মাতাল বাঁশি

 হামিদ মোহাম্মদ

(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)

(উৎসর্গ: অসাম্প্রদায়িক মাতৃভূমি নির্মাণের উদ্দেশ্যে)

॥সাত॥

আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় নৃত্যকলার শিক্ষক শ্রীহরি দাস দু’টি ঘটনায় ক্ষুদ্ধ না হয়ে সমাজকে দুষলেন। বললেন, সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটেনি সমাজে। বৈষম্য, বর্ণপ্রথায় সমাজ এখনো অন্ধকারে নিমজ্জিত। মূল্যবোধের আকাল। আমরা এর বিপরীতে কিছুই করতে পারিনি। সাংস্কৃতিক মুল্যবোধটা জাগ্রত করতে পারিনি। অন্যদিকে, প্রেমের স্বীকৃতি দিতে সমাজ এখনো প্রস্তুত নয়। এই কদিন আগে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি মেয়ে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছে। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, মেয়েগুলো আমার প্রিয় ছাত্রী। লেখাপড়া নিয়ে আমার সাথে শেয়ার করে। অথচ তাদের মনের কষ্টটি শেয়ার করলো না। যদি শেয়ার করতো–হয়তো আমি আত্মহত্যা করতে দিতাম না। ফেরাতাম তাদের।
ক’বছর আগে, কমলগঞ্জের অসহায় নুরজাহান ফতোয়াবাজি ও নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে। আমরা শিকড়ের পক্ষ থেকে ক’জন বন্ধু এ সময় কমলগঞ্জে গিয়েছিলাম। গিয়েছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সুলতানা কামাল ও নারীনেত্রী আয়শা খানম। ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের ডাক ও আইনি ব্যবস্থা নিতে আমরা তৎপর হই। সমাজের অনৈতিকতার বিরুদ্ধে লড়তে চেষ্টা চালিয়ে যাই। নারী অধিকার নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করি। সমাজ হিতৈষীদের সম্পৃক্ত করতে পাড়ায় পাড়ায় গণসচেতনা সৃষ্টিতে লিফলেট, পোস্টার, দেয়াল লিখন, মানব বন্ধন, মিছিল করি শহরে।
এ সময় প্রায় প্রতিদিন বিকেলে আমরা প্রান্তিক চত্বরে মিলিত হই। দুষ্টচক্র থেকে সমাজের মানুষকে মুক্ত করার অঙ্গীকার শিকড়ের। সমাজকে সুস্থধারায় বিকশিত ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বা উন্নয়নে সাংস্কৃতিক বিকাশকে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় আমাদের। এ জন্য সুস্থধারার শিল্পচর্চা প্রয়োজন। সাংস্কৃতিক অগ্রগতি জরুরি মনে করি। নারী আন্দোলনে নিয়োজিত মহিলা পরিষদ, শিশুদের বিকাশের জন্য খেলাঘর, কচিকাঁচার মেলার ক্ষুদে বন্ধুদের প্রণোদনা দিতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন চলে। এদিকে সাহিত্য আন্দোলনে নতুন স্বর নিয়ে ‘মাস্তুল’ নামে গল্প সংকলন নিয়মিত বের করতে থাকেন আবু বকর মোহাম্মহদ হানিফ, জিষ্ণুরায় চৌধুরী ও পরিক্ষীত দত্ত চৌধুরী।
৮৪ সালের জানুয়ারিতে মহিলা পরিষদকে পুনর্গঠিত করতে জেলা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেলিনা তরপদারসহ মেয়ে বন্ধুদের উদ্ধুদ্ধ করি মহিলা পরিষদে কাজ করতে। নারীনেত্রী উষাদাশ পুরকায়স্থ মহিলা পরিষদের সভানেত্রী ও সাজেদা মালেক সেক্রেটারি, সাংগঠনিক সেক্রেটারি ছন্দা চক্রবর্তী। এছাড়া হোসনে আরা হেনা কচিকাঁচার মেলার চিত্রকলার শিক্ষক হিশেবে কাজ করতে এগিয়ে আসে। পাশাপাশি মহিলা পরিষদের সাংগঠনিক কাজ শুরু করে শিকড়ের নারী কর্মীরা। ধীরে ধীরে শিকড় সংস্কৃতি চক্র, মহিলা পরিষদ, খেলাঘর, কচিকাঁচার মেলা, শিশু একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমি হয়ে ওঠে আমাদের কাজের ক্ষেত্র। অল্পদিনেই স্বৈরাচার ও মৌলবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে সিলেটে। আমাদের গতিশীল কাজের ধারায় মৌলবাদীরা এক সময় কোনঠাসা হয়ে পড়ে।
এভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামে এক দশক অতিবাহিত হয়। এক দশক পর শিকড়ের কর্মীরা জীবনযুদ্ধে বিভিন্ন অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েন। শিকড়ের কর্মীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেও কাজের এসব ক্ষেত্র স্থিমিত হয়ে পড়েনি। বরং সম্প্রসারিত হয়। কাজের মৌলিক পরিবর্তন আসে। অনেক আগেই শুভেন্দু ইমাম শিল্পকলা একাডেমির সাংস্কৃতিক কর্মকর্তার কাজে নিযুক্ত হওয়ায় প্রকাশ্যে কাজ করা থেকে বিরত হন। সরকারি চাকরি বিপ্লবী কাজে বাধা হলেও সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রটি মুঠোয় আসে। শিল্পকলা একাডেমির কমিটি পূর্ণগঠিত করতে উদ্যোগ নেন শুভেন্দু ইমাম ও মাহবুব আহসান। দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রমে ছিলো সরকারি উচ্চপর্যায়ে কোন অতিথি এলেই একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। এতে জমকালো সঙ্গীত ও নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন ছিল অবধারিত। অনেকটা সরকারি কর্মকর্তার মনোরঞ্জনের জন্যই ছিল যেন সংস্থাটির কাজ। এ অবস্থায় শিল্পকলা একাডেমিকে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা বিকাশের ক্ষেত্র বা কেন্দ্র হিশেবে গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভত হয়। এতে প্রথমেই দরকার হয় পরিচালনা কমিটির পরিবর্তন। আমরা মনে করি, প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীদের সম্পৃক্ত করতে না পারলে এ পরিবর্তন সম্ভব নয়। জেলাপ্রশাসনের তত্ত্বাবধানে শিল্পকলা একাডেমি। জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে কমিটির সভাপতিও। শিল্পকলা একাডেমির কার্যক্রমকে গতিশীল করা ও গুণগত পরিবর্তনের জন্য জেলাপ্রশাসক এগিয়ে আসেন। সম্মত হন নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের। এ লক্ষ্যে ভোটার ও সদস্য সংগ্রহ অভিযানে নেমে পড়েন মাহবুব আহসান, শুভেন্দু ইমাম ও হামিদ মোহাম্মদ। চুরাশি সালের অক্টোবর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে সিলেটের সুপরিচিত সমাজকর্মী ছায়া আহমেদ, কয়েস সামী ও প্রফেসর মাহবুব আহমেদের নেতৃত্বের প্যানেলকে পরাজিত করে প্রফেসর বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, হামিদ মোহাম্মদ ও মাহবুব আহসান প্যানেল বিজয়ী হয়। বাহাউদ্দিন জাকারিয়া সেক্রেটারি মনোনীত হন। নির্বাচিত নতুন কমিটি নতুন ধারার সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু করেন। আবহমান বাংলা সংস্কৃতির হাজার বছরের সৃজনশীল ক্ষেত্রকে চর্চার কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়। ধ্রুপদী সঙ্গীতের মধ্যে রাগপ্রধান, ঠুমরি, খেয়াল, ভজন এবং পঞ্চকবি দিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত, নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের গানসহ পুরোনো দিনের গানের চর্চা বৃদ্ধি পায়। গণসঙ্গীতের মধ্যে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরী, শচীন দেব বর্মণের গান