মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা-৩
সুবল চন্দ্র পাল
সুবল চন্দ্র পাল। ৭১ এর রনাঙ্গন কাঁপানো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, ছিলেন পাকিস্তানী হানাদারদের আতঙ্ক। ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদারদের আত্মসমর্থনের কদিন আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের যে গ্রুপটি সিলেটের জালালপুর মুক্ত ঘোষণা করে লাল সবুজ পতাকা উড়িয়ে ছিলেন, সেই গ্রুপেরই অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর অস্ত্র জমা দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশটি পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন বীর এই মুক্তিযোদ্ধা। প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন ন্যাপের নেতা হিসেবে ঝাপিয়ে পড়েন মানব উন্নয়নের কাজে। নিজ এলাকা জালালপুরে বৈরাগীর বাজারে প্রতিষ্ঠা করেন হাই স্কুল এবং এই স্কুলের অবৈতনিক প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। জনগণের চাঁদায় বড়ভাঙ্গা নদীতে নির্মাণ করেন একটি সেতু। সেতুটির উদ্বোধন করেছিলেন প্রয়াত জননেতা পীর হবিবুর রহমান। মানবপ্রেমিক এই মানুষটির বিশাল হৃদয়টি ভরে আছে মানুষের জন্য ভালোবাসায়।এই ভালোবাসার ভার বহন করতে গিয়েই হয়তো সম্প্রতি বিগড়ে গিয়েছিলো তার এই হৃদয়। হয়েছিলেন হৃদরোগে আক্রান্ত। অপেন হার্ট সার্জারির পর সম্প্রতি ফিরেছেন নিজ বাড়ীতে। সত্যবাণী সম্পাদকসহ তাঁর এক সময়ের রাজনৈতিক অনুসারীদের একটি গ্রুপ তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন তাঁর গ্রামের বাড়ীতে। অসুস্থতা ভুলে তাদের সাথে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক ভাবনা, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতি অনেক কিছুই শেয়ার করেন তিনি এসময় তাদের সাথে। এ বিষয়ে কাগজে লিপিবদ্ধ তার লিখাটি নিয়ে আসে সত্যবাণী। পাঁচ পর্বে বিভক্ত এই লেখার তৃতীয় পর্বটি আজ তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য।-সম্পাদক।
৩য় পর্ব
যুদ্ধে গেরিলা মরেনা। শত্রুকে মারতে পার বা না পার নিজে মরতে পারবে না। গেরিলা যুদ্ধকে বছরের পর বছর চালিয়ে যেতে হবে। গেরিলার ছেলে হবে গেরিলা। আসলে গেরিলা একটি জন্তু। গেরিলার আশ্রয়দাতা গেরিলা। গেরিলাদের যিনি খাবার খাওয়াবেন তিনিও গেরিলা। গেরিলারা কখনও শেষ হয়ে যায়না । গেরিলা যুদ্ধ শুরু হলে হয় বিজয় না হলে চিরকাল যুদ্ধ চলে। আমাদের এই স্বাধীনতা যুদ্ধ গেরিলা যুদ্ধা ও নিয়মিত যোদ্ধা একত্রিত হয়ে এক মহামায়ারুপি যুদ্ধে পরিনত হয়ে ৯ মাসে বিজয় নিয়ে এসেছে। তাতে বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় । অনেক যুদ্ধ বিশারদ অবাক হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফলাফল নিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে । নতুন সুত্র গঠনের চেষ্ঠা চলছে বলে আমার বিশ্বাস। ‘Necessity knows no Laws”-এই শিক্ষাদীক্ষা হীন কৃষক মুক্তিযোদ্ধারা যে ২৮ দিনে প্রায় ১০টি যুদ্ধাস্ত্রের চালনা, খুলা ও জুড়া লাগানো শিখতে পারল তাহাও বিশ্বের এক বিস্ময় । ১টি রাইফেলের বিভিন্ন অংশ চিনা, নাম শিখা, কার্যক্রম শিখা, চেম্বারে গুলি তুলা, ম্যাগজিনে গুলি ভর্তি করা, বেয়নেট খুলা ও জুড়া লাগানো, কাকনের হাতলের সাহায্যে কাজ করা, টার্গেটে এইম করা এবং ফায়ার করা, Spring gridge করা সর্বশেষে গুলি রুক আউট হলে রাইফেল খুলা ও জুড়া দেওয়া শিখতে হত। এইভাবে ১০/১৫ টি অস্ত্র খুলা ও জুড়া দেওয়া শিখতে হয়েছে। যে অস্ত্র গুলো চালনা আমরা শিক্ষা নিয়েছি তাঁর মধ্যে প্রধান হল- রাইফেল, ষ্টেনগান, টমিগান, লাইট মেশিনগান বা ঠেংগীদা, Antipersonal mine, AntiTank Mine, Hand grenade, Morter, Dinamite,explosive ইত্যাদি। Explosive dynamite ও Morter ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি অস্ত্র সর্ম্পকে প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধাকে ধারনা রাখতে হত। এটা কি ‘মা’ এত সহজ কাজ ছিল। এই যন্ত্রগুলোর প্রত্যেকটি নাম ইংরেজী। কম শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মত নাম জুড়িয়ে অস্ত্র সম্মদ্ধে শিখে নিত।
তুমিতো ‘মা’ রিফিউজিদের ঢল দেখেছ, মুক্তিযোদ্ধাদের ঢলও নিশ্চয়ই দেখেছ। প্রয়োজন কিভাবে মানুষকে সবকিছু শিখিয়ে দেয় তুমি তো মা খুব ভাল বুঝ। একবার ১৯৭১সালে অক্টোবর মাসে Anterior party হিসেবে বাংলাদেশের ভিতরে ঢুকে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করি। প্রায় ৪০জন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল বাংলাদেশের ভিতরে জালালপুর নামক অঞ্চলে ঢুকে পরার সিদ্ধান্ত হয়। সেই ১৯৭১ সালে অক্টোবর মাসের বোধ হয় ২য় সপ্তাহে রোজার মাস ছিল মাগো। তুমিতো জান মা সেই সময় দল বেঁধে পুরো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বর্ডার অঞ্চল থেকে প্রায় ৫০/৬০ মাইল অভ্যন্তরে সসস্ত্রভাবে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়া বড়ই বিপদজ্জনক কাজ ছিল। আবার অনেকের কাছে বেশ আনন্দেরও বিষয় ছিল। কারন এই অঞ্চলে অনেকের বাড়িঘর ছিল। কারন তুমিতো জান মা বাঙ্গালীরা তোমাকে বেশিদিন না দেখে বাইরে থাকতে পারেনা । মা ছাড়া জীবন কিভাবে চলে। মাকে দেখতে এসে কত মুক্তিযোদ্ধার প্রান গেছে তাঁর ইয়াত্বা নেই। মাগো তোমার জন্য আমরা কত রক্ত দিয়েছি আর কোন মায়ের জন্য এত রক্তের ঢল নামতে আমরা দেখেনি। তুমি ধন্য মা, তুমি ধন্য।
