মাতাল বাঁশি
হামিদ মোহাম্মদ
(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)
॥বারো॥
তামাবিল সড়কের হরিপুরের নিকটে মেদল বিলের পারে আমি প্রায় সময়ই যাই। হরিপুরবাজার পেরিয়ে পুবমুখো হলেই বিরাট হাওর। হাওরের মাঝখান দিয়ে এঁকে বেঁকে থাকা পাকা সড়ক। আমার জন্মের একশ বছর আগের এই সড়কটি পাকা–ব্রিটিশের তৈরি। দু’পাশে শতবর্ষী জারুল আর হিজলের সারি সারি গাছ। বয়সের ভারে কোন কোনটা ঠুণ্ডা হয়ে, বেঁকে গিয়ে মাথা নীচের দিকে মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। রাখাল বালকেরা ঝুলে থাকে ডালে ডালে কখনো কখনো। এই মেখলা হাওরের মাঝখানে এলে যে কেউই আনমনা হয়ে যান। আর সড়কে সারিবদ্ধ গাছ ছাড়া দু’দিকে তাকালে উন্মুক্ত আকাশ চোখকে ধাঁধিয়ে দেয়। বামে উত্তর পাশে বেশ ক’মাইল দূরে খাসিয়া পাহাড়কে শান্তভাবেশুয়ে থাকতে চোখে পড়ে। অপরূপ মায়াবি দৃশ্য। ডান পাশে দক্ষিণে মেদল বিল। মেদলের পশ্চিমে হরিপুরবাজার। পাহাড়ি কুই নদী মেদলের গা ঘেসে সুরমা নদীতে নেমেছে দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী হয়ে। কুই নদীকে কুই গাঙও বলা হয়। সুরমানদীর মিলনস্থানটি কুইঘাট। বৃষ্টি হলে কুই নদীতে পানির তোড় এত বেগবান হয়, ছোটখাটো গাছ হিজল-তমাল বিন্না ও কাঁশবনকে উল্টেপাল্টে টেনে-হিঁচড়ে ছুটে সুরমার দিকে। বৃষ্টি না হলে কুইগাঙের তলায়, একেবারে নীচে নেমে যায় জল। তখন মনে হয় না, এর বিধ্বংসী এত দাপুটে রূপ বা ক্ষমতা আছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা কেরোসিনের মত টলটলে স্বচছ জল, বরফ শীতল হিম। চিত্রল নানান মাছ তিড়িং তিড়িং করে জলে নেচে নেচে কখনো ভাটির দিকে আবার উজান দিকে পাল বেঁধে ছুটে। মাছের পাল জলের যত গভীরে হোক,স্বচ্ছ জলের ভেতরে এদের ঝিলমিল নাচানাচি দেখা যায়Ñপাল বেঁধে যখন উজোয়, তখন অন্যরকম দেখায়।এই কুইগাঙে আর মেদল বিলে মাছ ধরার স্মৃতি বাবার মুখ থেকে শুনেছি কত।
আর শিঙ মাছের ঘাই খেয়ে বিষে কাঁদতে কাঁদতে কত দিন বাড়ি ফিরেছেন বাবা কেন কতজন জাল বা পলো ফেলে। আবার অজস্র মাছ ধরে হাতে-কাঁধে টেনে-টুনে কোন রকমে দেবপুরের ‘শ্রাবণী’তে বাবার পৌঁছার আনন্দভরা দিন মনে কেন, চোখেও ভাসে আমার। বোয়াল, রুই, কাতলা, শোল, গজার আর কই-মাগুর শিঙ মাছ তো কথা নেই। মাছে-ভাতে বাঙালি আর কাকে বলে। গ্রামের বাড়িতে গেলেও মাছ ধরতে নেমে যেতেন চেলাবিলে। মাছ কত খাবেনÑএই দশা আমাদের।
