যা ভাবছি পঁচিশে বৈশাখে
দিলীপ মজুমদার
আজ পঁচিশে বৈশাখ। একে বাঙালি বারো মাসের তেরো পার্বণ করে নিয়েছে। কত অনুষ্ঠান, কত গান, কত নাটক , কত নৃত্য, কত আবৃত্তি। এবারে সেসব বন্ধ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। তা না হলে অদৃশ্য সেই অণুজীব টুক করে ঢুকে পড়বে আমাদের নাক অথবা মুখের ছিদ্র দিয়ে। তারপরে প্রাণান্তকর কাণ্ড!
এ হল এক ভাইরাস। আজ পঁচিশে বৈশাখ ভাইরাসের কথা বলছি কেন? তথাকথিত রবীন্দ্রভক্তরা মুখ বেঁকাবেন নিশ্চিত। তাঁদের কাছে রবীন্দ্রনাথ ‘গুরুদেব’, তাঁদের কাছে তিনি ঈশ্বর। গুরুবাদী এই দেশে ভক্তের অত্যুক্তি বড় বিভ্রান্তি ঘটায়। বুঝেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সেটা। পূজার ছলে ভুলে থাকার সেই কথা। আমি তেমন ভক্ত নই। তাই আমি আজ ভাবছি ভাইরাসের কথা। তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের কথা।
মানুষের জন্মের আগেই পৃথিবীতে এসেছে ভাইরাস। বোধহয় ৫০ লক্ষ বছর আগে। আজও পৃথিবীতে এক হাজারের বেশি প্রকৃতির ভাইরাস আছে বহাল তবিয়তে। কিছু ভাইরাস এনেছে মৃত্যুর পরোয়ানা। প্রকৃতিদত্ত প্রতিরোধ শক্তি দিয়ে মানুষ তাকে জয় করেছে। তবে গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে মরণ ভাইরাসের লীলাখেলা বেড়েছে অনেকবেশি। আজকের করোনা ভাইরাস তাদেরই সুযোগ্য উত্তরসূরী। সে ছুঁয়ে ফেলেছে পৃথিবীর ২১৫টির বেশি দেশ। মেঘনাদ ইন্দ্রজিতের মতো সে আড়ালে থেকে বিস্ময় বিমূঢ় করে তুলছে বিদ্যাদিগগজ মানুষকে। ক্ষণে ক্ষণে বদলে ফেলছে রূপ। চিনে একরকম, তো ইতালিতে অন্যরকম ; আবার ভারতে এসে ভেক বদল।
যদি মেনেও নিই যে চিনের গবেষণাগারে করোনার জন্ম হয় নি, তবু বলতে হবে এই ভাইরাসের উদ্ভব ও বিস্তৃতির জন্য মানুষই দায়ী। বন কেটে, গাছ কেটে ফেলে মানুষ বিপন্ন করে তুলছে বন্য প্রানীদের, মানুষের সঙ্গে বন্য প্রাণীর দূরত্বের সীমারেখা মুছে যাচ্ছে। বন্য প্রাণীর ভাইরাস ঢুকে যাচ্ছে মানব শরীরে। যাকে জুনোটিক সংক্রমণ বলছেন বিজ্ঞানীরা। জিকা, ইবোলা, সার্স, মার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানী নন। কিন্তু তাঁর সহজাত চেতনায় ধরা পড়েছিল গাছের সঙ্গে, বনের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের নিগূঢ় সম্পর্কের কথা। এ শুধু নিছক ‘প্রকৃতিপ্রেম’ নয়। তার চেয়ে গভীর কিছু। জন্মজন্মান্তরের সম্পর্কের অনুভূতি। একটা অদ্ভুত বিশ্বাত্মবোধ। অনেক কিছু না পড়ে শুধু ‘সমুদ্রের প্রতি’ আর ‘বসুন্ধরা’ পড়লেই অনেকটা বোঝা যায়। বন্ধু জগদীশচন্দ্র গাছের প্রাণ-রহস্যের সন্ধান করেছিলেন, জগদীশের বন্ধুর কাছে সমস্ত মূক প্রকৃতিই প্রাণময়। ‘শুভা’ অথবা ‘বলাই’ গল্পে তার স্পষ্ট আভাস।