রওয়ানা দেওয়ার কয়েকদিন পূর্ব থেকে প্রস্তুতি কাজ চলছে –কিছু রাইফেল প্রথমে পলিথিনে ভরা এবং পরিশেষে ৫টি রাইফেল একত্র করে বেঁধে বস্তায় ভরা হয়। এগুলো নৌকায় করে ভাদেশ্বর এলাকার নালিউরিতে পৌঁছানো হবে। তিনটি রাস্তা ধরে জালালপুর পৌঁছানো হবে। সে যাক রওয়ানার প্রস্তুতি কাজে আমরা সকলেই প্রস্তুতি কাজ সমাপ্ত করে নৈতিক কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য আমাদের বার বার বসতে হয়। এক পর্যায়ে বলা হয় যাহারা কলিমা জানেননা তারা যেন স্ব-উদ্যেগে সকলের মঙ্গলের জন্য কলিমা মুখস্ত বলতে হবে। ইহাতে আমরা সকলেই একমত হই। বিভিন্ন ব্যবস্থায় যাত্রার দিন এসে যায় মা, কিন্তু আমার আর কলিমা মুখস্থ করা হয় নাই। কোন ক্রমেই আমরা তারিখ পেছাতে চাইনা। অনেক গ্রুপ তারিখ পেছাতে পেছাতে program টি নষ্ঠ হয়ে গেছে। তাই নির্দিষ্ঠ তারিখে আমরা দুজন অগ্রগামী দল হিসেবে আব্দুল মালিক গেদাই মিয়া ও আমি জকিগঞ্জের হাওর দিয়ে ঘাসিরা নৌকা যোগে চূড়খাই থেকে কিছু দূরে সম্মুখ পথে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেই। মাঝি ভাই আমাদের সড়কের পাশে নামিয়ে দিয়ে শুধু বামের দিকে সিলেট এই কথাটি বলে নৌকা নিয়ে ফিরে গেলেন। আমারা রাস্তার নিচে দাঁড়িয়ে হাতপা মুছে নেই গামছা দিয়ে। আমারা দুজন একই বিদ্যালয়ে ক্রীড়াবিধ। রাস্তার উপরে চলে আসলাম এবং হাটতে শুরু করলাম। আমাদের দুজনের একটি অন্তমিল ছিল যে আমরা কোন ভয় না পেয়ে দুজনে –দুজনের দুঃখের কথা বলতে বলতে পশ্চিম দিকে হেটে রওয়ানা দিলাম। সামান্য কিছুদূর আগাতেই পাওয়া গেল একটি কালভার্ট । তাহার পাশে একটি বাঁশের ঘর বানিয়ে ৫/৬ জন রাজাকার অবস্থান করছিল। আমারা দুজন কৃষক দেখেই তাদের কমান্ডার ডাক দিলেন ‘হেই এদিকে আস’ । ডাকের সাথে সাথেই আমরা আমাদের চেহারা পরিবর্তন করে ফেলি। আব্দুল মালিক সে তাঁর দু হাত প্রায় কাছাকাছি নিয়ে আসল । বুঝা গেল ভিক্ষা করার মত ভিখারী আছে। আমার এই ক্ষমতা নেই ,কিন্তু মুখের চেহারা এত কাতর করলাম যে আমাকে আট আনা, ১টাকা ভিক্ষা, না হাত উঠানো প্রায় অসম্ভব। এই অবস্থায় আমরা দুজন তাদের তাবুর খড়ের দরজায় গিয়ে উপস্থিত হলাম। যাওয়ার সময় দেখলাম হাজার বাঁশের খোচা নিচু পানির দিকে রাখা হয়েছে। ভিতর থেকে একজন বলল হিন্দুস্থান থেকে আসছ? আমি বললাম না স্যার। আমার মত একজন কৃষকের মুখে স্যার ডাক শুনে কাপড় শুকাতে দেওয়া রাজাকার বলল তুমি তো লেখাপড়া জান। না স্যার আজ প্রায় তিনদিন আগে আমাদের ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনীর সৈনিকরা। এই তিনদিন শুধু আমাদেরকে দিয়ে গুলির বাক্স বহন করিয়েছে। ভাল খাবার দেয় নাই ,তাই আমরা গরীব মানুষ ১টা টাকাও মার কাছে পাঠাতে পারবো না। তাই চলে এসেছি। মনে হল তাদের দয়া হল। বলল হাত দেখি। কুনি ও কাধে হাত দিয়ে টিপে বলল চকিতে বস, চা খাবে পরে ১ম সিলেটের বাসে তুলে দিব। আশ্বস্থ হয়ে বসে পড়লাম।
