শতবর্ষে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন

 দিলীপ মজুমদার

 

শতবর্ষে পা দিল নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। এই একশো বছরে  কত মহাজনের পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে এই সংগঠন ; কত আলোচনা, কত বিতর্ক, কত প্রস্তাবে মুখরিত হয়েছে।সে সব ইতিহাস হারিয়ে যাবারই কথা। হারিয়ে গিয়েছে তার অনেক কথা। মনে আসে বঙ্কিমচন্দ্রের আপসোসের কথা। ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস নাই, বাঙ্গালী ইতিহাস লিখিতে জানে না’, কথাগুলি প্রতিধ্বনিত হয় এখনও। যদি বা গোটা দেশের মোটামুটি একটা ইতিহাস পাওয়া যায় (তার আবার বেশির ভাগ রাজা-রাজড়াদের কথা) আঞ্চলিক ইতিহাসের বড় অসদ্ভাব। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হবার পরে রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য মহাজনেরা আঞ্চলিক ইতিহাস সংগ্রহ ও রচনার উপর জোর  দিয়েছিলেন।  ইতিহাস তো শুধু রাজনীতির গতি-প্রকৃতির নয়, ইতিহাস মানুষের জীবনচর্যার সঙ্গে যুক্ত সব কিছুরই।

বহুকাল পরে, বিশ শতকের শেষের দিকে  ড. অমরনাথ করণ সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ইতিহাস রচনার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। অসুবিধে ছিল অনেক। পেশাদার গবেষক তিনি নন। জীবিকা অর্জনের জন্য তাঁকে ১০টা-৫টা কাজ করতে হয়। তারই ফাঁকে সময় করে নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন অনুসন্ধান। সেখানেও অনেক অসুবিধে। সব তথ্য জাতীয় গ্রন্থাগার বা সাহিত্য পরিষদের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত নেই। তাই পুজোর বা গরমের ছুটিতে তাঁকে রাজ্যের বাইরে যেতে হয়েছে নানা স্থানে। প্রথম দিকে সংগঠনের উৎসাহও অবারিত ছিল না। তাই বক্র সমালোচনায় , বঙ্কিম কটাক্ষে বিদ্ধ হতে হয়েছে তাঁকে।

ড. করণের বই থেকে আমরা জানতে পেরেছি  সাহিত্য রসিক প্রবাসী বাঙালির আকুতি। একটি সম্মেলন মঞ্চ তৈরি করতে পারলে সেখানে জড়ো হতে পারেন প্রবাসী বাঙালিরা। সাহিত্য, শিল্প, সমাজ নিয়ে আলোচনার ফাঁকে যেখানে জমবে আড্ডা। বাঙালি পাবে বাঙালির স্পর্শ, বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে মনের ভাব। লাহোর, শিমলা, কানপুর, কাশীতে ছোটখাটো সাহিত্য সমিতি ছিল। কিন্তু সবকে মিলিয়ে একটা কেন্দ্রীয় মঞ্চ দরকার। এভাবেই গড়ে উঠল উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, সুশীলচন্দ্র দত্ত, শ্রীশচন্দ্র সেন,  রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রভৃতিরা ছিলেন তার উদ্যোক্তা। ১৯২৩ সালের ৩-৪ মার্চ কাশীতে হল উত্তরভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের  প্রথম সম্মেলন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে। এর  দ্বিতীয় সম্মেলন হয় এলাহবাদে,  ১৯২৩ সালের ২৬-২৭ ডিসেম্বর। লক্ষ্মৌতে যে তৃতীয় সম্মেলন হয়,  সেখানে সংগঠনটি নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে। সে নতুন নাম ‘প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’।  ১৯২৯ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত  এই নামেই পরিচিত ছিল সংগঠনটি । ১৯৫৩ সালে জয়পুরের সম্মেলনে নাম পরিবর্তন হয়। সেই নতুন নামে (নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন) সংগঠনটি আজ পরিচিত  সকলের কাছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে (দিল্লি, জামসেদপুর, আগ্রা, জব্বলপুর, নাগপুর, বৃন্দাবন, রাঁচি, বেনারস, তমলুক, কলকাতা,  শ্রীনগর, কটক,  মীরাট, মাদ্রাজ, শিলচর, আগরতলা, বোম্বাই, কানপুর, আসানসোল, পণ্ডিচেরী প্রভৃতি) নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন আয়োজন করা হয়েছে। সম্মেলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রফুল্লচন্দ্র রায়,  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,  সারদাচরণ মিত্র, জগদীশচন্দ্র বসু, দীনেশচন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রমথ চৌধুরী, স্বর্ণকুমারী দেবী, বিজয়চাঁদ মহতাব, অমৃতলাল বসু ও যতীন্দ্রনাথ চৌধুরী  প্রমুখ মনীষীদের নাম। এ বছর কলকাতার এই সংগঠনের শতবর্ষ উৎসব পালিত হচ্ছে।

কিন্তু কালের নিয়মে সংগঠনটি তার  মহিমা হারিয়েছে। যে আলোচনা ও ভাবের আদান-প্রদান ছিল সংগঠনের মূল বৈশিষ্ট্য, তা অনেক লঘু হয়ে এসেছে।  তাই দেখা যায় প্রতিনিধিরা সম্মেলনে হাজিরা দিয়েই আশপাশের দ্রষ্টব্য স্থান দেখতে চলে যান। অনেকে বলেন, সংগঠনটি বৎসরান্তে ভ্রমণের সুযোগ দেয়। অতএব গৌণ হয়ে যায় সাহিত্য। কর্মকর্তারা সাহিত্যের নিয়মিত পাঠক কি না সে প্রশ্নও জাগতে পারে মনে। প্রতিনিধিদের সংখ্যা বাড়ে , গুণগত মান বাড়ে না। সাহিত্যের সঙ্গে প্রায় সম্পর্কহীন বহু মানুষ আজ নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সদস্য। তাছাড়া আর একটি পরিতাপের বিষয় উল্লেখ করতে হয়। সরকারি নীতি ও হিন্দি এবং ইংরেজির চাপে আজ যখন বাংলাভাষার নাভিশ্বাস উঠছে, তখন সে বিষয়ে কোন সচেতনতা আমরা সংগঠনের কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখতে পাই না। শুধু বাংলা ভাষার সপক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করেই তাঁরা দায়িত্ব  শেষ করেন। যে ঐতিহ্য নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ছিল, তার শক্তিতে  বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অভিভাবকত্ব তাঁরা করতে পারতেন।

লেখক: কলামিষ্ট, ফেলোশীপ প্রাপ্ত গবেষক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট।

 

You might also like