গাওয়া ও ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয়া হয়। অনুষ্ঠানসমূহের মানবৃদ্ধির দিকে খেয়াল রেখে অনুষ্ঠানের নতুন নতুন আঙ্গিক পরিকল্পনা ও শিল্পসম্মত উপস্থাপনায় মনোযোগ দেয়া হতে থাকে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে বৈঞ্চব পদাবলি, মরমীয়া ধারার শাহনুর, আরকুম শাহ, হাছন রাজা ও লোকধারার লালন, দূর্বীন শাহ, রাধারমণ, জালাল শাহ, দ্বিজ দাস,উকিল মুনসি এবং হাল আমলের শাহ আবদুল করিম, পবন দাস বাউলের গান চর্চিত হতে থাকে। নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদাসহ নানা ধ্রুপদী সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র উন্মুক্ত হয়। গতি আসে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। প্রশংসিত হতে থাকে নতুন নতুন উদ্যোগ।
শিকড়ের কর্মপ্রচেষ্টায় সিলেটে নাট্য আন্দোলনও গণমুখী ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। গড়ে ওঠে নতুন নতুন নাট্য সংগঠন। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য, নিজাম উদ্দিন লস্কর ময়না, শিবু ভট্টাচার্য, লুতফুল মজিদ চৌধুরী ছিলেন মূলত বেতার নাট্যশিল্পী। সৃজনশীল নাট্য আন্দোলন গড়ে তুলতে এর আগে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য ও নিজাম উদ্দিন লস্করের ক্ষীণ চেষ্টা থাকলেও শিকড়ের প্রণোদনায় গড়ে ওঠে সাত/আটটি নাট্য সংগঠন। ষাট দশকে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য বৈশাখি নাট্যগোষ্ঠী গঠন করে বিনোদনমূলক নাটক মঞ্চস্থ করাসহ নাট্যচর্চায় এতো দিন ব্যাপৃত ছিলেন। শিকড়ের গণমুখী কর্মধারায় তারা গণমুখী নাটক মঞ্চায়নে এগিয়ে আসেন। উদীচী গণমুখী পথনাটক মঞ্চায়ন শুরু করে। শহরের বিভিন্ন মোড়ে এ সব পথনাটক মঞ্চায়ন হয়। খেলাঘরের দুটি শাখা শহরে ক্রিয়াশীল থাকলেও দক্ষিণসুরমা এলাকায় আরেকটি শাখা গড়ে ওঠে। এই ধারাবাহিকতায় প্রায় এক ডজন নতুন নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠে সিলেটে। এ সময় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটও শক্তিশালী হয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
বছর খানেক পরে ১৯৯৫ সালে শাহজালল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চোখ নামে শর্টফিল্ম ফোরাম গঠন করেন কবি টি এম আহমেদ কায়সার। গণমুখী, দেশাত্বকবোধক এবং সৃজনশীল চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ধারা সিলেটে তখন থেকেই মূলত সূচিত হয়।
এদিকে,১৯৯৬ সালে শিকড় কবিতার পঠনপাঠনের উদ্দেশে নতুনধারার সাহিত্যচর্চার ধারাবাহিক ‘অন্তরঙ্গপাঠ‘শীর্ষক অনুষ্ঠানমালার প্রচলন করে। তার মধ্যে প্রথম অনুষ্ঠানের বিষয় ছিলো শুভেন্দু ইমামের কাব্যগ্রন্থ ‘তোমার উদ্ধার নেই। ১৩ সেপ্টেম্বর প্রফেসর আবদুল আজিজের সভাপতিত্বে আয়োজিত আলোচনায় অংশ নেন অরবিন্দ দাশ গুপ্ত, একে শেরাম, তুষার কর, নুরুজ্জামান মনি, আবুল ফতেহ ফাত্তাহ ও টি এম আহমেদ কায়সার। দ্বিতীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় কবি আবদুল গাফফার দত্ত চৌধুরীর সৃষ্টি সমগ্র নিয়ে। প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিস্মৃতি এই কবির কাব্যকর্মের উপর পঠনপাঠনে অংশ নেন প্রফেসর সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কবি দিলওয়ার, মোহাম্মদ আবদুল আজিজ, নৃপেন্দ্রলাল দাশ, পার্থসারথি চৌধুরী, মোহাম্মদ সাদিক, শুভেন্দু ইমাম ও একে শেরাম।