বাবার মুখ থেকে আরও শুনেছি, এক সময় এখানে মানে ঐ হরিপুর এলাকায় হতো ঘেটুগান। বাউলগানের আসর, যাত্রা-পালার রাত কাবাড় করা উচ্ছলতা। আছে নাচের প্রাণকাড়া স্মৃতি। শাহ আবদুল করিম তখন শুধু আবদুল করিম, জোয়ান লিকলিকে একহারা গড়নের বাঁশির মত গলা-ছেড়ে গাওয়া গায়েন। আবদুল করিম গানের জন্য আসরে উঠে দাঁড়ালে একের পর এক অনুরোধ আসতো। চার-পাঁচ গেরামের লোকের মানুষ হই-হল্লা করে মেদলের চরে জমতো গান-বাজনায়। আরো আসতেন বাউল দূর্বিনশাহ, কামালশাহ। শাহনূর, রাধামন, লালন, আরকুম শাহর মুর্শিদী-মারিফতি গান ও একটানা মাল-জোড়া চলতো ভোর পর্যন্ত। এই সব স্মৃতিঘেরা মেদল বিল, কুইগাঙ, হরিপুরের সবুজ গ্রাম, আমাকেও এখন উন্মত্ত করে ছাড়ে।
একদিন এক দুপুরে, আমি ও নাফিস আমরা দু’জনে এই মেদল বিলের জলের ধারে বসে হাওয়া খেতে খেতে ঠিক করলাম, এই কাছে রয়েছে ‘সাদাপাথর’ ‘রাতারগুল’ পর্যটন বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা ভূমি, আধা সমতল এই নদী ও নীল জলের প্রাণ মাখানো তিরতির সঙ্গীতময় অঞ্চলটি ঘুরে আসি না কেন? নাফিসেরও মনের মাঝে বাংলাদেশে আসার পর থেকে গেড়ে-বসা এই ইচ্ছাটি ছিল। সে আরও যোগ করলো, আমরা বড় একটা ট্যু’র প্রোগ্রাম করলে কেমন হয়। এক সপ্তাহ নয়, পনের দিনের ট্যু’র। সারা বাংলাদেশ চক্কর, ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান দেখা, সবুজের মধ্যে কিছুটা সময় বা কয়টা দিন কাটানো। প্রস্তাবটি আমার খুব পছন্দ হল। পরের মাসে ছুটি নিয়ে এলো নাফিস। আমিও প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম।
যে ট্যু’র প্রোগ্রামটি নাফিস তৈরি করে, এতে আমি সত্যি আপ্লুত, অনেকটা বিষ্ময় সৃষ্টি করা পরিকল্পনা, নিতান্ত আমার কাছে। প্রথমে উত্তরবঙ্গ সফর, তারপর পর্যায়ক্রমে নাটোরের উত্তরা গণভবন, কুষ্টিয়ার লালন আখড়া, টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর কবর ও স্মৃতিসৌধ, মেহেরপুরের মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নির্মিত স্থাপনা দর্শন। এরপর সুন্দরবন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সবশেষে কক্সবাজার সৈমুদ্র সৈকত এবং নিঝুম দ্বীপে রাত্রিযাপান। এই চমৎকার অভিযাত্রা বা আনন্দ ভ্রমণ, যা অপরিসীম শিক্ষণীয়, বাংলাদেশকে শিখে নেয়া, এক অর্থে ঐতিহাসিক অবলোকন, আমার কল্পনার বাইরেই ছিল। সেই সঙ্গে এ সমস্ত দর্শনীয় স্থানসমূহে গেলে থাকার যে ব্যবস্থাদি, হোটেল-মোটেল বা রেস্টহাউস, তাও বুকিং সম্পন্ন করেই নাফিস নির্বিঘœ করেছে পুরোটা। এতো দ্রæত এসব সংস্থান করা সম্পর্কে আমি বিষ্ময়প্রকাশ করলে, সে জলবৎতরলং করে বললো, বাংলাদেশে এখন অনেক ট্যুরিস্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে, তারাই এসব ব্যবস্থা করে দেয়, তাদের মাধ্যমে ট্যুর প্র্রোগ্রাম বানালে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত থাকা যায়, ভরসাও করার মত।
