“সরলের ভাত গাছের আগাত”

 সুশান্ত দাস(প্রশান্ত)

 

“ মানুষ ছিল সরল; ছিল ধর্ম বল
এখন সবাই পাগল; বড়লোক হইতাম “
কথাগুলো কুশিয়ারার পশ্চিমপ্রান্তে বসে চারন কবি আব্দুল করিম এভাবেই তাঁর সুরে ও লেখনীতে তুলেছিলেন; তখনকার সমাজ ব্যবস্থার তাঁর মনোলব্ধির নিদর্শনে। আর এই কুশিয়ারারই পূর্বপ্রান্তে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কালিটিকি গ্রামে করিম উল্লেখিত সারল্যতায় ভরপুর চরিত্রের এক মানুষ ছিলেন বাবু রাজেন্দ্র কুমার বৈদ্য। এখন সবাই পাগল; বড় লোক হতে চাইলেও রাজেন্দ্র বৈদ্য ছিলেন বিরল ও ভিন্ন। জন্ম ১৯২৬ সনের ফেব্রুয়ারী মাসে। পিতার নাম শরৎ রাম বৈদ্য ও মাতা নিত্য বালা বৈদ্যের ৪ সন্তানের মধ্যে রাজেন্দ্র বৈদ্য ছিলেন দ্বিতীয়।রাজেন্দ্র কুমার বৈদ্য ছিলেন আমার বন্ধু বর শ্যামাকান্ত বৈদ্যের পিতা। সৌভাগ্যক্রমে বিভিন্ন পায়-পার্বণ,বিয়ে-সাদি, পারিবারিক বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে উনার সান্নিধ্য পেয়েছি। উনার স্নেহ জড়িত কন্ঠে আপনতাকেও হার মানায় যা লিখেও প্রকৃত আপনতাকে বাহির করা আমাহতে কষ্টসাধ্য। কাছে বসলে ঠিক বুক ভরা উদারতায় সিলেটি ভাষায় বলতেন ‘ ও-বেটা বাবা ভালা নি’ বাবা না বলে সম্ভোধন করতেন না। খোঁজ নিতেন পড়াশুনা থেকে পরিবার পরিজনদের কথা। সেদিন(৩০ জানুয়ারি ২০২১)হঠাৎ যখন ফেইসবুকের পাতায় ‘চলে গেলেন বাবা’ শিরোনামে শ্যামাকান্তর ফেইজবুক-ওয়ালে স্ট্যাটাসটি চোখে পড়ে তখন আঁতকে উঠি নিজে নিজেই।হারিয়ে ফেলি শ্যামাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা। নিজের মনের কোটায় প্রথম দেখা হতে জাগতে থাকে নানা রকম স্মৃতির মন্থন। ভাবতে থাকি কন-কনে শীতে আবৃত টেমসের পাড় হতে সুরমার তীর ঘেষা সিলেট সহ জগন্নাথপুর,কালিটিকি গ্রামের স্মৃতি। উনার সাথের অপত্য স্নেহময় কাতরের স্মৃতি।

পারিবারিক পরিচিতি খোঁজতে গিয়ে জানা যায় উনার বাবা শরৎ রাম বৈদ্য ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও তখনকার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মড়ল। তৎকালীন পাঞ্চাতি সমাজ ব্যবস্থায় বিচারিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন পটু। তাঁর পত্নী নিত্য বালা বৈদ্যে ছিলেন কবিরাজ। বাবু শরৎ বৈদ্যের দুই পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। তৎকালীন সময়ে বড় পুত্র হরেন্দ্র কুমার বৈদ্য মেট্রিকুলেশন করে এলাকার অনেককে পড়াশুনা করিয়ে মাস্টার বাবু খ্যাতি অর্জন করলেও সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাঁর পেশা ডাক্তারি সেবা দিয়ে। সেই হিসাবে বর্তমানে অনেকে ডাক্তার বাড়িও বলে থাকেন। ছোট পুত্র রাজেন্দ্র কুমার বৈদ্য গৃহস্থালীর কর্মযজ্ঞ হতে সংসারের মূল ভিত্তিতে আত্ম নিয়োজিত ছিলেন। রাজেন্দ্র বৈদ্য গৃহস্থালী পারিবারিক পরিবেশে আত্ম নিয়োজিত হলেও সামাজিক পরিবেশ পরিচিতিতে ছিলেন একজন সাদা মনের সরল মানুষ হিসাবে। তাঁর প্রাত্যহিক জীবন কর্মে ছিলনা কোন কৃত্রিমতা। আচরন ব্যবহারে ছিলেন ভদ্র,কন্ঠে মধুর,পরোপকারী মনোবৃত্তি ধাঁচের মানুষ। কাউকে কখনো কষ্ট দিয়ে কথা বলতে চাইতেন না। দেহ গঠনে নাক-মুখ চুখা-চাকা, মাথার পেছনের অংশে কুকড়ী চুলের সমাহারেই যেন ভদ্রতা ও সারল্যতার ছাঁপ পাওয়া যেত।