কবি শুভেন্দু ইমামের কবিতার বই ‘তোমার উদ্ধার নেই’ একই সময়ে প্রকাশিত হয়। হামিদ মোহম্মদ ও তুষার করের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘তোমার উদ্ধার নেই’এর পাঠক্রিয়া।
১৯৯৭ সালের ২৩ মে কবি আবুল ফতেহ ফাত্তাহর ‘নেপথ্যে জলের ছায়া‘ প্রকাশ উপলক্ষে শিকড় আয়োজন করে পঠনপাঠন ও আলোচনার অনুষ্ঠানের। আলোচনায় অংশ নেন সিলেটের কবি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা। শুভেন্দু ইমামের সম্পদনায় প্রকাশিত হয় ‘নেপথ্যে জলের ছায়া‘ পাঠক্রিয়া।
১৯৯৯ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে শিকড় আয়োজন করে কবি জীবনানন্দ দাশের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সেমিনার ও কবিতা পাঠের আসর। শুভেন্দু ইমামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বক্তব্য রাখেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ গবেষক ড.তপোধীর ভট্টাচার্য ও জীবনানন্দ গবেষক ড.স্বপ্না ভট্টচার্য।
পরবর্তীতে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিকড় প্রকাশ করে হামিদ মোহাম্মদের কাব্য গ্রন্থ ‘স্বপ্নের লাল ঘুড়ি‘। একই সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয় হামিদ মোহাম্মদের গল্পগ্রন্থ ‘হৃদয়ে রঙধনু‘ ও উপন্যাস ‘কালোদানব‘। ৭ আগষ্ট অনুষ্ঠিত হয় তিনটি গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। প্রফেসর আবদুল আজিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচক হিশেবে অংশ নেন প্রফেসর ভীষ্মদেব চৌধুরী, প্রফেসর সুরেশ রঞ্জন বসাক, সাহিত্য গবেষক সেলুবাসিত, সাংবাদিক তবারক হোসেইন, সংস্কৃতিকর্মী রফিকুর রহমান লজু, গল্পকার প্রশান্ত মৃধা, সংস্কৃতিকর্মী সামসুল আলম ও কবি একে শেরাম। ২৫ আগস্ট প্রকাশিত হয় স্বপ্নের লাল ঘুড়ির পাঠক্রিয়া। সম্পাদনা করেন সামসুল আলম ও কবি হীরা শামীম। এর প্রকাশনা উপলক্ষে আলোচনায় অংশ নেন কবি ও লেখক শামসাদ হুসাম, কবি একে শেরাম, কবি তুষার কর, কবি শুভেন্দু ইমাম, সংস্কৃতিকর্মী সৈয়দ এনামুল ইসলাম, সামসুল আলম ও আজিজ আহমেদ সেলিম।
২০০৮ সালে ডিসেম্বর মাসে শিকড় প্রকাশ করে হামিদ মোহম্মদের লেখা ‘শিকড়ের দিনগুলি ও অন্যান্য’ এবং ‘নন্দিত ভুবনে’ দুটি গ্রন্থ। গ্রন্থগুলো গত চার দশকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সাহিত্য আড্ডা ও স্বৈরাচার বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং একই সময়কার প্রথিতযশা আঠারোজন সাহিত্য ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লেখা।
শিকড়ের উদ্যোগে ১৯৮৩ সাল থেকে ‘৯০ সাল পর্যন্ত আয়োজন করে বিভিন্ন আন্দোলনমুখী অনুষ্ঠানের।‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ’, মধ্যফেব্রুয়ারি ছাত্র আন্দোলন ও পরবর্তী রাজনীতি’, বাঙালি সংস্কৃতির প্রগতিশীল ধারা’ সেমিনার আয়োজন ছাড়াও শিকড় আয়োজন করে অঙ্গীকারের কবিতা, প্রতিবাদের কবিতা, বিদ্রোহী বৈশাখের কবিতা,সাম্পদায়িকতা বিরোধী কবিতা, স্বৈারাচার বিরোধী কবিতা,স প্রতিরোধের কবিতা প্রভৃতি অনুষ্ঠানের। শিকড়, উদীচী ও পদাতিক সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ১৯৮৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় পারমানবিক যুদ্ধবিরোধী শান্তি সমাবেশ। ১২ নভেম্বর শুভেন্দু ইমামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন দেশের বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবী আবু জাফর শামসুদ্দিন।