আমিতো কলিমা শিখে আসি নাই। গাড়ির সীটের মধ্যে বসে ছাদের দিকে ছেয়ে আছি। যাত্রীদের মধ্যে দুএকজনকে বলতে শুনলাম, এখন কলিমা ট্রেনিং শুরু হয়ে যাবে। আমি অসহায়ের মত সীটে বসে আছি। দেখলাম আব্দুল মালিক গেদাই বাস থেকে নামার জন্য আমার দিকে একবার তাকালো। বুঝতেও পারলনা আমার ভিতরে কি চলছে। কি হবে সীটে তো বসে থাকা যাবেনা । হায়েনারা মুড়িড়টিনের জানালা দিয়ে উকি মেরে দেখছে। কি থেকে কি হয় নাকি। অসহায়ের জন্য তো ঈশ্বর দুহাত পাতিয়ে রয়েছেন। সে চিন্তা একবারই তো মনে এলনা। হঠাত দেখলাম আকাশ ভেদ করে একটি আয়াত ড্রাইভারের সীটের উপর কপালের দিকে বাংলা লেখায় চলে এসেছে। দেখেই বুকের ধপরানি একটু কমে আসল। লেখাটি একবার, দুবার পরলাম, ৩য় বার না দেখে পরলাম। দেখলাম মুখস্ত হয়ে গেছে। বাংলা বানানে ভুল শুদ্ধভাবে লেখা ছিল –‘লা ইলাহা ইন্না আন্তা সুবাহানাকা ইন্তি কুন্তু মিনাজ জুয়ালিমিন’। যতবারই কলিমার কথা বলবে ততবারই বলব এই কথাগুলোই । যাহা হয় হউক। চূড়খাই নেমে দুটি লাইন হলাম। আমাকে গুত্তা মেরে এক হায়েনা বলল এই লাইন ধর। আমি চলে গেলাম আব্দুল মালিক গেদাইয়ের লাইনে। দেখলাম আমার লাইন ছেড়ে সে অন্য লাইনে চলে গেল। মনে মনে একটু কষ্ঠ পেলাম। যাক সে সময় ছিল রমযানের দিন। আমরা কদমতলি এসে ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় ২টি লাইন করে দুদিকে গেলাম এবং কলিমা বলার কথা বললে দুএকবার লা-ইলাহা বলার সাথে সাথে যাও যাও বলে আমাদেরকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল। প্রায় বিকাল হয়ে গেয়েছিল, রোযার তাড়াহুড়ো লেগে গেছে। সকলেই প্রায় দৌড়ে গিয়ে চাদনী ঘাটের দিকে রওয়ানা দিলাম। চাঁদনী ঘাটে গিয়ে দুই আটি লাকড়ি নিয়ে যেন আমরা এ যাত্রায় সফল হয়ে গেলাম। দুষমনের গলার ভিতরে ঢুকেছি। এখন আর হাতুড়ি, বাটাইল, রাইফেল কিংবা স্টেনগান ব্যবহার করে বাহির করা যাবে না। রওয়ানা হলাম চন্ডীপুল থেকে জালালপুরের দিকে। ১০ টাকা ভাড়ায় চকের বাজার পর্যন্ত একটি রিকশা ভাড়া করেছি। দুই টাকা দিয়ে ইফতারের সময় এক মচা জিলাপি কিনেছি। সেই সময় জিলাপিতে বড়বেশি রস থাকত। মচাটি প্রায় ভিজে যেত। চন্ডিপুলের কাছে এসে আমাদের হাড় কাপনি ভয়। ভয় হলে কি হবে, যেতে তো হবে, মার তো কোন রাস্তা নেই। রিকশার ড্রাইভার আমাদের নির্বাক অবস্থা দেখে বুঝে ফেলেছে বলে বিশ্বাস। চন্ডীপুলের ডানদিকে বড় বটগাছের নীচে পাকিস্তানীদের ক্যাম্প ও তাবু ছিল। এখানে তারা দিনেরাতে ডিউটি করত। আমার রিকশার সাথী গেদাই গালাগালিতে যারপর নাই ওস্তাদ ছিল। কাহারও অনুপস্থিতিতে নটির পোয়া অমুক থেকে শুরু করে বাংলাদেশ-পাকিস্তানে যত কড়াকড়া গালি আছে সে পারত। ইহার এক অস্ত্র ছিল। তাহার গ্রামের লোক তাহাকে ভীষন ভয় পেত। চন্ডীপুলের কাছে গিয়ে রিকশার ড্রাইভার এতজোরে সিটের উপর দাঁড়িয়ে পেডেল মারতে লাগল যে, আমার যাত্রীরা রোজা রেখেছে এমন যে বোঝা যায়। সময় মত তাদেরকে পৌঁছে দিতে না পারলে ইফতার হবেনা। তুমিতো রোজই আস। অন্যদিন চেক করলে চলবে। একজন পাঞ্জাবি হাত তুলে দিয়েছিল, ড্রাইভার –ভ্রুক্ষেপ না করে রিকশা চালিয়ে গেল। আমরা তো বেরিয়ে গেলাম । তাহাকে তো ফেরত আসতে হবে।
