মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা-২

 সুবল চন্দ্র পাল

সুবল চন্দ্র পাল। ৭১ এর রনাঙ্গন কাঁপানো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছিলেন পাকিস্তানী হানাদারদের আতঙ্ক। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদারদের আত্মসমর্থনের কদিন আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের যে গ্রুপটি সিলেটের জালালপুর মুক্ত ঘোষণা করে লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে ছিলেন, সেই গ্রুপেরই অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশটি পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা। প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন ন্যাপের নেতা হিসেবে ঝাপিয়ে পড়েন মানব উন্নয়নের কাজে। নিজ এলাকা জালালপুরে বৈরাগীর বাজারে প্রতিষ্ঠা করেন হাই স্কুল এবং এই স্কুলের অবৈতনিক প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। জনগণের চাঁদায় বড়ভাঙ্গা নদীতে নির্মাণ করেন একটি সেতু। সেতুটির উদ্বোধন করেছিলেন প্রয়াত জননেতা পীর হবিবুর রহমান। মানবপ্রেমিক এই মানুষটির বিশাল হৃদয়টি ভরে আছে মানুষের জন্য ভালোবাসায়।এই ভালোবাসার ভার বহন করতে গিয়েই হয়তো সম্প্রতি বিগড়ে গিয়েছিলো তার এই হৃদয়। হয়েছিলেন হৃদরোগে আক্রান্ত। অপেন হার্ট সার্জারির পর সম্প্রতি ফিরেছেন নিজ বাড়ীতে। সত্যবাণী সম্পাদকসহ তাঁর এক সময়ের রাজনৈতিক অনুসারীদের একটি গ্রুপ তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর গ্রামের বাড়ীতে। অসুস্থতা ভুলে তাদের সাথে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক ভাবনা, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতি অনেক কিছুই শেয়ার করেন তিনি এসময় তাদের সাথে। এ বিষয়ে  কাগজে লিপিবদ্ধ তার লিখাটি নিয়ে আসে সত্যবাণী। পাঁচ পর্বে বিভক্ত এই লেখার দ্বিতীয় পর্বটি আজ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।-সম্পাদক

(২য় অংশ)

