স্মরণ: সুনীলদা কিন্তু কথা রাখতেন
দিলীপ মজুমদার
‘কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না।’ এটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতার লাইন। ‘বন্দি জেগে আছ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা। এতে যৌবনের অভিমান আছে। সুনীলদা তাঁর তেত্রিশ বছরের জীবনে কারোকে কথা না রাখতে দেখে অভিমান প্রকাশ করেছেন। আমি কিন্তু সেই বয়েসে পৌঁছে সে কথা বলতে পারিনি। কারণ কথা রাখতে দেখেছি আমি। দেখেছি সুনীলদাকেই। তিনি তখন জনপ্রিয় ও প্রতিষ্ঠিত লেখক। আমার মতো অজ্ঞাতকুলশীলের কথা না রাখলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু কথা দিয়ে কথা রেখেছিলেন তিনি। একবার নয়, একাধিকবার।
তখন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম বলে সুনীল-শক্তিগোষ্ঠী সম্পর্কে বীতস্পৃহা ছিল । এমন কি সুনীলদাকে সি আই এর চর বলেও মনে হত। তথাকথিত শ্রেণিদৃষ্টি নিয়ে তাঁর লেখা পড়তাম বলে তাঁকে অর্ধেক চিনতান। সংশোধনবাদী বলে যাঁরা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে উড়িয়ে দিতে পারেন, তাঁদের খণ্ডিত দৃষ্টিতে সুনীলরা যে উড়ে যাবেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। অবশ্য পরবর্তীকালে সুনীলদার যে মেদহীন গদ্যের প্রেমে পড়েছি, তখন যদি তার স্বাদ পেতাম, কি হত বলা যায় না।
পল্লব, ঝুমা ও বাংলাদেশি বন্ধু শামিমের তাগিদে একবার দমদমের ‘প্রথম আলো’ বাড়িতে সুনীলদার মায়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। সেখানে ছিলেন সুনীলদার ভাই অনিল, বোন আর স্বাতী বউদি। সুনীলদার মা কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘যাই করুক সুনীল, সংসারের দায়িত্ব সে কখনও ভোলে নি। স্কলারশিপের টাকা নিয়ে বিদেশে পড়তে গিয়েও সে বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে। ‘অকালে পিতৃবিয়োগের পর সংসারের কাছে কথা রেখেছিলেন মীরাদেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান। শক্তি-সুনীল এই দুই বন্ধুর মিল থাকলেও পার্থক্যও ছিল। জীবনের লক্ষণ রেখাকে একেবারে বিস্মৃত হতেন না সুনীলদা। একটা সংযমের শাসনে ফিরে আসতেন। আর তাইতো এত কাঁড়িকাঁড়ি গদ্য লিখতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ একেই বলেছেন, ‘প্রতিভার গৃহিণীপনা’।
১৯৭৩ সালের শেষ দিক। বহু পরিশ্রম করে অকালে নিহত ঢাকার তরুণ লেখক সোমেন চন্দের লেখা সংগ্রহ করেছি। মজহারুল ইসলাম ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সংগ্রহ’ নামে সে বই প্রকাশ করলেন। সেপ্টেম্বর মাসে। কিম্বার নাসিং হোমে মৃত্যুশয্যায় শায়িত মুজফফর আহমদ সে বইয়ের ভূমিকা লিখেছেন। তিনি মুখে বলেছেন, সুমন্ত হিরা তা কপি করেছে। তখন এপার বাংলায় সোমেন চন্দ অপরিচিত। বইটির প্রচার দরকার। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি। ছাপাখানার মালিক অধীর পাল একটা প্রস্তাব দিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ ছিল সুনীলদার। সুনীলদা তখন ‘দেশ’ পত্রিকায়। নামকরা পত্রিকা। সেখানে বইটি সম্বন্ধে সমালোচনা হলে পাঠকের নজরে পড়বে। অধীর বললেন, তিনি বই সমেত আমাকে নিয়ে যাবেন সুনীলদার কাছে। তখন সুনীলদা সম্পর্কে শ্রদ্ধা বা ভরসা না থাকলেও প্রস্তাবে রাজি হলাম। দেখি না মানুষটাকে কাছাকাছি। এক রবিবার সকালের দিকে অধীরের সঙ্গে গড়িয়াহাট ব্রিজের ডানদিকে সুনীলদার ফ্ল্যাটে হাজির হলাম। সোমেন চন্দের বইটি তাঁকে দিতে তিনি পাতা উল্টাতে লাগলেন। বেশ মগ্ন হয়ে। প্রায় আধঘন্টা কেটে গেল। তারপর বই থেকে মুখ তুলে তিনি বললেন, ‘এই রচনা সংগ্রহের দরকার ছিল। দেখি কি করতে পারি।’ ‘দেশ’ পত্রিকায় সনাতন পাঠকের কলামে সে বইয়ের কথা লিখলেন। সোমেন চন্দকে পুনরাবিষ্কারের চেষ্টার প্রশংসা করলেন। বইয়ের পরিশিষ্টে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিছু মানুষের সোমেন সম্পর্কিত লেখা ছিল। সেগুলো সনাতন পাঠকের মতে ‘বোকা বোকা’। সুনীলদার সে লেখা পড়ে আমার রাজনৈতিক বন্ধুরা খুব রেগে গেলেন।
পরের বছর ঘটনাচক্রে সুনীলদার মুখোমুখি হতে হল। শিবরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে পাইকপাড়ায় অসুস্থ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে দেখতে গিয়েছিলাম। সরকার যাতে শৈলজানন্দের চিকিৎসার ভার নেয়, সেই মর্মে আনন্দবাজারে একটা চিঠি লিখে, কয়েকজন লেখকের সই নিয়ে সন্তোষ ঘোষের কাছে যাবার নির্দেশ দিলেন শিবরামদা। আমি অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শিবরাম চক্রবর্তী, সরলানন্দ সেন, বিশু মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েকজন লেখকের সই নিয়ে আনন্দবাজারে সন্তোষ ঘোষের কাছে যেতে তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে যেতে বললেন। কারণ চিঠিপত্র বিভাগ দেখেন সুনীলদা। সুনীলদা চিঠি দেখে বললেন, ‘আনন্দবাজারের বিভিন্ন বিভাগে আরও অনেক লেখক আছেন। তাঁদেরও সই করিয়ে নাও। পাল্লাটা ভারি হোক। তারপরে আমি যা করার করব।’ ১৯৭৪ সালের ১মে আনন্দবাজারে বক্স করে সে চিঠি ছাপা হয়। কাজও হয় সঙ্গে সঙ্গে। তখনকার তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় সে চিঠি পড়ে তাঁর ব্যক্তিগত সচিবকে শৈলজানন্দের বাড়ি পাঠান। তারপর অসুস্থ লেখককে পি জি হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়।
ইতিমধ্যে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সংগ্রহ’এর সমালোচনা পড়ে হাওড়ার দাশনগর থেকে আইনজীবী নির্মলকুমার ঘোষ আমাকে একটি চিঠি লিখে জানান যে, তাঁর কাছে ‘বালিগঞ্জ’ নামে যে পত্রিকা আছে, তাতে সোমেনের ‘বন্যা’ উপন্যাস ছাপা হয়েছিল। সেটি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে প্রকাশ করি। আনন্দবাজারের অফিসে গিয়ে সুনীলদাকে সে বই দিয়ে আসি গ্রন্থ সমালোচনার জন্য। তিনি সে বই সানন্দে গ্রহণ করলেও কিছুদিন পরে (১৫ মে, ১৯৭৫) একটি চিঠিতে লিখলেন, ‘কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোন কারণে মতান্তর হওয়ায় আমি দেশ পত্রিকায় সাহিত্য সংবাদ লেখা বন্ধ করে দিয়েছি। সুতরাং বইটি সম্বন্ধে কিছু লেখা সম্ভব নয়। বইটি ফেরৎ পাঠালাম।’ সুনীলদার এই ছোট্ট চিঠি তাঁর চরিত্রের একটি দিক আলোকিত করে। একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক কেন কথা রাখতে পারলেন না, তার কারণ ব্যাখ্যা করে চিঠি দিচ্ছেন একজন অভাজনকে, কথা রাখতে না পারার জন্য ফেরৎ পাঠাচ্ছেন বইটি।
