পথের গল্প
রেনু লুৎফা
ব্যারিস্টার সাহেবের সাথে আমার যখন দেখা হয় তখন তিনি পুরো দস্তুর একজন ওয়েটার। ছোট খাটো মানুষ, টেকসই পরিপাটি কাপড় চোপড়, পায়ে চকচকে দামী জুতা। খাটো মানুষের বয়স ঠাহর করা যায় না। চল্লিশ বা পঁচিশও হতে পারে। ভালো ইংরাজি ও ফ্রেঞ্চ বলেন। এককালে ফ্রেঞ্চ রেষ্টুরেন্টেও কাজ করেছেন, ফ্রেঞ্চ মেয়ে বন্ধুও ছিল দীর্ঘ দিন।
মাঝে মধ্যে কেতা দুরস্ত পোশাক পরে তাকে তার পোডল (এক ধরনের কুকুর) নিয়ে হাটতে দেখি। দেখা হলে দাঁড়িয়ে কথা বলেন। তার পোডল এর নাম জেনি। প্রথম প্রথম তিনি যখন জেনির কথা বলতেন, আমি ধরেই নিয়েছিলাম তিনি তার মেয়ে বন্ধুর কথাই আলাপ করছেন। যেমন জেনি তান্দুরী খেতে ভালবাসে তবে খান রেষ্টুরেন্টের তান্দুরী ছাড়া আর কিছুই খায় না। জেনিকে একটা কোট কিনে দেওয়ার জন্য সেলফ্রিজে গিয়েছিলাম ইত্যাদি।
তবে সমস্যা হলো তিনি বেশীদিন কোথাও কাজ করতে পারেন না বা করেন না। রেস্টুরেন্টে কাজ করা অবস্থায় মাতাল হয়ে কাস্টমারদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। তাই তাকে চোখে চোখে রাখার জন্য বারে একজন বাড়তি লোক রাখা চাই। যখন মাতাল থাকেন না তখন তিনি একজন আর্দশ ওয়েটার। পশ্চিম লন্ডনের ওয়েস্ট বোর্ণ গ্রোব এলাকাটি সত্তুর, আশি ও নব্বুই দশকে ছিল ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট এর জমজমাট ব্যবসা। কাজ পেতেও তার কোন সমস্যা ছিল না। আমাদেরও এক্টি রেস্টুরেন্ট ছিল পাশের এলাকায়। তাই বছরে একবার বা দু’বার করে তিনি আমাদের এখানেও কাজ করতেন। মাতাল থাকলে কাস্টমাররা খাবারের সমালোচনা করলে তিনি তাদের গুষ্টি উদ্ধার করতেন। কিন্ত তার কাজের অভাব হতো না। ভাল ইংরাজি জানা ওয়েটার দের চাহিদা ছিল বরাবরই। ওয়েটার এর অভাব তো কিছুদিনের জন্য ব্যারিস্টার সাহেব কে ডাকো। আমি কখনো কাউকেই ব্যারিস্টার সাহেব কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে দেখিনি। সকলেই খুব সমীহ করতেন। আমাদের রেষ্টুরেন্টের মূল মালিক কাম শেফ ছিলেন চল্লিশ দশকের জাহাজ থেকে পালিয়ে আসা লন্ডনী। অভিজ্ঞতায় ভরপুর তার জীবন।
তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি ব্যারিস্টার সাহেব আসলে ব্যারিস্টার ছিলেন না। তিনি ব্যারিস্টারী পড়তে এসেছিলেন মাত্র। বিয়ে করে সন্তান সম্ভবা স্ত্রী রেখে যুব বয়সে লন্ডন এসেছিলেন সেই ১৯৬৯ সালে। আর বাড়ি ফেরা হয়নি। অবস্থাপন্ন পরিবারের কাড়ি কাড়ি টাকা হলে সচরাচর যা হয় তাই হয়েছে। ব্যারিস্টারী পড়তে না পারলেও জেনেছেন লন্ডনের পাব আর ক্লাবের অলিগলি। একের পর এক মেয়ে বন্ধু পালটিয়েছেন। তার দেশে ফেরার অপেক্ষায় থেকে থেকে বাবা মা গত হয়েছেন, স্ত্রী এক কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন। সেই কন্যা সন্তান টিও এক্টি কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন। তার আর বাড়ি ফেরা হয়নি।
নব্বুই দশকের শুরুর দিকে তিনি একবার এলেন আমাদের ওখানে। একদিন কথা প্রসঙ্গে জানালেন দেশে অবস্থানরত তার স্ত্রী আসছেন লন্ডনে। তার স্ত্রীর ভাইয়ের পুরো পরিবার লন্ডনের বাহিরে এক্টি শহরে বাস করেন, তিনি সেখানেই আসছেন। জানতে চাইলাম তিনি দেখা করতে যাবেন কি না? অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরায়ে বললেন, আমি লজ্জিত। স্ত্রী সন্তানের প্রতি কোন দায়িত্ব পালন করিনি। এক্টি পাউন্ডও তাদের জন্য পাঠাইনি। মেয়ে তাকে ডজন খানেক চিঠি লিখেছে ছবি পাঠিয়েছে কিন্তু তিনি কোন জবাব দেন নি।
স্ত্রীর ভাইয়েরা তাকে ফোন করে এয়ারপোর্টে যেতে বলেছেন। তিনি বলেন, স্ত্রীর চেহারাও তার মনে নেই। তিনি তাকে চিনতেই পারবেন না। কি মুখ নিয়ে তিনি যাবেন?
অবশেষে ব্যারিস্টার সাহেব এয়ারপোর্টে যাননি।তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। ইঠাৎ একদিন দেখি তিনি কেনজিংটন পার্কে একটা হুইল চেয়ার ঠেলছেন। এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময় করি। তিনি পরিচয় করিয়ে দেন, এই আমার স্ত্রী। লন্ডন আসার ছ’মাসের মাথায় স্ট্রোক হয়েছিল এখন হাটতে কষ্ট হয়। স্ট্রোকের খবর পেয়ে আমি গিয়ে তাকে নিয়ে এসেছি যদি কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি। আমি নীচু হয়ে হাত বাড়িয়ে মহিলার হাত ধরি। জানতে চাই কেমন আছেন, তিনি সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেন,ভাল আছি,অনেক ভাল আছি। হাতে তসবিহ মাথায় হিজাব পরা মহিলাকে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। বলি একদিন আসবেন আপনার সাথে বসে গল্প করবো। ব্যারিস্টার সাহেব পকেট থেকে পার্স বের করে মেয়ের, নাতিনীর ছবি দেখান। আমি মহিলাকে অবাক বিষ্ময়ে দেখি।
(রেনু লুৎফা: লেখক ও শিক্ষাবিদ)