প্রথমে বগুড়ার মহাস্থান গড়ে দু’দিন জার্নি করে পৌছলাম। ঢাকায় একরাত যাপন করেই যাওয়া হল। মহাস্থান গড়ের নাম পুণ্ড্রনগর বা পুণ্ড্রবর্ধন। কথিত আছে এক সময় বাংলার রাজধানি ছিল। বগুড়ার শিবগঞ্জ এলাকায় এই পুরার্কীতি। ঐতিহাসিকরা মনে করেন এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৪র্থ শতকে। এখানে রয়েছে ‘বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, ভাসুবিহার ও মানকালীর ভিটা। রয়েছে সোমপুর মহাবিহার, বেহুলার বাসর ঘর। আমরা গাইডের মাধ্যমেই ঘুরে ঘুরে দেখলাম এই প্রাচীন, ঐতিহ্যের স্থাপনা। রাত কাটালাম বগুড়ার একটি রিসোর্টে। ছোট কুঁড়েঘর টাইপের রিসোর্ট বেশ মনোরম।
পরে দিন ছুট দিলাম বৃহত্তর পাবনার নাটোর। সেখানে রয়েছে মহারানী ভবানীর স্মৃতি বিজড়িত সুবিশাল রাজবাড়ি, যা দর্শনীয় একটি পুরার্কীতি। ১৭০৬ থেকে ১৭১০ সালে নাটোর রাজবাড়ি নির্মিত হয়। ৫০.৪২ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই রাজবাড়ি বর্তমানে ‘উত্তরা গণভবন’ নামে পরিচিত। রাজবাড়ির মোট আয়তন ১২০ একর। ছোটবড় ৮টি ভবন আছে। ২টি গভীর পুকুর ও ৫টি ছোট পুকুর বিদ্যমান। রাজবাড়ি বেস্টন করে আছে দুই স্তরের বেড়চৌকি। পুরো এলাকাটি ২টি অংশে বিভক্ত, ছোট তরফ ও বড় তরফ। রাজবাড়ির উল্লেখযোগ্য মন্দিরগুলোর নাম শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দির। রানী ভবানীর রাজত্বকালে তার জমিদারীর সীমানা ছিল বর্তমান রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর,বীরভূম ও মালদহ জেলা পর্যন্ত। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৮ সালে এই রাজবাড়িটিকে ‘উত্তরা গণভবন’এর মর্যাদাদান করেন। এতে শীতকালিন জাতীয় সংসদের একটি অধিবেশনও বসে। রাজবাড়ির নির্মাণ সৌকর্য এতটাই নান্দনিক, তুলনাহীন এক ঐতিহাসিক সম্পদ।
সেখান থেকে ট্রেনে পৌছলাম কুষ্টিয়ার মেহেরপুর। ঐতিহাসিক মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন বিখ্যাত হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধকালিন বাংলাদেশ সরকারের রাজধানি হিসেবে। এখানেই একাত্তরের ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার। স্থানটিকেবিভিন্ন স্মারক স্থাপনা নির্মাণ করে বাংলাদেশ সরকার একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। এখানে রয়েছে শপথ অনুষ্ঠানের ভাস্কর্য, কুচকাওয়াজ, মন্ত্রী পরিষদ বৈঠক,পাক বাহিনির নির্যাতনের চিহ্নবাহী ভাস্কর্যসমূহ। ঘুরে ঘুরে এসব দেখছিলাম আর গা শিউরে শিউরে উঠছিল।
এদিন রাতে ঘুম আসেনি। ঘুম চোখের পাতা ভরে নামলেই কোথা থেকে যেন কারা উর্দিপরা ধেয়ে আসে, উঁচিয়ে ধরে অস্ত্র,লাল বেয়নেট। আমি ঘুম জড়ানো চোখে বাংলাদেশকে নতুনভাবে দেখতে পাই, দেখতে পাই সংগ্রাম আর সৌকর্যে উজ্জ্বল এক জাতিসত্তাকে।