আচ্ছা মা ৫০ বছর পূর্বে যে বস্ত্র আমরা তোমাকে দিয়েছিলাম সেই শাড়িটি কি আছে? রঙ কি ঠিক আছে। রাগ করোনা ‘মা’। না ‘মা’ না। বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো কালো চিকচিকে রঙয়ের, মাথায়  গামছা বাঁধা, হাতে বাঁশের বাঁশরি নিয়ে তোমার গোয়ার ছেলেটিতো তোমার জন্যই এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম। পায়ে হাত ছুঁয়ে বীর বেশে ফিরে আসার আশায় সেই আমগাছের আড়ালে। যেখানে ফুটো টিনের থালায় আমায় খাদ্য দান করেছিলে। সেই তোমাকে কিভাবে বস্ত্রহীন ভাবতে পারি ‘মা’। আচ্ছা ‘মা’ তোমার কাছ থেকে তো কোনদিন  এই প্রশ্নের উত্তর পাইনি। এইবার তোমাকে বলতেই হবে, না হলে কিন্তু ছাড়বনা। বলব ‘মা’ বলব, তোমার  বয়স  কত ‘মা’? এইতো বললে, বলার জন্য এখন বলছ, মায়ের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই। কেন ‘মা’ কেন?   তোমার আবার কিসের লজ্জা ‘মা’? ঠিক আছে তোমার জন্ম কি তবে ধলা পানির আগে? কি বললে একটু  বেশি, তবে কি রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে-অহ -৫ম জর্জের আমলে। একটু বেশি একটু বেশি করছ। একটি  গল্প শুনো ‘’মা’। ফ্রান্সের প্রধান সেনাপতি ‘নেপোলিয়ান’। এক সময় সেই দেশে এক বিরাট ঝড় তুফান হয়। বাড়িঘর, গাছগাছালি সবকিছু রাস্তাঘাটের উপরে পড়ে প্রায় যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। নেপোলিয়ান প্রধান সেনাপতি আদেশ করলেন তাঁর সেনাবাহিনিকে, যে একদিনের মধ্যে প্যারিসের সকল রাস্তাঘাট পরিষ্কার করে চলাচলের উপযোগী করতে হবে। সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল পরিষ্কার কাজে । ‘মা’ তুমি হাঁস না, হাঁস না। মুর্খ   ছেলে বই এর কথা কোথা থেকে পেল। ‘মা’ আমরা পড়ে পড়ে শিখিনি, শুনে শুনে শিখেছি ‘মা’। আমারা  প্রশিক্ষনের সময় ‘মা’ তোমার ৯০০ বীর সন্তান একসাথে ট্রেনিং করেছি। রাত্রে বসে গল্প গোজবের সময় একজন এই গল্পটি করেছে। সে দুর্দিনের কষ্ঠের কথাগুলো এখনও মনে আছে ‘মা’। নেপোলিয়ান ছব্দবেশে  নিজে বাহির হয়েছেন তদারকি করার জন্য। তাঁর পরনে ছিল সাদা হাফ পেন্ট ও সাদা হাফ গেঞ্জি। বিশ্বের প্রধান সেনাপতিদের মধ্যে যে কয়জন ক্ষুদ্রকায় ও বিখ্যাত সেনাপতি ছিলেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট দ্যা গ্রেট তাদের একজন। আর আরেকজন ছিলেন আমাদের মুক্তিযদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী। জীপ গাড়ি থেকে সাদা পেন্ট ও গেঞ্জী পরা নেপোলিয়ন জাম্প দিয়ে নেমে পড়লেন। তিনি নিজেই জিপ গাড়িটি  চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নেমে দেখলেন একজন ক্যাপ্টেন গাছের ছায়ায় বসে হুকুম করছেন এবং বলছেন জলদি করো, শক্তি করো। একটি বড় গাছের খন্ডকে  ১০ জন সৈনিক প্রাণপন চেষ্ঠা করেও গাছটি নাড়াতে পারছেনা।   লোকটি ক্যাপ্টেনকে বলল ক্যাপ্টেন চলুন আমরা গাছটি সরাতে হাত লাগাই। ক্যাপ্টেন বলল, তুমি কি পাগল  হয়েছ, তুমি কি এই ব্যাজ গুলো চেন? অপরিচিত লোকটিকে গর্বের সাথে তাঁর বাম বাহুতে ডান হাত দিয়ে তাড়ি দিয়ে বলল আমি নেপোলিয়ান বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন, তুমি কি দেখতে পাওনা। ঠিক আছে, ঠিক আছে ক্যাপ্টেন সাহেব আমিও এই বাহিনীর একজন সামান্য কর্মকর্তা আছি। আমরা দু’জন হাত লাগালে এই গাছটি সরিয়ে ফেলতে পারব। ক্যাপ্টেন বললেন  অহ- অহ বুঝেছি তুমি একজন ফার্স্ট লেফটনেন্ট। তোমার  তো এখন আমাকে স্যালুট করা উচিত। তোমার কি জানা নেই নেপোলিয়ানের সেনাবাহিনিতে নিম্ন পদস্থ সৈনিক উচ্চ পদস্থ কোন সৈনিক দেখা মাত্রই স্যালুট করতে হয়। থামুন থামুন আমি ফার্স্ট লেফটনেন্ট একটু উপরে। ক্যাপ্টেন এর মনে হল লোকটির গার্ড আছে। অহ বলে ক্যাপ্টেন বলল তুমি একজন ক্যাপ্টেন বলে  হাত বাড়িয়ে দিলে। পথিক বললেন থামুন থামুন –I am bit Higher than a captain. তখন ক্যাপ্টেন হাত গুটিয়ে নিয়ে স্যালুট করে বলল আপনে কি মেজর ? পথিক বললেন A bit Higher. তখন পরবর্তী পদবির নাম উচ্চারণ করেন আর স্যালুট করেন।  কিন্তু পথিক তো তাতেও সন্তুষ্ঠ না। এক সময় প্রধান সেনাপতির সামান্য নিচের পদটিতে চলে আসলেন ক্যাপ্টেন মহোদয়। পথিক তাতেও নারাজ। No a bit Higher বলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেন পথিক। ক্যাপ্টেন ঘর্মাক্ত হয়ে বললেন, তাহলে কি আপনে জেনারেল নেপোলিয়ান বোনাপার্ট  দ্যা গ্রেট। এই পদে তো মাত্র একজন লোক থাকেন ,অন্য পদে তো অনেক লোক  থাকেন । পথিক বললেন YES তাহলে চলুন হাত লাগাই। YES Sir হাত লাগাই । এই ছিলেন নেপোলিয়ান।  নেপোলিয়ান রাজত্বের সৌর্য, বীর্য ছিল বিশ্বজোড়া।