শিকড় প্রকাশ করে অনিয়মিত শিকড় সংকলন। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ধারাকে শাণিত করতে শিকড়ের পদক্ষেপসমূহ বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদদের কাছে আলোচ্য হয়ে ওঠে। সৎ ও নিষ্ঠাবান সংস্কৃতিকর্মী সৃষ্টিতে শিকড়ের কৃতি, শ্লাঘার বিষয়। তখনকার এক ঝাঁক সংস্কৃতিকর্মী কোন সাংগঠনিক গাঁথুনি ছাড়াই মোহগ্রস্থের মতো সম্মিলিত অস্তিত্বের লড়াইয়ে ব্যাপৃত ছিল। এক অসম্ভব শক্তিধর দেবদূতের মতো তারা কাজ করে দিনকে রাত রাতকে দিন করে। সারা স্বৈরশাসন আমল তার সাক্ষী।
তবে রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক দায়বোধের প্রধান আয়ূধ ছিল– কবিতাই। শিকড়ের কর্মোদ্দীপনায় স্বরচিত কবিতা পাঠ হয়ে ওঠে যে কোন অনুষ্ঠানের প্রাণ। আর কবিতা আবৃত্তিকে এর আগে সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তেমন গুরুত্ব দেয়া হতো না। শিকড়-ই কবিতা আবৃত্তিকে সিলেটে জনপ্রিয় করে তোলে এবং আবৃত্তিকে শিল্পের অন্যতম মাধ্যম হিশেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।
১৯৮৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ও ২৬ মার্চ, ১৯৮৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শুভেন্দু ইমাম ও হামিদ মোহাম্মদের সম্পাদনায় ‘শিকড়’এর তিনটি সংখ্যা, শুভেন্দু ইমামের সম্পাদনায় আরও তিনটি সংখ্যা ১৯৯০ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি এবং ১৪০০ বঙ্গাব্দের (১৯৯৩) প্রকাশিত হয়। আফতাব হোসেইনের সম্পাদনায় প্রতিবাদের কবিতা (জুন ৮৩) ‘শিকড়’ এর একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
সিলেটের সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যাঙ্গনে সৃজনশীল ধারা সৃষ্টিতে শিকড় একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। যার ঔজ্জল্যে আবৃত্তি একটি শিল্প হিশেবে বিকশিত হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিতে শতাধিক শিশু ও তরুণ আবৃত্তিকে শিল্পশিক্ষা হিশেবে বেছে নিয়েছে, চর্চা করছে নিয়মিত। জাতীয় বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে- ছিনিয়ে আনছে পদক। আবৃত্তিশিল্পী মুনিরা পারভীন আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় জাতীয় শীর্ষ পদক অর্জন করে। আবৃত্তিকার নজরুল কবীর বাংলাদেশের জাতীয় টেলিভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ পাঠকের মর্যাদা পান।
ইতিহাস থেমে থাকে না। ইতিহাস গতিশীল। শিকড়ের কাজ ও ইতিহাস সৃষ্টির পথপরিক্রমায় গতি হারায় না। এই প্রেক্ষাপটে শিকড়ের কর্মীরা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েন দেশের ভেতরেও নানা পেশায়। দেশের বাইরেও চলে যান অনেকে। কিন্তু শিকড়ের কাজ থেকে কেউ সরে পড়েননি।
আমাদের কাজকর্মের এই ধারায় শুভেন্দু ইমাম, অধ্যাপক আবদুল আজিজ ও আবুল বশর তিনজন মিলে বের করেন ‘প্রতিশ্রুতি’ নামক মননশীল একটি সাহিত্যপত্র। এতে যুক্ত ছিলেন আফতাব হোসেইনসহ এক ঝাঁক তরুণ।