সকালে মেহেরপুরের আমবাগান ঘেরা রিসোর্টের বাংলোপ্যাটার্ন ঘরটি সূর্যের হলুদ আলোয় ঝিকমিক করে উঠলো। আর এই হলুদ আলো গায়ে মেখেই রওয়ানা দিলাম কুষ্টিয়ার লালনের আখড়ায়।
কুষ্টিয়ার পাড়াগাঁ ছেওড়িয়া। এই ছেওড়িয়ায় লালন ফকির আখড়া গড়ে তুলেন। পরবর্তীতে তার মৃত্যুরপর তাকে এখানে সমাহিত করা হয়, যা লালনের মাজার বলে খ্যাত। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার লালনের স্মৃতিকে একটি ঐতিহাসিক রূপদান করার লক্ষ্যে কবরটি পাকা করেন। কবরের ওপর একটি অপূর্ব নান্দনিক নকশার বাস্তবায়নসহ ভক্তবৃন্দের জন্য কয়েকটি সঙ্গীত চর্চাকেন্দ্র নির্মাণ করেছেন। সেখানে গিয়ে ভিন্ন একটি পরিবেশকে প্রত্যক্ষ করলাম। অনেক জটাধারি বাউল ফকিরের আনাগোনা ছাড়াও গান-পিপাসু মানুষের ভিড়, গানে মত্ত অনেক নারী-পুরুষ। আর রয়েছে লোকসংস্কৃতি ভিত্তিক একটি লাইবেরি, লোকবাদ্যযন্ত্রের কিছু সংগ্রহ, যেগুলো বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিকÑযা এক ধরণের বিলুপ্তির পথে।
তারপর দিন আমরা যাই টুঙ্গিপাড়া। টুঙ্গিপাড়া রয়েছে বঙ্গবন্ধুর মাজার বা কবর এবং মাজারকে কেন্দ্র করে একটি স্মৃতিসৌধ। পুরো এলাকাটি, যেটি বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, সেখান এখন ঐতিহাসিক নির্দশন হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এখানে শুয়ে আছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
টুঙ্গিপাড়া শহরে একটি রেস্ট হাউসে রাত কাটালাম। লোকদের নিকট থেকে জানলাম, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মানুষের ভাবনা, ভালবাসার কথা। আমরা অবাক হয়ে শুনলাম ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের সময় সরকারি মহলের অবহেলা ও সামরিক বাহিনি নিয়ন্ত্রিত নিরবিচ্ছন্ন এবং নিñিদ্র দাফনপর্ব। সাধারণ মানুষকে সে সময় সরিয়ে রাখা হয়, ভয়ভীতি প্রদর্শন সরাসরি না দেখালেও এমন একটি পরিবেশ বজায় রাখা হয়, যাতে সাধারণ মানুষ দূরেই সরে থাকে। একের পর এক নানা বর্ণনা শুনে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে, আর মনে হতে থাকে তখন মানুষ কিভাবে সহ্য করেছিল সেদিনের নিয়ন্ত্রিত দাফনপর্ব। আমি সারারাতই স্বপ্ন নয়, একটি ঘোরের মধ্যে দেখছিলাম বঙ্গবন্ধুর উঁচিয়ে তোলা রেসকোর্সের সেই আঙুল বা তর্জনী।
এই কয়েকদিনে এ জায়গা থেকে ঐ জায়গায় ভ্রমণ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বিশেষত টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর মাজার ঘুরে যেন মনে হল থমকে গেছি ইতিহাসের একটি পৃষ্ঠায় এসে। আমরা সুন্দরবন যখন রওয়ানা দিই, তখন মনে হল এই পোড়া দেশে আমিও জন্মেছি, আমারও রক্তে রয়েছে স্বার্থ, প্রতিবাদহীনতা, মেনে নেয়ার সংস্কৃতি।
সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের উপকুল জুড়ে এক বিশাল বনভূমি। ছোট-বড় নৌকা দিয়ে ভ্রমণ পিপাসুরা ঘুরে বেড়ায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এ অঞ্চলটি বাংলাদেশ অংশে ৬০১৭ এবং পশ্চিসবঙ্গ অংশে ৩০৮৩ বর্গ কিলোমিটার মোট ১০,০০০ কিলোমিটার। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেস্কো বিশ^ঐতিহ্য হিসেবে এ অঞ্চলটিকে স্বীকৃতি দেয়।
সুন্দরবনে রয়েছে জালের মত অসংখ্য সামুদ্রিক জল¯্রােতধারা, কাদা চর,ক্ষুদ্রায়তন দ্বীপমালা। রয়েছে নদীনালা, খাড়ি, বিল মিলিয়ে জলাকীর্ণ অঞ্চল। বনভূমিটিতে রয়েছে বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, নানান জাতের পাখি, চিত্রাহরিণ, কুমির, সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল। ১৯৯২ সালের ২১ মে এলাকাটি ‘রামসা’র স্থান হিসেবে অর্ন্তভুক্ত হয়। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন প্রতি বছর হাজার হাজার দেশী-বিদেশী পর্যটক।
আমরা একটি রঙিন নৌকা নিয়ে পুরো দিন ঘুরে দেখি এই অত্যাচার্য বন ভূমিটি। নদীর চরে শুয়ে রোদ পোহাতে দেখতে পাই কুমিরÑএকটা নয়, অসংখ্য, সঙ্গে ছানাও রয়েছে। চিত্রাহরিণ দল বেঁেধ চরছে চরে তৃণাঞ্চলের ছোট ছোট বনে। গুঁইসাপ দৌঁড়ে পালাচ্ছে ইঞ্জিন নৌকার টো টো ভট ভট শব্দে। পাখি উড়ছে আকাশজুড়ে আবার শিকারের উদ্দেশে ধ্যান ধরে মরা গাছের ডালে বসে আছে মাছরাঙা। কী দেখবো, দেখতে দেখতে অস্থির। চলন্ত নৌকা থেকে চোখে ধরে রাখা য়ায় না এসব মন মাতানো দৃশ্যাবলি এবং ঘন সবুজ বন।
তবে পশুপাখি নৌকার শব্দে পালাতে দেখলাম। এতে মনে হল শিকারির ভয়। যদিও আমাদের সাথে কোন বন্দক ছিল না। নার্ফিস হাতকে বন্দুকের মত করে তাক করেছে বহুবার। আর সেই পাখি কিংবা হরিণ দৌঁড়ে পালাতে চোখে পড়েছে তখন।
আগেই জানা ছিল, সুন্দরী কাঠের জন্য বনাঞ্চলটি কালে কালে সুন্দরবন নাম ধারণ এবং খ্যাতি লাভ করেছে সমুদ্র উপকূলের এই বিশ্ব নন্দিত বনকাব্য। পূর্বে বাংলাদেশের মেঘনা অববাহিকা আর শেষ প্রান্ত বিস্তৃত পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণাজুড়ে এর অবস্থান। নিরবিচ্ছন্ন এই বনাঞ্চলটি বাংলাদেশকে দিয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষা বলয়। পাশ্ববর্তী জনপদ করেছে নিরাপদ, নির্বিঘ্ন। সারাদিন সুন্দরবন ঘুরে সন্ধ্যায় ফিরলাম বরিশাল শহরের একটি রিসোর্টে। ক্লান্তি নেমে আসে দেহজুড়ে। কুয়াকাটা যখন পা রাখি তখন বিষ্মিত হই সমুদ্রকে আগলে রেখে নির্মিত বিশাল বাঁধ, আর বাঁধের কোলজুড়ে শুয়ে থাকার মত