১৯৯৬ সালে পত্নী সুমিত্রা বৈদ্যকে নিয়ে ঘুরতে আসেন ইংল্যান্ডে। থাকেন বড় পুত্র অমর বৈদ্যের বাসা ব্র্যাডফোর্ড শহরে। ঘুরে বেড়ান ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহর, স্থাপনা,ঐতিহাসিক নিদর্শন। গাল ভরে গল্প করতেন ইংল্যান্ডের প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি ইতিহাস নিয়ে। গল্প করতেন – “ওবা বাবা, কোন দিন লন্ডনে (বিলেতে) গেলে দ্যাখবায় বা; আমি যে কইতেছি”। সেদিনের চলে যাবার পর আজ সত্যি সত্যিই ভাবি, উনি যে কথাগুলো বলতেন দ্যাখবায় বা! আজ তো সত্যিই দেখছি! যখন ব্র্যাডফোর্ড শহরে প্রথম পা-রাখি তখন চোখের সামনেই ভেসে উঠে প্রকৃতিগত ছোট ছোট হিল-দৃশ্যতায় লন্ডন হতে ব্রাডফোর্ডের ভিন্নতা। লন্ডনে বাঙ্গালি কমিউনিটির আধিক্য থাকলেও সেখানে পাকিস্তানি কমিউনিটির আধিক্যের কথা।

কথা বলতেন, ‘দ্যাখবায় নদীঘেষা বিলেতের সংসদ ভবন কি সুন্দর; এর সংলগ্ন বিগবেন। বিলেতের সংসদ ভবনের সামনে পৃথিবীর বিভিন্ন গুনী রাজনীতিবিদদের ভাস্কর্য’। শুনাতেন যাদুঘরের মতো মাদামতুসো, রাণীর বাড়ি (বাকিংহাম প্যালেস) টাওয়ার ব্রীজ, ঐতিহ্যবাহী ট্যাম্পল, মসজিদসহ বড় বড় গীর্জার কথা।  স্নেহ ভরা কন্ঠে কথা বললেও কথাগুলো দিয়ে মনের কোনায় একটা আগ্রহ সৃষ্টি করতেন। তখন মনে মনে ভাবতাম ইস্ যদি এই গুলো দেখতে পারতাম! আজ আসলাম, স্বচোখে দেখলাম খুব কাছ থেকে অনুভবও করলাম। কিন্তু উনি চলে গেলেন অথচ সেদিনের কথাগুলো আজ স্মৃতি হয়ে গেলো।

বাবার স্মৃতিচারন করতে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বড় ছেলে অমর বৈদ্য বলেন বাবা ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী, কর্ম প্রেমী,আত্মীয়-বান্ধব,জ্ঞান পিপাষু-শিক্ষাগ্রহী,অতন্ত্য সাদা মনের একজন চরম সাহসী মানুষ। উল্লেখ করতে হয় আমাদের ছয়-জেঠাত্ব ভাই,দুই-জেঠাত্ব বোন নিজ-নিজ শিক্ষায় স্ব-স্ব কর্মে অধিষ্ঠিত হলেও আমরা চার ভাই সহ আমাদের সকলের বাল্য শিক্ষা যেমন- বর্ণ পরিচয়,সংখ্যা পরিচয়,নামতা শিক্ষা থেকে নদীতে সাঁতার শিখানোর মূখ্য কাজটি বাবা করে থাকতেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস যুদ্ধের ঢামাঢোলে এলাকার পর এলাকা,গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুরে ছারখার। ঐ সময়ে বাবা হঠাৎ করে উধাও। সংগে নিলেন তাঁর বেয়াই আমাদের এক মামাকে(বড় জেঠাবাবুর শ্যালক)। খবর পেলেন আমাদের মামার বাড়ি নগড়ে(সুনামগঞ্জ,গণিগঞ্জ)কেউ নেই, স্থানীয় রাজাকাররা আগুন দিয়ে সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আরো খবর পেলেন উনার দুই মামাতো ভাই সহ এক ভাগ্না যুদ্ধ প্রশিক্ষণে আছেন ভারতের ভাউয়াল ক্যাম্পে। এমতাবস্থায় ওদের সাথে দেখা করতে ও মামাদের খোঁজে গেলেন ভারতের শরনার্থী শিবিরে।
চলে গেল প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস। বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে প্রায় সবার আশা ছাড়া। পরে যখন বাড়িতে ফিরলেন তখন আমাদের গল্প করে বলতে লাগলেন ফেরত-পথে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ধরা খাওয়ার কথা, ওদেরকে রণসজ্জায় সজ্জিত স্বচোখে দেখা,তাঁদের উদ্যোম ত্যাগ ও বীরত্বের কথা। অমর বৈদ্য আরো বললেন জেঠাবাবু পেশায় ডাক্তার হলেও এলাকার কারো কারো কাছে মাস্টার বাবু হিসেবেও পরিচিত ঠিক তেমনি বাবাও সামাজিক ভাবে বাইন(বাদ্য যন্ত্রে পারদর্শী) হিসাবে পরিচিত। উনি খোল,মৃদঙ্গ খুব ভালভাবে বাজাতে পারতেন। গ্রামীন লোকজ কোন অনুষ্ঠান হলে বিশেষ করে গ্রামীন সংগীত,কীর্তন বিভিন্ন সংক্রান্তি পায়-পার্বণে বাবার মৃদঙ্গ বাজনার অন্য রকম সুখ্যাতি ছিল। বর্ষায় নৌকা বাইছে বৈটার তালে তালে কাঁসর (ঝান)মন্দিরা(করতাল)ও মৃদঙ্গের মিশ্রনে নৌকার নিশানার সাথে গতি বাড়ানোর উৎসাহ ব্যাঞ্জনা বৃদ্ধি করার যে-কৌশলী মৃদঙ্গ-বাজনা তা ভালভাবে জানতেন।

পঁচানব্বই উর্ধ্ব প্রবীন রাজেন্দ্র বৈদ্যের শিক্ষাজীবন সম্পর্কে খোঁজতে গিয়ে দেখা যায় যতোটা না সার্টিফিকেট শিক্ষায় শিক্ষিত তার চেয়ে অনেক অনেক জ্ঞানের সার্টিফিকেটে সার্টিফিকেট প্রাপ্ত। যা আরজ আলীর উক্তির অনুরূপ “বিদ্যা শিক্ষার ডিগ্রি আছে, জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই: জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন”। উনি ছিলেন জ্ঞানের ডিগ্রীর অধিকারী। সারল্যতায় ভরপুর এক নিরঅহংকারী মানুষ।

আজ উনি স্বশরীরে আমাদের মাঝে উপস্থিন নেই কিন্তু উনার স্মৃতি বিজরিত বিভিন্ন ঘটনা বার বার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে । দাঁড়াচ্ছে সারল্যতার গ্রাম্য সেই প্রবাদটি “ সরলের ভাত গাছের আগাত”(মাথায়/শীর্ষে)। হয়তো উনার সারল্যতার জন্যেই চার পুত্র সন্তান তাদের স্বস্ব কর্মে অধিষ্ঠিত। তাঁর ১ম পুত্র অমর বৈদ্য ব্যবসায়ী যুক্তরাজ্যে অধিবাসী, ২য় পুত্র রাধাকান্ত বৈদ্য ব্যবসায়ী, ৩য় পুত্র শ্রীকান্ত বৈদ্য শিক্ষক ও সর্বক্ষনিষ্ঠ শ্যামাকান্ত বৈদ্য পর্তুগাল অধিবাসী। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত পুত্র বধূঁ দিপালী বৈদ্য স্থানীয় কাউন্সিলের মেরিজ রেজিস্টার অফিসার। বড় নাতনী অঞ্জলী বৈদ্য রেডিওলজিস্ট,মধ্য নাতনী অঞ্জনা ও নাতি অমিত বৈদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আর সবার ছোট অনিকাও মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত।
উল্লেখ্য চার পুত্র সন্তানের ১১জন নাতি-নাতন সহ রেখে গিয়েছেন পুত্র,পত্নী,অসংখ্য গুনাগ্রাহী, আত্মীয় স্বজন।ভাল থাকুন রাজেন্দ্র বাবু; ভাল থাকুন। পঁচানব্বই বছরের আপনার সাংসারিক বর্ণীল জীবনে সারল্যতার উদাহরণ হিসাবে সংসার জীবনে অমর হয়ে থাকবেন। মনে হচ্ছে বারংবার গ্রামের সেই প্রবাদ “ সরলের ভাত গাছের আগাত”।

সুশান্ত দাস(প্রশান্ত): যুক্তরাজ্য প্রবাসী সংস্কৃতিকর্মী ও লেখক।

You might also like