চন্ডিপুল থেকে জালালপুরের রাস্তায় প্রায় ৫০০ গজ দূরে প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো একটি বরই গাছ ছিল । আমি প্রথমে আনন্দের আতিশয্যে দেড় টাকা দিয়ে কিনে আনা লাকড়ির আটি লাথি মেরে ফেলে দিলাম। এবং সঙ্গীকে বললাম নেমে পড়। তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ধাক্কা মেরে রিকশা থেকে নামিয়ে আবার দুই আটি লাকড়ি রিকশায় তুলে দিয়ে এবং ১০ টাকা ভাড়া দিয়ে বললাম ভাই ফেরত চলে যাও। আমাদের আর লাকড়ি লাগবে না । সে কতক্ষন আহম্মকের মত তাকিয়ে থাকল এবং সিলেটের দিকে গমন করল। আমাদের লম্বা লা চুল খালিগা একটি মাত্র গামছা, সে হয়ত ভেবেছে আমরা পাগল নয়ত অন্যকিছু। কিন্তু তুমিও কি মা আমাদের এই লম্বা লাল চুল ও খালি শরীর দেখে আমাদের চিনতে পারো নাই মা। মাগো তুমি আমাদের পেটের দিকে একবার খেয়াল করেছ, পেটটি খাল হয়ে রয়েছে। তুমিতো জান মা এই আধা লম্বা লাল চুলই আমাদের অস্ত্র। আমরাতো মা পাহাড়ের উপর দিয়ে আর জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেটে চলার সময় রাতের বেলা এক ফুটো পানি নেই। হঠাত বৃষ্ঠি আসলে তো পানি পানের মহোৎসব লেগে যায়। পানির পিপাসায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে বৃষ্ঠি হলে আমারা কিভাবে পানি পান করতাম বলত মা বল। কিভাবে পিপাসার্তরা পিপাসা মিঠাত। তুমিও বলবে না মা। আমরাতো মা সামনের চুল গুলোকে দুইদিকে ভাগ করে ডানচোয়ালের দিকে অর্ধেক আর বামচোয়ালের দিকে অর্ধেক চুল মুখে ভরে দিতাম। আর লেবেন চুষের মত পানির পিপাসা মিটত । মাগো তোমার এক ফুটো দুধের দাম কেহ দিতে পারেনা মা। মাগো এক ফুটো পানির দাম কি এত নগন্য। যাদের বেশি পানির পিপাশা থাকতো তারা তো চুষনীর মত চুষে তাঁর ক্ষিধে মিটছে, তাদের কিভাবে পিপাশা মিটাবেন। তাঁর শার্ট অথবা গেঞ্জী বৃষ্টির পানিতে ভিজিয়ে চিপিয়ে মুখে চিপিয়ে দিত। তাওতো তৃষিতের পানি দান। এইভাবে গাছের পাতা খেয়ে, পোকামাখড় খেয়ে জীবন চালাতে হয়েছে। কোন সময় চরথাপুড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গেছে। তবুও তো মুক্তিযোদ্ধা ত্যাগি হয় নাই। মা’গো ওদের কি কোন দাম নাই। মা মেঝ ভাইয়ের মত দুধের মত পরিষ্কার কি সুন্দর নাক উঁচু, কিনকিনে জামা, পাজামা, জোতার দিকেত তাকালে ‘মা’ চোখ কেড়ে নেয়। তারাই যদি মুক্তিযুদ্ধে আসত, তাহলে কি নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধ হত। মেঝ ভাইরা ৫ দিনেই স্বপক্ষ ত্যাগ করে অপর পক্ষে আত্নসমর্পন করত। তখন কি আর যুদ্ধ থাকত। চাইনা মাগো রাজা হতে, রাজা হবার সাধ নাই মাগো, চাই শুধু মা তোমার চরন পেতে।(চলবে)
সুবল চন্দ্র পাল: বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ।সিলেট জেলা ঐক্য ন্যাপের সভাপতি।