একালের ইকোক্রিটিসিজমের আলোকে কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’কে বিচার করা হয়। সে নাটকের চতুর্থ অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যকে ল্যান্ডমার্ক বলা হয়। তপোবনে মানুষ ও প্রকৃতির সমন্বয়ের ছবি আমরা সেখান থেকেই পাই। পাই ‘রামায়ণে’ও। প্রকৃতি সম্পর্কে একটা সর্বাত্মক দৃষ্টি। বাল্মীকি, কালিদাস ও প্রাচীন ভারতের প্রকৃতিচেতনা প্রভাবিত করেছিল রবীন্দ্রনাথকে। তার সঙ্গে মিলেছিল তাঁর সহজাত বিজ্ঞানদৃষ্টি। শিল্পবিপ্লবোত্তর পাশ্চাত্য জগত যেভাবে নগরায়ণের জন্য মত্ত হয়ে উঠেছে, যেভাবে যন্ত্রনির্ভর হয়ে উঠেছে, যেভাবে ক্রমবর্ধমান কল-কারখানা বিষিয়ে দিচ্ছে পরিবেশকে, তা তিনি বড় উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলেন। তাঁর বহু প্রবন্ধে ও নাটকে সে কথা বলা হয়েছে। ‘মুক্তধারা’ আর ‘রক্তকরবী’র ভবিয্যদ্বাণী এখন তো প্রত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছি। পুঁজিবাদী সভ্যতার সঙ্গে প্রকৃতি ও পরিবেশের বৈরিমূলক সম্পর্ক (antagonistic contradiction) যেন ধরা পড়েছিল তাঁর চেতনায়।
তাঁর জন্মের আগে ১৮৪৮ সালে কার্ল মার্কস তাঁর ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’তে প্রায় কবিতার ভাষায় বলেছিলেন যে ধনতান্ত্রিক সভ্যতা মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ককে বিষাক্ত করে দিয়েছে। মার্কসের বন্ধু ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস ১৮৭৬ সালে ‘ বানর থেকে মানুষে বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা’ বইটিতে লিখেছিলেন :
উপনিবেশবাদীরা যেমন অন্য দেশ জয় করে, তেমনি মানুষ যদি ভাবে প্রকৃতি জয় করবে, তাহলে মস্ত ভুল করবে; তাহলে একদিন প্রকৃতিও প্রতিশোধ গ্রহণ করবে। কমিউনিস্ট দেশ বলে পরিচিত দেশগুলি সেকথা মনে রাখে নি। তারাও লাভ ও লোভের নেশায় মেতে ধ্বংস করে যাচ্ছে প্রকৃতিকে। চিনের যে উহান আজ বিতর্কের কেন্দ্র, সে তো প্রকৃতিসম্পর্কবিরহিত নিছক এক যন্ত্রনির্ভর বাণিজ্যনগরী।
রবীন্দ্রনাথ শুধু প্রকৃতি ও মানুষের অন্তরঙ্গ সুসম্পর্কের কথাই ভাবেন নি, তাকে বাস্তবে রূপ দেবার চেষ্টাও করেছিলেন কিছুটা। তিনি শান্তিনিকেতন গড়তে চেয়েছিলেন সেভাবেই। আয়োজন করেছিলেন বনমহোৎসবের। প্রকৃতির সঙ্গে ছাত্রদের নিবিড় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তাঁর সময়কার বিবিধ বিভাগের শিক্ষকরা।
আজ করোনাকবলিত পঁচিশে বৈশাখে বুঝতে পারছি ফিরতেই হবে আমাদের প্রকৃতির কাছে। তার নয়নাভিরাম শোভা নিয়ে কবিত্ব করার জন্য নয়, আমাদের আশ্রয়ের জন্য, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। প্রকৃতির ভেতরকার নিয়ম আবিষ্কার করে প্রাণিকুলের মঙ্গলের জন্য আমরা শুধু প্রয়োগ করতে পারি, তার সঙ্গে যুদ্ধ করার, তাকে জয় করার দুরভিসন্ধি যেন আমাদের না হয়
(লেখক: কলকাতার অধিবাসী সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট)