পথের গল্প

 রেনু লুৎফা

রহমত আলীর সাথে সুজানের যখন সম্পর্ক শুরু হয় তখনও তিনি আলেক্সের গার্লফ্রেন্ড। আলেক্সের সাথে ছ’মাসের একটি মেয়েও রয়েছে। মেয়ের জন্মের পর থেকেই আলেক্স বদলে গেছে। ঠিকমতো বাসায় আসে না, টাকা পয়সা দেয় না, বাসায় কোন খরচ করে না। উপরন্ত সুজানের এটা ওটা চুরি করে নিয়ে যায়। বাড়িতে যখন ই আসে ঘোর মাতাল থাকে। কারনে অকারণে সুজানের গায়ে হাত তোলে। ২/৩ দিন পর পর বাসায় পুলিশ আসে। রহমত আলী সুজানের সাথে একই ফ্যাক্টরি তে কাজ করতেন, মেয়ের জন্মের পরে সুজান কাজ ফিরে যায়নি। একই এলাকায় পাশাপাশি ফ্লাটে থাকেন। রহমত আলী নিজের ফ্লাট থেকেই সব শুনেন। কিছু বলেন না। আলেক্স কে তার বড় ভয়। দৈত্যের মতো ছ’ ফিটের উপর লম্বা আলেক্স এর পিটানো শরীর। দেখলেই রহমত আলীর গলা শুকিয়ে যায়।
আলেক্স বাসায় না থাকলে সুজান ব্যাল্কনীতে এসে দাঁড়ান। রহমত আলী টুকটাক আলাপ করার চেষ্টা করেন। সিগারেট ছুড়ে দেন। আলেক্স বাসায় না থাকলে টুকটাক বাজার করে দেন। সুজান তার অসুখী সহবস্থানের কথা বলতে শুরু করেন। রহমত আলী বাচ্চা শিশুর জন্য এটা ওটা কিনে দেন। ধীরে ধীরে আলেক্স বাসায় না থাকলে রহমত আলী সুজানের বাসায় যাওয়া আসা শুরু করেন। তারপর একদিন সুজান জানায় রহমত আলী বাবা হচ্ছেন। আলেক্সের মুখামুখি হওয়ার সাহস কারো নেই। পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
রহমত আলীর এলাকার লোকজন লন্ডনে বাসা বেধেছেন, তাদের সাথে শলাপরামর্শ করে লন্ডনে একটি বাসা খুঁজে নিলেন তিনি। তারপর একদিন আলেক্স এর জীবন থেকে পালিয়ে বার্মিংহাম শহর ছেড়ে লন্ডন এসে বাসা বাঁধেন সুজান আর রহমত আলী। সুজান আর আলেক্স এর মেয়েটিকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দেন রহমত আলী। সময়টি ১৯৬২ সাল। কাজ পেতে সময় লাগলো না। ইহুদী একটি কাপড়ের কারখানায় রহমত আলী কাজ শুরু করলেন।
লন্ডনে এসেই প্রথমেই রহমত আলী কোর্টে গিয়ে সুজানকে বিয়ে করলেন। সেই যুগে বাংগালী পুরুষের ইংরেজি জানা শাদা বউ থাকা মানে আশেপাশের সকলের সকল ধরনের কাজে সহায়তা করা।
সুজান আর রহমত আলীর দিন ভালোই যাচ্ছে। দেশে বাড়ি, জায়গা প্রচুর কিনেছেন। বাড়িতে লম্বা দালান তুলেছেন। ইতিমধ্যে তাদের ঘরে চারটি সন্তান। ৩টি মেয়ে এবং একটি ছেলে। মেয়ে তিনটি বড় ছেলেটি ছোট। বড় দুটো স্কুলে যেতে শুরু করেছে, বাসায় মায়ের সাথে ইংরেজীতে কথা বলে। রহমত আলীর মন কেমন কেমন করে। কোথাও যেন শূন্যতা খুঁজে বেড়ান। সুজান কে নিয়ে দেশে যাবার পরিকল্পনা করেন। সুজান জীবনে কোন দিন প্লেনে চড়েন নি। সহসাই রাজী হয়ে যান। তারপর একদিন বাক্স পেটরা সহ দেশে রওয়ানা দেন তারা। দেশে রহমত আলীর বিরাট বাড়ি। চারিদিকে আম কাঠাল জাম, কমলা লেবুর বাগান। বিরাট দিঘি, দিঘিতে প্রতি দিন মাছ ধরা হয়। ছেলেমেয়েরা বাড়িতে এসে খুব খুশী। চারিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়ি ভর্তি দাদা, দাদী, চাচা, চাচী, ভাই বোন। এরা এক কোল থেকে আরেক কোলে যাচ্ছে। আত্মীয় স্বজনের আদর সোহাগ যেন উপছে পড়ছে। ২/৩ সপ্তাহ যাবার পর সুযোগ বুঝে রহমত আলী কথাটি বলে ফেলেন। বাচ্চাদের ক’দিনের জন্য এখানে রেখে গেলে এরা বাংলা কথা বলা আর নামাজ রোজা সম্পর্কে শিখে যেতে পারবে। সুজানের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। তিনি চিৎকার করে ঊঠলেন। রহমত আলী গরম গলায় বলেন, না রেখে গেলে না রাখবে, আমি বললাম শুধু এদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে। সুজান লক্ষ্য করেন আত্মীয় স্বজন সকলেই একই সুরে কথা বলছেন। কিছুদিন পর একসময় রহমত আলী জানালেন তার কাছে লন্ডন ফিরে যাবার টিকেট এর টাকা নেই। তিনি ধার করে টিকেট কেনার চেষ্টা করছেন। সুজানের করার কিছু ছিল না। রহমত আলী কথা দেন আগামী দুই মাসের মধ্যেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাবেন। সুজানের মনে সন্দেহ হলেও তার করার কিছুই ছিল না। বাধ্য হয়ে সন্তানদের রেখে ইংল্যান্ড ফিরে আসেন। রহমত আলী তার কথা রাখেন নি। ছ’ মাস পর পর বলেই তিনি সময় পার করেছেন। ছেলেমেয়েদের জন্য আশান্তি করতে করতে সুজানের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। রহমত আলী বলেন, তোমার শরীর ভাল হলেই নিয়ে আসবো। তারপর একটার পর একটা অজুহাতে সময় যায়।
২৫ বছর পর যখন বড় মেয়ের সাথে দেখা হয় সুজানের, তখন সে এক বর্ণও ইংরাজি বলতে পারে না। সে নিজে ২ সন্তানের জননী। বিয়ে করে স্বামী নিয়ে বাস করছে সে এখন লন্ডনে। আলেক্সের ঔরসে জন্ম নেওয়া মেয়েটি এখন পুরো সিলেটি কথা বলে! মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই সুজান আলেক্স কে দেখেতে পেলেও কেউ কারো হৃদয়ের উষ্ণতা খুঁজে পান না।

(এ ভাবেই শত শত রহমত আলি শিশুদের মাতৃহারা করেছেন,  ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে গেছেন তাদের মায়ের কাছ থেকে।)

রেনু লুৎফা: লেখক ও শিক্ষাবিদ

You might also like