প্রশিক্ষণবিহীন এক মুক্তিযোদ্ধা সুনাওর আলী
সুবল চন্দ্র পাল
মুক্তিযুদ্ধ যখন চলছে তখন আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ শতাংশ জনগণ আওয়ামীলীগের পক্ষে শেখ মুজিবের পক্ষে, তথা ৬ দফার পক্ষে এবং সর্বপরি স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। সামান্য কিছু বর্ণচোরা লোক পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। বাকী সব লোক ছিলেন ‘জয়বাংলা’ তখন রিক্সা চালক রিক্সা চালাতে গিয়ে বলতেন জয়বাংলা, নৌকা চালাতে মাঝি জয়বাংলা বলে পাল তুলতেন, অনেক শিক্ষক (বাঙালি) সরকারি কর্মচারি চেয়ারে বসতে জয়বাংলা বলতেন এবং চেয়ার ত্যাগ করার সময়ও বলতেন জয়বাংলা। সুরমার কীন ব্রীজে উঠলে শোনা যেতো সেই সময় রিক্সাই ছিল প্রধান যানবাহন শুধু একটি ই রব জয়বাংলা, শুধু একজন পরিচিত আরেকজনকে দেখে যেমন বলে উঠল জয়বাংলা তখন তো শুধু একই আওয়াজ জয়বাংলা, জয়বাংলা, বিকাল ৩/৪ ঘটিকা থেকে শুরু হয়ে যেত গ্রামে গ্রামে জয়বাংলা। একাধিক গ্রামের মিছিলকারী একত্রিত হয়ে যে কোন বাজার কেন্দ্র পর্যন্ত যেতেন এবং যে কোন একজন ৬ দফার পক্ষে আইয়ুব সরকার ও শেষে এহিয়া সরকারকে হুমকি বাক্য ঘোষণা করে সভা সমাপ্ত হতো। কোন কোন দিন বিভিন্ন দিক থেকে জয়বাংলা মিছিল এসে বাজার হাট লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ত। জয় বাংলার আকর্ষণে খেলোয়াড় তার খেলা ভুলে জয়বাংলার মিছিলে যোগদান করতো। ১৯৭১ সালে নানান ধরনের খেলা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।এইভাবে জয়বাংলা মানুষের মনে গ্রথিত হয়ে গিয়েছিল। জয়বাংলা ও স্বাধীনতা এক হয়ে গিয়েছিল।
জয় বাংলা যে স্বাধীন বাংলা হয়ে গেছে তাহা পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী খুব ভালভাবে বুঝে গিয়েছিল। তারা ভেবেছিল এই শিক্ষাহীন ভেতো বাঙালীকে কিছু হত্যা করে ভয় দেখালেই জয়বাংলা ছেড়ে দিবে এবং স্বাধীনতার চিন্তা উবে যাবে।বর্বর বাহিনী যত রক্তপাত ঘটাতে লাগলো বাঙালির ততই স্বাধীনতার জন্য রক্তদান করতে আরম্ভ করল। রক্ত যখন দিয়েছি তখন আরো রক্ত দান করে দেশকে স্বাধীন করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।
সুনাওর আলীর বাড়ী মোগলাবাজার ও জালালপুরের প্রায় মধ্যবর্তী স্থান নকিবড় চক। এটা অনেকটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন গ্রাম। পায়ে হাটা ছাড়া কেহই গ্রামে পৌঁছাতে পারবেনা। সুনাওর আলীর বাড়ীতে তারই এক বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা সিকন্দর আলী পুরো দিন ও অর্ধেক রাত্রি যাপন করত। এই খবরটি প্রচার হয়ে গহরপুর রাজাকার ক্যাম্প পর্যন্ত চাউর হয়ে গেল। এক রাত্রে প্রায় ত্রিশজন রাজাকার গহরপুর থেকে সুনাওর আলীর দরজায় এসে হাজির হয়েছে। তাদের হুড়াহুড়ি পাড়াপাড়িতে ঘরের প্রায় সকল লোক সজাগ হয়ে গেছেন। সুনাওর আলীও সিকন্দর আলী একই বিছানায় শুতেন। হুড়াহুড়ি শুনে সুনাওর আলী সিকন্দরকে বুদ্ধি দিলেন। সেই সময় ছনের ঘরের বিশেষ জানালা থাকত না। তাই বাহির হয়ে যাওয়ার দরজা ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। সুনাওর আলী বললেন সিকন্দর হাতের নিচ দিয়ে বাহির হয়ে যাবে। সেই মত কাজ। সিকন্দর আলী সুনাওর আলীর পিছে পিছে। এদিকে রাজাকাররা অনবরত ডাক পাড়ছে সিকন্দর আলী কোথায়, বাহির হয়ে আসো। আর অন্য রাজাকাররা বাঁশের খুটি ও বেড়ায় লাঠি দিয়ে অনবরত আঘাত করছে। তখন সুনাওর আলী হঠাৎ বাঁশের দরজা খুলে বললেন আমি সিকন্দর কি হয়েছে। কি হয়েছে বলে সিকন্দর কে গালি দিয়ে তার দুই হাত দুইজনে ধরে ধাক্কা মেরে উঠানের মাঝখানে নিয়ে যায় এবং নানান গালিগালাজ করতে থাকে। ইতিমধ্যে সিকন্দর আলী সুনাওর আলীর বগলের নীচ দিয়ে পলায়ন করে ফেলেছে। রাজাকাররা সিকন্দর মনে করে সুনাওরকে পূবের (পূর্ব) ঘরের পিছনে নিয়ে সুপারী গাছের সাথে সুদৃঢ়ভাবে বেঁধে ফেলে। ইতিমধ্যে সুনাওর চিৎকার আরম্ভ করেছে আমি সিকন্দর নই আমি সুনাওর। এই চিৎকার শুনে আরুক বাহির করে রাজাকার কমান্ডার বলল দেখতো ওকে, তখন আরুক বলল ওতো সুনাওর আলী। তখন রাজাকার কমান্ডার বলল বেকামা আমাদের সময় নস্ট করতে লেগেছে। বলে ওকে দোষারুপ ও রাইফেল দিয়ে গুতা মারে এবং রাগের সহিত বলে ওকে ছেড়ে দাও। সুনাত্তর আলী ছাড়া পেয়ে পুকুর পাড়ে গাছের তল দিয়ে পালিয়ে যান।রাজাকাররা বাহির হয়ে যাওয়ার সময় কি ভেবে সুনাওর আলীর ছোট ভাই ইদবর আলীকে ধরে নিয়ে যায়। আটকে রেখে বিষণ অত্যাচার করে। অনেক তদবির করে ইদবর আলীকে ছড়িয়ে আনা হয়। এইভাবে কতলোক কতভাবে যে স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন, অত্যাচারিত হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছেন, দুই কোটি মানুষ বাস্তুত্যাগী হয়েছেন, দু লক্ষ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছেন, আমার অনুমান আরো ৩০ লক্ষ মানুষ অত্যাচার, নির্যাতন আর নির্মমতার শিকার হয়েছেন। এ ত্যাগ কি বিফল হয়ে যাবে ! ইহা কি কিছুই না ! ”জয়বাংলা”
সুবল চন্দ্র পাল: বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ।সিলেট জেলা ঐক্য ন্যাপের সভাপতি।