মা’গো তুমি ক্লান্ত হয়ে গেছ কি? তাতো হবেই। মাগো গত ১৬ই ডিসেম্বর মাসে ক্যাপ্টেন এর সমতুল্য এক বর্গি পরা পদস্থ লোকের চেয়ার রির্জাভ না থাকায় যে হম্ভি তম্ভি করলেন দেখে মনে হল নেপোলিয়ান এর সামনে  ক্যাপ্টেন এর হম্ভি তম্ভি এর ফটোকপি।

আচ্ছা ‘মা’, তোমার জন্ম সালটা না বল, তোমার জন্ম স্থানটির নাম বল। ‘মা’ নড়েচড়ে বসলেন এবং কবির  কবিতায় বললেন –হিমালয় থেকে সুন্দরবন সবখানেইতো আমি। তাইতো বলতে চাইনা। কি বললে ‘মা’ তোমার জন্মের গল্প শুনলে ভয় পেয়ে যাবো? ঠিক আছে ‘মা’ তোমার জন্মের কথা, তোমার জন্ম স্থানের কথা-আর   জানতে চাইনা। তুমিত ‘মা’,  মায়ের আবার জন্ম তারিখ থাকে নাকি। ভুল হয়ে গেছে ‘মা’। তুমিইত জননী  ,জন্ম ভূমিশ্চ, স্বার্গাদপি গরিয়সী। তোমার জন্ম দিবস যে থাকেনা- তোমার জন্ম দিবস সূর্যের জন্মের সাথে, চন্দ্রের জন্মের পূর্বে। তুমিতো চন্দ্রেরও মাতা। ‘মা’ ললির বিয়ের কি করলে। আমরা তো মাত্র তিনজন লোক। তিনজন ত্রিলোকের অধিবাসী। ললির বিয়েতে যৌতুক থাকবেনা। বয়স বেশি বলে খুটাখুটি দেওয়া চলবেনা। আমার বোনের যন্ত্রনা আমি মেনে নেবনা। লম্বা চুলের ঝাকুনিতে তান্ডব চলবে ‘মা’ তান্ডব। আগের তিতা শেষের মিঠা। সব কিছু আগে থেকে বলে রাখা ভাল মা।

বড় বড় বানরের বড় বড় পেট,লংকায় যাইতে বানর মাথা করে হেট। যারা অনেক অনেক হম্ভি তম্ভি দেখাল তারাতো যুদ্ধে গেলনা ‘মা’। যারা ধনদৌলতের লালসায় মগ্ন ছিল, তারা  তাদের ছেলেমেয়েদের আগলে রেখে দিল। অনেকে সফল হয়েছে আবার অনেকে ব্যর্থ হয়েছে। শুনা যায় জামাই আদর করে বাড়িতে ঠাই দিয়েছেন। জামাই হয়ে কয়েকদিন পর ফেলে দিয়েছে। হায়েনাদের বিশ্বাস করতে নেই। যারা করেছে তারাই ভুগছে। নতজানু প্রকৃতির লোকজন তারা অসভ্য পাক বাহিনীর সাথে সখ্যতা করতে নেমেছে। পাক বাহিনী কিভাবে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে তা বলে বুঝানো যাবে না। পাক বাহিনীর সাথে যারা বন্ধুত্ব করেছে, তাদের আর শত্রুর প্রয়োজন নেই। ওরা তাদের শত্রুর চেয়ে মিত্রদের ক্ষতি করেছে বেশি। তারা চলে যাবার সময় যেভাবে পুল কালভার্ট, দালানকোঠা, ধ্বংস করেছে তাদের সহযোগীতায়, অংশগ্রহনকারী সহযোগী রাজাকাররা হিংসাত্মক হয়ে যেভাবে আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করতে চেয়েছে –তারচেয়ে আরো বেশি করে এই বর্বর বাহিনী তাহাদের নিজেদের নষ্ঠ করেছে। Money is lost Nothing  lost, Health is lost something lost but character is lost everything is lost.

এই ঘৃণিত বর্বরদের সাথে যারা আত্নীয়তা করেছে উভয়েরই বিন্দু পরিমান মান মর্যাদা –ইজ্জত বলতে কিছুই থাকে নি, থাকে নাই। বর্বরদের যারা আত্নীয় বলে নিয়েছে তাহাদের সাথে, তাদের লতের সাথে কোন সর্ম্পক নেই, থাকতে পারেনা। যে ব্যবহারে নিজের মা অসন্তুষ্ঠ হবেন সেই সর্ম্পক কিছুতেই করা উচিত নয়। এখনও মাছের জিহ্বা লিক-লিক করছে পুরোনো বন্ধুদের সাথে সর্ম্পক স্থাপনের –তাদের আশায় গুড়েবালি।

বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান এইবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান। আপনি কম্বল ছাড়তে চাইলেও কম্বল আপনাকে ছাড়েনা। গল্পের মত কথাটির অর্থ এই যে, কোন একদিন অনবরত ২৪ ঘন্টা ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে পাহাড়ী ধ্বসে অনেক গাছপালা,পশুপাখি বন্যার তুড়ে নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল। সকালবেলা গ্রামবাসী দাঁড়িয়ে এই তান্ডবলীলা দেখছিলেন। সেখানে বড় বড় গাছ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। একবার গাছের পাতা ও ডাল পানির উপরে ভেসে উঠেছে। অন্যবার গাছের গোড়ার দিক ভেসে উঠেছে বলে মনে হয়েছে।–যেন একটি হাতি উঠে আসল। কোন কোন সময় দেখা যায় একটি জীবন্ত হাতির শুঁড় সোজা উপরের দিকে উঠে  আসে আবার পিছনের লেজ পরক্ষনে দেখা যায়। এইভাবে নানান মূল্যবান সম্পদ নদী দিয়ে ভেসে চলেছে।  হঠাৎ একদিন দেখলেন একটি নতুন সুন্দর চকচকে কম্বল নদীর জলে ভেসে উঠেছে। কম্বলটি একটি গোলাকার  বৃত্তের মত ঘুরতে ঘুরতে ভাটির দিকে দ্রুত চলে যাচ্ছে। এক লোভী গ্রামবাসী কম্বলটি উঠিয়ে আনতে চায়। সে কম্বলটি আনার জন্য ঝাপ দিয়ে নদীতে পড়ে গেল। সাতরে কোন রকমে কম্বলের কাছে গিয়ে কম্বলটিকে ধরে  ফেলল। সে ঠান্ডা পানিতে অনুভব করল পানির নিচে তাকেও কে যে ধরে ফেলল। অনেক টানাটানি হল কম্বলটিকে । যখন তীরে দাঁড়িয়ে থাকা সকলেই দেখল যে কৃষক কোনভাবেই কম্বলটিকে আনতে পারছে না।  বরং পানির তোড়ে কৃষক ও কম্বল চলে যাচ্ছে। তীর থেকে দর্শকরা চেচিয়ে বলল ও ভাই তাড়াতাড়ি তীরে চলে আস। বিপদী কৃষক বলল আমি পারছিনা। তখন তীরের কৃষকরা বলল কম্বল ছেড়ে চলে আস। তখন পানির কৃষক কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল আমিতো কবে কম্বল ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু “কম্বল বি মুঝে নাই ছুড়তা”।  কারন বানের পানিতে ধূয়া কম্বলটি ছিল একটি বড় রকমের ভালুক। যা হবার তাইত হল।

“যাকে মারতে পারিনা হাতে,তাকে মারব ভাতে”।

যুদ্ধ শেষের দিকে পাক বাহিনী সকল কিছু ভেঙ্গে দুমড়ে চলে যাওয়ার সময় তাহাদের উদ্দেশ্য ছিল যখন সকল আর্ন্তজাতিক সহায়তা রাজনীতি আমাদের পক্ষে চলে আসছে তখন এই নিষ্ঠুর শত্রুরা  খাবার-দাবার, যোগাযোগ বাবদ বেসামাল অবস্থায় পড়ে। আবার তাহাদের সাথে হাতে-পায়ে ধরে এক হল সব। এই রকম  একটি ভ্রান্ত চিন্তা নিয়ে তারা আমাদের বিজ্ঞানী, শিল্পপতি, লেখক, পন্ডিতদের ধরে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। তাদের এই চিন্তা ব্যবস্থায় সাহায্য করেছে আমাদের দেশের কুলাংগাররা। ফলে ১৪ই ডিসেম্বর এক ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ সংগঠিত হয়। যাহা ইতিহাসে বিরল। একসময় তারা সফলতার দিকে এগিয়ে গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে গেল। আজ আমরা তাদের ঠেং ভেঙ্গে দিয়েছি।