এদিকে, শিকড় সংকলন প্রকাশনার পাশাপাশি গ্রন্থ প্রকাশনায় উদ্যোগ নেয়া হয়। শিকড় থেকে বের হয় আবুল ফতেহ ফাত্তাহর কবিতার বই ‘নেপথ্যে জলের ছায়া’ শুভেন্দু ইমামের কবিতার বই ‘তোমার উদ্ধার নেই’, হামিদ মোহাম্মদের কবিতার বই‘স্বপ্নের লাল ঘুড়ি’। ব্যক্তিগত উদ্যোগে হোসনে আর হেনা বের করেন ‘সূর্যের বৈভব দাও’, তুষার কর বের করেন কবিতার বই ‘আমার কিছু কথা আছে’। নুরুজ্জামান মণি বের করেন ‘রাজার টোপর পড়ে গেছে’।
শিকড়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের ধারাবাহিতকতায় আঞ্চলিক ইতিহাস রচনায় আমরা মনোনিবেশ করলাম। অল্পদিনেই ‘বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস প্রণয়ন পরিষদ গঠন করে পর্যাক্রমে ‘বৃহত্তর সিলেটের ইতিহাস’ দু‘ খণ্ড প্রকাশ করা হল। সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে আঞ্চলিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে নিরলস শ্রম দেন প্রফেসর আবদুল আজিজ, প্রফেসর হাবিবুর রহমান,শুভেন্দু ইমাম,রফিকুর রহমান লজু, সামসুল আলম, ফারুক আহমেদ ও হামিদ মোহাম্মদসহ এক ডজন সংস্কৃতিকর্মী ও লেখক। এ সময় প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামের ধারক, মননশীল ব্যক্তিত্বদের জীবনী রচনাও আমরা জরুরী মনে করি। এ চিন্তা চেতনা থেকে পরবর্তীতে প্রকাশ করা হয় প্রফেসর হাবিবুর রহমান স্মারকগ্রন্থ। এর প্রকাশনার কাজ তাঁর জীবতকালে শুরু হলেও প্রকাশের আগেই তিনি প্রয়াত হন। তাই,যা সম্মাননা গ্রন্থ হওয়ার কথা ছিল তা স্মারকগ্রন্থ হয়ে প্রকাশিত হয়। পরে প্রফেসর আবুল বশর ও প্রফেসর আবদুল আজিজ সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সালের ভেতরে ইতিহাস রচনা প্রকল্প ও সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশের কাজ সম্পন্ন হয়।
এসব কাজের আগেই আমাদের আন্দোলন সংগ্রামে নতুন মোড় নেয়। ব্যক্তিগত ও বৈশ্বয়িক বিভিন্ন কারণেও এ মোড় নেয়া অবধারিত ছিল। ব্যক্তিগত নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রও বদল হতে থাকে। আন্দোলন সংগ্রামে এ পরিবর্তনের আরও বহুবিধ কারণও মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। বিদ্যমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটও বদলে যায়। যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আশার বাতি জ্বালিয়ে বিশ্বকে চমৎকৃত করেছিল, সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন চোখের সামনেই মিলিয়ে যায় বা ধসে পড়ে। কেন মিলিয়ে গেল–এসব প্রশ্নের উত্তর ঘুরপাক খাচ্ছে দেশ থেকে দেশে। কেউ বলেন, নেতৃত্বের সংকট আবার কেউ বলেন ব্যর্থ নেতৃত্ব। তবে বিশ্বের মানুষ দেখেছে ও প্রত্যক্ষ করেছে দুই জার্মান বার্লিন ওয়াল ভেঙে এক হয়ে গেল একদিনেই। হুড়মুড় করে এদিকের মানুষ ওদিকে গেল। আর রাশিয়ায় ট্যাঙ্কের নীচে মানুষ শুয়ে পড়লো হাজারে হাজার। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার রাষ্ট্রের পতনের পর মানুষের বিশ্বাসে ফাটল ধরে। মানবমুক্তির সাম্যবাদের ধারার প্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে রাস্তায় ট্যাংকের নীচে শুয়ে-পড়া প্রতিবাদী মানুষকে না মেরে সরিয়ে আনা হলো ট্যাঙ্কবহর। আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ বাঁধার আশংকা থেকে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট গর্বাচভ বুদ্ধিজোরে আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বকে রক্ষা করেন। যদিও এ কল্পনাতীত পরিবর্তন মেনে নেয়া সহজ ছিল না। এর ছায়া বা প্রভাব পড়ে বিশ্বব্যাপী। কেউ বলছেন সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। কেউ কেউ বলেন ব্যর্থ হয়নিÑবাকবদল মাত্র। আবার এও শুনি–সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠায় প্রচলিত রাষ্ট্রকাঠামো ব্যর্থ।
