সংগঠন, আপনি তাদের সাথে যোগ দিতে পারেন। আমার কথা শুনে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর বিরক্তভরা কন্ঠে বললেন, “তারপর মসজিদ করার নাম করে নেতা হতে চাইবো এইতো? এই এলাকায় আছি তিরিশ বছরের কাছাকাছি তেমন কাউকে চিনি না, মিশিও না। পেনশনে আসার পর থেকেই লাইব্রেরীই আমার সমাজ আমার কমিউনিটি। ভাল সময় কাটে। সকাল বেলা স্ত্রী রেখে যান আবার বিকালে নিতে আসেন।
এমনি করেই তার সাথে আমার পরিচয় বাড়তে থাকে। আমি এক ইতিহাসের খনি খুঁজে পাই। তিনি খুব শক্ত করে সে ঝাঁপিটি আগলে রাখেন। আমি ততোধিক সন্তপর্ণে ঝাঁপিটির ডালা নাড়াচাড়া করতে থাকি। এন্ট্রাস পরীক্ষা না দিয়েই বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। তখন তার বয়স ছিল ষোল কিম্বা সতের। কমও হতে পারে। নিজের গ্রামের ও পাশের এলাকার কয়েক জন বন্ধু বান্ধব মিলে পাশের গ্রামের একজন সারেং এর সাথে গিয়ে উঠেছিলেন কলকাতায়। উদ্দেশ্য ছিল জাহাজে চাকুরী করবেন। ওই সারেং এর মুখেই জাহাজে চাকুরী করার গালগল্প শুনেই বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন।কোথায় যাবেন জানতেন না। তবে জানতেন নানা দেশ ঘুরে বেড়াবেন। ঘুরেছেনও। প্রথম প্রথম বাড়ির কথা তেমন মনে পড়েনি। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মায়ের জন্য মন খারাপ হতে থাকে। অবশেষে দু’বছর পরে ছুটি নিয়ে বাড়ি আসেন। মা বাবা তার জন্য চারিদিকে বউ খুঁজতে থাকেন। এলাকায় প্রচার ছিল, ছেলে বিয়ে না করে জাহাজে ফিরে গেলে আর ফিরবে না। কোথায় কোন বন্দরে কোন মেয়ের পাল্লায় পড়ে দেশের কথা ভুলে যাবে। বললেন, “আমারও তেমন অমত ছিল না”।বিয়ে করেন তিনি। পাশের গ্রামেরই মেয়ে। ওদিকে ছুটিও ফুরিয়ে আসে। মাত্র২১ দিনের বউ বাড়িতে রেখে ফিরে আসেন তিনি জাহাজে। “যখন জাহাজ খানি মমবাসা বন্দরে গিয়ে আটকা পড়লো তখন ফিরে আসার কোন আশা কেউ করেন নি। মন খারাপ হয়ে গেল। বাড়ির সাথে যোগাযোগ করা অসম্ভব হয়ে উঠলো”। জাহাজের ডেকে কাজ করি পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে জানতে না পারলেও বুঝতে পারি এ যুদ্ধ সহসাই শেষ হচ্ছে না। জাহাজের খাবার শেষ হয়ে গেছে। স্থানীয় বাজারেও খাবার মিলছে না। অবশেষে বছর দুয়েক পরে জাহাজ খানি সহ সকলে মুক্তি পেলেন। তিনি বাড়ি ফিরলেন। ফেরার পথে গ্রামের লোকেরা তাঁকে দেখে অবাক হলেন। সকলেই জানালেন, তারা জেনেছেন বোমা পড়ে জাহাজখানি বিধ্বস্ত হয়েছে, তিনি মারা গেছেন! সেই মর্মে একখানি টেলিগ্রাফও নাকি এসেছিল বাড়িতে। বাড়ি ফিরতেই তাঁর জীবন উলোট পালোট হয়ে যায়। তিনি জানতে পারেন, তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়েই তাঁর বিবাহিত বড়ভাই তাঁর স্ত্রী কে বিয়ে করেন। দাঁত মুখ খিচিয়ে বললেন “হারামীরা আমার পেনশন খোয়াতে চায় নি”। কথার খেই রাখতে বোকার মতো প্রশ্ন করলাম, আপনার কোন ছেলে মেয়ে আছে কি? “শুক্কুর আলহামদুলিল্লাহ এই হারামীর বংশ আর বাড়েনি। তাঁর জবাব শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
কিছুক্ষন পরে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “সারারাত ঘুমাতে পারিনি। বারবার ঘরের বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছি যদি বা স্ত্রীর দেখা পাই কিন্তু পাইনি। সেই ভোর রাতেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি , আর ফিরে যাইনি”।
রেনু লুৎফা: লেখক ও শিক্ষাবিদ