ভঙিমায় রয়েছে ১৮ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত। রয়েছে পাতা ঝরঝর শব্দ-করা হাজার হাজার নারকেল গাছ, যে দৃশ্য মানুষ শুধু হা-করেই দেখে আর সবুজের ভেতর বিলীন হয়ে নিজেকে হারাতে চায়। কুয়াকাটাকে বলা হয় ‘সমুদ্রকন্যা’। আসলেই সবুজে ঘোমটাপরা এক অপরূপ রূপসী কুয়াকাটা। বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়, পর্যটকরা আনন্দে মাতেন।
ঢাকায় ফেরা হল দশ দিন পর। উত্তরবঙ্গ আর দক্ষিণবঙ্গকে দেখে নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিজেকে সমৃদ্ধ করার মধ্য দিয়ে জীবনকে উপলদ্ধি করতে শেখা হল ভিন্ন মাত্রায়।
ঘোর কাটার আগেই রওয়ানা দিলাম কক্সবাজার। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত আরও একবার দেখেছি ঝাউবন ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে। অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্রসৈকত এটি। এক সময় এ সৈকতের নাম ছিল ‘পানোয়া’–যার আক্ষরিক অর্থ ‘হলুদ ফুল’। আরেকটি প্রাচীন নাম আছে ‘পালঙ্কি’। কিন্তু কালে কালে পরিচয় স্থায়ী হয়েছে ‘কক্সবাজার’ নামে, এক ইংরেজ অধিকর্তা ‘কক্স’ এর নামে প্রতিষ্ঠিত বাজারকে কেন্দ্র করেই এ নাম।
এবার গেলাম নিঝুমদ্বীপ। সমুদ্র মাড়িয়ে যেন পাড়ি দিল মানুষভর্তি জাহাজ। আমরা সমুদ্রের হাওয়ায় দুলতে দুলতে এক সময় পৌঁছলাম–নিঝুমদ্বীপ। প্রবালে গড়ে ওঠেছে দ্বীপটি।
ফিরে আসার দিন গেলাম বান্দরবন। পাহাড় আর টিলা বেষ্ঠিত প্রাকৃতিক সবুজ লীলা দর্শনে। নানা নৃ-জাতিগোষ্ঠী অধ্যুসিত বান্দরবনে রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম উচ্চশৃঙ্গ ‘কেওক্রাডং’। উচ্চতা ৯৮৬ মিটার। রয়েছে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র, নীলাচল, ডিমপাহাড়, চিম্বুক পাহাড় ও উপজাতীয় গ্রাম, ঋজুক জলপ্রপাত, বাংলাদেশের দীর্ঘতম খাল ‘রাইখিয়াং’। এ অঞ্চলে এক সময় অসংখ্য বানর পাওয়া যেত, তাই এলাকাটির নাম হয়ে যায় ‘বান্দরবন’ মানুষের প্রচলিত ধারনা।
পরের দিন এলাম কুমিল্লার শালবনবিহার ‘ময়নামতি’। প্রকৃতির কোলঘেষা এই অপূর্ব সৌন্দর্য মন্ডিত শালবনে রয়েছে পুরাকৃতি হাজার বছরপ্রাচীন, বৌদ্ধস্থাপত্য। না দেখলে বুঝার উপায় নেই শালবনের গভীরে এতো বড় একটি ঐতিহাসিক স্থান লুকিয়ে আছে। ময়নামতির পূর্ব নাম ‘রোহিতগিরি’। প্রতœতাত্তি¡কদের মতে, ‘জয়কর্মান্তবসাক’ নামক একটি প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ এই ‘ময়নামতি’। ধারণা করা হয় খ্রীষ্টীয় সপ্তম থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমভভাগে দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধ বিহারটি নির্মাণ করেন। (চলবে)