আবার অন্যভাবে বলা হচ্ছে, দায়ী করা হচ্ছেÑউৎপাদন ব্যবস্থাকে। উৎপাদনে রূপান্তর না-ঘটানোই বিপদ হয়েছে। শ্রমঘন উৎপাদন ব্যবস্থা প্রযুক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়ে, হার মানে, উৎপাদনে ধস নামে। মূলত চাহিদার তুলনায় উৎপাদন পিছিয়ে পড়ে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন না ঘটিয়ে কিভাবে সমাজকে টিকিয়ে রাখা যাবে? অনেকের এ রকম মত ও বিশ্বাস। এখানেই মার খায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা, এ ধারণাও প্রকট।
বিশ্বপ্রেক্ষাপটে দেখা গেল, মানবমুক্তির মহান নেতা লেলিন, মার্কস ও এঙ্গেলসের ভাস্কর্য নির্দয়ভাবে ভেঙে সরিয়ে ফেলা হল পূর্ব ইউরোপের সর্বত্র। অল্পদিনেই উল্টোপথে চলতে শুরু করে রাশিয়া ও পূর্বইউরোপ। যুগো¯øাভিয়াও ভেঙে টুকরো টুকরো শুধু হল না, জাতিগত নীপিড়নের শিকার হল হাজার হাজার মানুষ। অবাক হওয়ার মতো নানা কাণ্ড ঘটে চললো দেশে দেশে। বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতিতেও নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে। যেখানে নতুন সমাজ নির্মাণের পথ খোঁজা হচ্ছিলো সোভিয়েতের আদর্শিক পথে। সেখানে সব কিছু তছনছ হয়ে যায়।
পূর্ব ইউরোপের এ ধসের পর হতোদ্যম হয়ে আমাদের তরুণ সমাজ দিকবিদিক ভাবতে শুরু করে। থেমে যায় চেতনার প্রবাহ। এই সুযোগে ঝেঁকে বসে আবার মৌলবাদ, ধর্মের গোড়ামি। ধর্মের অপব্যবহার শুরু হয়। দিনে দিনে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির উত্থান ঘটে, সমাজকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। দেশের নেতৃত্ব আরও পাকাপোক্ত হয় সামরিক আধা-সামরিক আমলা ও লুটেরা শ্রেণীর হাতে। মানুষও যেন আত্মসমর্পন করে নিজেকে বাঁচাতে চায়। এই বাঁচার লড়াই আদর্শহীন নাম পরিচয়হারা ধু¤্রজালের মধ্যে চলছে, চলবে। তবে সমাজের গতিটা নাম পরিচয়হীন হলেও মানবিকতাই প্রধান সপৃহা। মানবিকতা মানুষের মধ্যে মরে মরে, নিভু নিভু জাগ্রত বা বিদ্যমান আছে।
কিন্তু এই সুযোগে বিশ্বপুঁজিবাদ আরও বেশি আগ্রাসী হয়েছে। দেশে দেশে পুজিবাদ আগ্রাসী থাবায় বিপন্ন করে তুলেছে মানবতা। নতুন নতুন কৌশলে পৃথিবী ধাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে এর ধারকরা। একদিকে, মৌলবাদ উসকে দিচ্ছে, অন্যদিকে মৌলবাদকে উপড়ে ফেলতে যুদ্ধ বাঁধাচ্ছে দেশে দেশে। আসলে মৌলবাদ উপড়ানোর নামে ভেক ধরেছে। অস্ত্র দিচ্ছে সিরিয়া ও ইরাকে আইসিসকে। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও মূলত যুদ্ধ করে যাচ্ছে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে। এর আগে, আফগানিস্তানেও একই কৌশলে আলকায়দার পৃষ্টপোষকতা করেছে পশ্চিমা পুজিবাদী বিশ্ব। ইরাকে সাদ্দামকে সরিয়ে বসায় শিয়াদের। সাদ্দামকে স্বৈরাচার ও দুনীর্তিবাজ আখ্যা দিয়ে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়ে মারে। পরে লিবিয়ায়ও একই কায়দায় গাদ্দাফিকে হটায়। এতো কিছুর পর মানুষ কি বাঁচতে পারে? গৃহহারা হয়ে মানুষ ছুটছে ইউরোপে। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে উঠছে ইতালি, গ্রীস। ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপের দেশে দেশে। মায়ানমায়ারেও একই দশা। মায়ানমায়ার সরকার রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে দেশ থেকে। আসছে বাংলাদেশে। আরও যাচ্ছে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালেয়শিয়া, থাইল্যাÐ। সঙ্গে বাংলাদেশীরাও। এসব মানব পাচারেও রয়েছে দালাল চক্র। মধ্যযুগীয় পন্থায় মানুষ বিক্রি বা দাস প্রথা না থাকলেও আধুনিক মানব পাচারের নৃশংসতা কম নয়। খাবার না দিয়ে জাহাজ বা নৌকা থেকে ধাক্কা দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেয়া হচ্ছে। একজন দুজন নয়Ñ শত শত মানুষকে এভাবে মেরে ফেলা হচ্ছে। অনেককে ডাঙায় তুলেও দালালরা জিম্মি করছে টাকার জন্য। টাকা না দিলে মেরে গণকবরে মাটি চাপা দিচ্ছে। সবখানে মানবতা বিপন্ন। বিশ্বব্যাপী এই বিপন্নতা। আমাদের মনে হতে থাকে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে পারে অভিবাসী সমস্যা নিয়ে। পৃথিবীর এক কোটি মানুষ খাবার খেতে পায় না। ক্ষুধা ও দারিদ্রতা এদের জীবনেরই অংশ। ইকোনমিস্ট পত্রিকার মতে, মাত্র ৮০ জন মানুষের হাতে পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ। এই হিশেব যদি সত্য হয়, পৃথিবীর মানুষ বাঁচবে কি করে? আরেক তথ্যে জানা গেছে,এই ৮০ জনেরই অস্ত্রের ব্যবসা। অতএব মারপ্যাঁচটা কোথায় বুঝতে বাকী নেই। জাতিগত দাঙ্গা, মৌলবাদ উসকে দেয়া কাদের কাজ! তবে বিশ্বব্যাপী মানুষ এখন একটু পেছনে গেলেও ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবেÑঅধিকার ছিনিয়ে আনবেই। খাদ্যের ভাগ বা হিস্যা আদায় করবেই। অভিবাসী যুদ্ধই হউক আর অন্য কোন বিষয়কে নিয়ে যুদ্ধই হউক মানুষ লড়াই করেই দাঁড়াবে।
২০১৫-এর আগস্ট মাসের একটি খবর বিশ্বব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করে,কাঁপিয়ে তোলে বিশ্ব মানবকে। সংবাদটি লাহিয়ান নামের এক সিরিয়ান শিশুর লাশ সমুদ্রোপকূলে উপুড় হয়ে পড়ার দৃশ্য সম্বলিত। শিশুটি কথা না বললেও বিশ্বমানবতাকে নাড়া দিয়েছে। বাকহীন বা মৃত শিশুর মতো বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে বিশ্ববিবেক। মিডিয়ার চিৎকারও গগণবদিারী। ‘নির্বাক মানবতা!‘বলে চিৎকার শুরু হয় বিশ্বব্যাপী। আর সিরিয়ায় মৌলবাদী আইসিস আইয়ের নির্যাতনে হাজার হাজার মানুষ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পালাতে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মরছে। লাহিয়ান নামের শিশুটিরও ভাগ্য এইভাবেই বিড়ম্বিত হয়।
বাংলাদেশেও মৌলবাদকে উসকে কারা দিচ্ছে? এটাও সবাই এখন জানে, সবাই ওয়াকিবহাল। তবুও বিভ্রািন্ততে ভুগছে মানুষ। যার ফলে বিশ্বাসহীনতাই জন্ম নিয়েছে সকল জায়গাজুড়ে, সমাজে, জীবনযাপনে।
বিশ্ব কেন, বাংলাদেশেও চিরচেনা জগতটাকে রীতিমত ভয় পেতে থাকে মানুষ। দিন দিন জটিল হচ্ছে পৃথিবীটা। ধুসর লাগছে সব কিছু। কবি জীবনানন্দ দাশ ‘ধুসর পাণ্ডলিপি‘ লিখেছিলেন কি এই রকম অবস্থায় পড়ে? মানুষের জীবনটাই কি এইভাবে ধুসরতায় ভরা! কোন বা ‘মাতাল বাঁশি’ বাজে? আকাশে বাতাসে ভাসছে অচেনা সুর! (চলবে)

You might also like