মন্তব্য প্রতিবেদন: ব্রিটিশ বনাম বাঙালির বুদ্ধি
সৈয়দ আনাস পাশা
আইএস বধূ শামিমা বেগমের ব্রিটেন ফেরার ইচ্ছে প্রকাশ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটেনের রাজনীতি ও মিডিয়া অঙ্গন সরগরম।ব্রিটেন ও বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে শামিমাকে নিয়ে চলছে থেমে থেমে তোলপাড়।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড.এ কে আব্দুল মোমেন এই তোলপাড়ের আগুনে সম্প্রতি আবার ঘি ঢেলে দিয়েছেন তাঁর এক মন্তব্যের মাধ্যমে। ব্রিটেনের প্রভাবশালী গণমাধ্যম আই টি ভি কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি পরিস্কার বলেছেন, আই এস বধূ খ্যাত শামীমা নামের এই মেয়েটি বাংলাদেশে ঢুকলে তাকে শূলে চড়তে হবে।অর্থাৎ ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই মন্তব্য আই টি ভি ছাড়াও ব্রিটেনের আরও কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রচার হলেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ইঙ্গিত দেয়া ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারী বা তাঁর দফতরের এবিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন মন্তব্য নেই।
আইটিভি নিউজের সিকিওরিটি এডিটর রোহিত কাঁচরোর সাথে কথা বলছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী
১৫ বছর বয়সে নিজের স্বজন ও জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে জঙ্গী সংগঠন আইএস- এ যোগ দেয়ার লক্ষ্যে সিরিয়া চলে যাওয়া এই মেয়েটি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হওয়ায় তাকে নিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতি ও মিডিয়ায় সৃস্ট সাম্প্রতিক আলোড়নে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে বাংলাদেশের নাম। সর্বশেষ তাঁর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের হোম সেক্রেটারীর ঘোষণার পর ব্রিটিশ মিডিয়ারও ব্যাপক আকর্ষনের কেন্দ্র হয়ে দাড়ায় বাংলাদেশ। কিন্তু কেন?
কাউকে রাষ্ট্রবিহীন করা যাবেনা, আন্তর্জাতিক এমন আইন থাকা সত্বেও ব্রিটেনের হোম সেক্রেটারী সাজিদ জাবিদ কোন যুক্তিতে শামিমার নাগরিকত্ব বাতিলের ঘোষণা দিলেন, এটি খুঁজতে গিয়েই মূলত বার বার আসছে বাংলাদেশের নাম। মেয়েটিকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া যাবে এই ভরসায়? না বিষয়টি রাজনীতির উপর থেকে সরে গিয়ে আদালতের ঘারে চাপুক এই পরিকল্পনায়? সাজিদ জাবিদ শামিমার নাগরিকত্ব কোন চিন্তায় বাতিলের ঘোষণা দিলেন, এটি বিশ্লেষকরাই খুঁজে বের করবেন। নিজেদের রাষ্ট্রে জন্ম ও বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্মের একটি গ্রুপ যদি বিপথগামী হয়, এর দায় শুধু বিপথগামী নয়, রাষ্ট্রও এড়াতে পারেনা। রাষ্ট্রকে গুরুত্ব দিয়ে খুঁজতে হয় এই গ্রুপের বিপথগামী হওয়ার কারন।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর কারন খুজার চেয়ে যেনতেন ভাবে এই বখে যাওয়া গ্রুপটিকে তৃতীয় কোন দেশে ডাম্পিং করার একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি। এক্ষেত্রে যেন ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। জন্ম নিলো আপনার দেশে, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আহরণ করে করে বড় হলো আপনার দেশে, অথচ যখনই সে বিপথগামী হয়ে জঙ্গী বা সন্ত্রাসী হলো তখনই তাকে ডাম্প করার জন্য পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয় তাঁর পূর্ব প্রজন্মের শিকড়ভূমিতে, যে শিকড়কে সে ভালোভাবে চিনেইনা। পশ্চিমা বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর এ কেমন বিচার?
সিলেটি ভাষায় একটি শ্লোক আছে, ‘গরীবের বউ সকলের ভাবী’। অর্থাৎ গরীবের উপর সবাই খবরদারি করতে পছন্দ করে। জঙ্গী মতবাদে প্রভাবিত বখে যাওয়া নিজেদের নাগরিকদের অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার ব্রিটেনের এই চেষ্টাও অনেকটা ঐ ‘গরীবের বউ সকলের ভাবী’ শ্লোকের মত। কিন্ত ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্বকে তো বুঝতে হবে ঐসব ‘শ্লোক’ তৈরী হয়েছিলো শত শত বছর আগে, সেই দিন এখন আর নেই।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সফল ব্রিটিশ নাগরিকদের খ্যাতি ও অর্জন নিজেদের বলে সানন্দে ভোগ করলেও শামীমার মত এই গ্রুপের বখে যাওয়া প্রজন্মের দায় না নিয়ে যেনতেন প্রকারে তাঁর পূর্ব প্রজন্মের দেশের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার এই নীতি যে পরস্পর বিরোধী সেটি বুঝার ক্ষমতা নিশ্চয়ই ব্রিটিশ রাজনীতিকদের আছে। এটিতো ব্রিটিশ বুদ্ধির কোন লক্ষন নয়। এরপরও যদি ধরে নেয়া যায় ‘এটি ব্রিটিশের বুদ্ধি’ তাহলে,বাংলাদেশে ঢুকলেই শামীমা ফাঁসিতে ঝুলবে’ ব্রিটেনের মাটিতে বসে প্রভাবশালী ব্রিটিশ গনমাধ্যমকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এমনটি বলাও ‘বাঙালীর বুদ্ধি’ হিসেবেই ধরে নিতে হবে।
বাংলাদেশের আইনে মৃত্যুদন্ড হলো সর্বোচ্চ শাস্তি। একাত্তরে যুদ্ধপরাধের দায়ে বাংলাদেশের আদালতে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে ব্রিটেন বাংলাদেশে ফেরৎ দিচ্ছেনা মৃত্যুদন্ডের রায় থাকার কারনে। সুতরাং ‘বাংলাদেশে ঢুকলেই শামীমা ফাঁসিতে ঝুলবে’ পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই ঘোষণার পর শামীমাকেও নিশ্চয়ই এখন আর বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করবেনা ব্রিটেন। যদি করে তবে তাঁর আগে চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে যে অবশ্যই ফেরত পাঠাতে হয়। মাননীয় হোম সেক্রেটারী কেমন বুঝলেন বাঙালির বুদ্ধি?
সৈয়দ আনাস পাশা: প্রধান সম্পাদক, সত্যবাণী