২৮ দিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ভুখা, নাংগা, গামছা পরা আবাল, বৃদ্ধ বনীতা, যেখানে ৯ বছরের বালক থেকে শুরু করে প্রত্যেক্ষ যুদ্ধে ৫৩/৫৫ বছরের বৃদ্ধ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল “মা’, গুঠিকয়েক রাজাকার ছাড়া সবাই। ২৬শে মার্চ  স্বাধীনতা ঘোষনার সাথে সাথে ৭ই মার্চের সকল নির্দেশনা মন্ত্রের মত কাজে লেগে যায়। সংগঠন ঠিক করে, নিজের সঙ্গী-সাথী ঠিক করে রওয়ানা দেবার সময় ঠিক করা হত।

যথাসময়ে যাত্রা শুরু হল। পূর্বদিক থেকে গমন। লক্ষস্থল আসামের করিমগঞ্জ। পৌঁছেই দেখা গেল করিমগঞ্জে জয় বাংলার লোকজন গমগম করছে এবং টাউন হল থেকে তালিকাভুক্ত হয়ে আর্মির গাড়িতে করে নির্দিষ্ঠ স্থানে পৌছছে। অনেক সময় আছে সদ্য আগত মুক্তিযোদ্ধাটি পরিচিত লোকজন পেয়ে দাঁড়ানো গাড়িতে ওঠে পড়েছে। তালিকা দিয়ে কি দরকার, যুদ্ধই দরকার। পৌছার সাথে সাথেই তাবু তৈরির ট্রেনিং শুরু হয়ে যায়। যেখানে আমরা রাত্রি যাপন করব। সাধারনত পাহাড়ের উপরে ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। দু ‘স্তর বিশিষ্ঠ তাবু নির্মান, চর্তুদিকে নালা কেটে তাবুর নিরাপত্তা স্থাপন এবং তাবু টানিয়ে খুটার পিছনে শক্ত রশি দিয়ে খুটা স্থাপন করে দু’চালা পদ্ধতিতে গৃহ নির্মান এক চমৎকার নির্মান শৈলী। একেকটি টিলায় প্রায় ৩০টি তাবু নির্মান  করে তখনটায় শেষ করা হয়। রওয়ানা হওয়ার পরের দিন ভোরে নির্দিষ্ঠ স্থান ‘ওমরা নগরে’ আমারা পৌঁছি। পৌঁছেই চারদিকে আমরা চেয়ে দেখলাম। চারদিকে মেঘমালা লেগে আছে। এই নগরটির নাম ‘ওমরা নগর’, তাহা একটি প্রত্নতাত্বিক নগর। কোন সৈনিক প্রশ্নের উত্তর দেয়না, নিশ্চুপ থাকে। স্থানীয়  লোকজন পাওয়া যায় না, যাতে স্থানের নাম জিজ্ঞাসা করা যায়। খাসিয়ার মত কোন বৃদ্ধা মেয়েলোকের দেখা মিললে মামী, মাসী  বলে ডাকলে এগুলো বুঝছে না বলে পাত্তা দেয়না । ওরা যেমন আমাদের ভাষা বুঝেনা, তেমনি আমরাও তাদের ভাষা বুঝি না। একদিন বলতে গেলে এক পাহাড়ের চূড়ায় একটি অপ্রত্যাশিত পাথরের সদ্ধান মিলল। তাতে  ইংরেজীতে লেখা আছে। সেই সময় আমাদের সাথে যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিল তাদের মধ্যে প্রায় ৮০% লোক ইংরেজী জানত না। ৯৭% লোক ইংরেজী অক্ষর চিনলেও শুদ্ধ করে উচ্চারন করতে পারতনা। যাহা হোক অনেক চেষ্ঠা করে জানা গেছে  জায়গাটির নাম ‘ওমরা নগর’। এটি ছিল একটি আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের আনন্দই বিশেষ পাওনা।

বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ছিল গেরিলা ট্রেনিং । অনেকে মনে করত আমারা হয়ত নিয়মিত বাহিনী হয়ে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে  লিপ্ত হয়ে ওদেরকে পর্যদুস্থ করব। কিন্তু আমরা ছিলাম গেরিলা যোদ্ধা। আমাদের নীতি কৌশলই ছিল গেরিলা যোদ্ধাদের প্রতিরূপ । আমাদের যুদ্ধে পাঠিয়ে বলা হত, hit and run, মার এবং পলায়ন কর। দুষমনকে হত্যা করে পলায়ন কর। অন্য শিকারের জন্য অপেক্ষা করনা। শিখানো হত, “Slience is the Greatest weapon, darkness is the greatest Friend”. (চলবে)

সুবল চন্দ্র পাল: বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ।সিলেট জেলা ঐক্য ন্যাপের সভাপতি।

 

You might also like