রাজনৈতিক গোঁড়ামি ত্যাগ করে আমি তখন এই মানুষটির ভেতরের মানুষটির সন্ধান পেয়েছি। এবার একটু দুঃসাহস হয়েছে। দেশ পত্রিকায় গ্রন্থসমালোচনা করতে ইচ্ছুক বলে সুনীলদাকে একটি চিঠি লিখি। সপ্তাহ দুয়েক পরে সুনীলদার চিঠি পেয়ে আবার বিস্ময় চমক। তিনি লিখছেন, ‘আপনি দেশ পত্রিকার জন্য মাঝে মাঝে যদি গ্রন্থসমালোচনা করে দেন, তাহলে তো ভালোই হয়। রবিবার ছাড়া অন্য যে কোন দিন দুপুরের দিকে আমাদের দফতরে চলে আসুন। এ বিযয়ে আলোচনা করা যাবে।’
সুনীলদা তখন থাকেন পারিজাত অ্যাপার্টমেন্টে। সেখানে যাতায়াত শুরু হল। দেখতাম ফোন তিনি নিজেই ধরেন। সচিব-টচিব নেই কোন। দায়সারা কথা বলেন না। সবচেয়ে বড় কথা তিনি একজন ভালো শ্রোতা। এ যুগে যা দুর্লভ। নানা অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছি তাঁকে। ব্যস্ত মানুষেরা যেমন নোটবুকে টুকে রাখেন অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ, তাঁকে তেমন করতে দেখিনি। অথচ কথা খেলাপ হত না। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। একবার তাঁকে নিয়ে গেছি নজরুল মঞ্চে, বামার লরির অনুষ্ঠানে। ফেরার পথে গড়িয়াহাটের মোড় পেরোবার পরে তিনি গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ি থেকে নেমে উনি একটা দোকানের দিকে গেলেন। উঁকি দিয়ে দেখলাম সিগারেটের দোকান। খুব সিগারেট খেতেন তিনি। কিন্তু তখন ডাক্তারের নির্দেশে সিগারেট খাওয়া বারণ। ডাক্তারকে কথা দিয়েছেন তিনি। সে কথা কি রাখবেন না? ফিরে এলেন একটা সিগার নিয়ে। সেটা জ্বালানো হয় নি। তার গন্ধ শুঁকছেন। ঘ্রাণে অর্ধভোজন আর কি! বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে আপন মনে তিনি বললেন, ‘সিগারেট খেলেই যে ক্যানসার হবে, তার নিশ্চিত প্রমাণ কি কেউ দিতে পেরেছে?’
২০০২ সালে আমি ‘শিল্পী আক্রান্ত’ নামে সোমেন চন্দের এক জীবনোপন্যাস লিখি। সুনীলদাকে তার ভূমিকা লিখে দিতে অনুরোধ করি। তিনি আমাকে ছাপা ফর্মাগুলো দিয়ে যেতে বলেন। ফর্মা দেবার পরে তিনি বললেন, ‘আজ সন্ধেবেলা সাহিত্য আকাদেমিতে থাকব। তোমার বইয়ের ভূমিকা নিয়ে যাব। তুমি নিয়ে যেয়ো’।
সাহিত্য আকাদেমির অফিস ছিল তারা তলায়, আমার বাড়ির কাছে। কিন্তু পরের দিন আমি যাই নি। কারণ আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম একদিনের মধ্যে ছাপা ফর্মা পড়ে ভূমিকা লেখা সম্ভব নয়। দুদিন পরে সুনীলদার বাড়িতে যেতে প্রচণ্ড বকুনি খেলাম। বললেন, ‘কেন এলে না? তোমার জন্য আমি সভার পরেও অপেক্ষা করেছিলাম।’
আমাদের পর্ণশ্রী সাহিত্য সম্মেলনের একটি অধিবেশনে তাঁকে সভাপতি করে নিয়ে এসেছিলাম। স্বাতী বউদিও ছিলেন। সুনীলদা তাঁর ভাষণের শেষ দিকে বলেন, ‘আপনাদের সম্মেলনের প্রস্তাবগুলো শুনলাম। তার মধ্যে একটা প্রস্তাব বাড়ি করা। এটা অবশ্যই দরকার। প্রথমে আপনাদের যে কোনভাবে এক টুকরো জমি জোগাড় করতে হবে। তারপর দেখুন সেখানে একটা কুঁড়ে ঘর করা যায় কি না। কুঁড়ে ঘর থেকে পরে প্রাসাদ করা যাবে। ছোট থেকে বড় হওয়া মন্দ কি! আমি আশা করি, আপনাদের এই পর্ণশ্রী সাহিত্য সম্মেলন আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে উদ্যোগ নিয়ে নিজস্ব ভবন তৈরি করবে। আপনারা আমাকে ডাকবেন, আমি উদ্বোধনের দিন আসব।’
আমরা সুনীলদার কথা রাখতে পারি নি। কিন্তু আমি জানি, সুনীলদা ঠিক তাঁর কথা রাখতেন।
(লেখক: কলকাতার অধিবাসী, সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ও লেখক, সত্যবাণীর কন্ট্রিবিউটিং কলামিষ্ট)