মাতাল বাঁশি

 হামিদ মোহাম্মদ

(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)

(উৎসর্গ: অসাম্প্রদায়িক মাতৃভূমি নির্মাণের উদ্দেশ্যে)

॥দুই॥

আমি এখন পঁয়ত্রিশ বছরের যুবতী। আমার বয়স যখন পনেরো তখন লন্ডনে আসা। আর লন্ডন থেকে বাংলাদেশে যাই দশ বছর পর পঁচিশ বছর বয়সে। বাংলাদেশে দশ বছর থেকে আবার লন্ডনে ফিরে আসা। লন্ডনে কেন ফিরে আসা আর কেন বাংলাদেশ যাওয়া হয়েছিল, সব কিছুই একটি ঘোরলাগা অধ্যায়। এই ঘোরলাগার ভেতর ডুব দিয়ে আছেন যেমন আমার মা, তেমন আমার বাবা। আমি সেই ঘোরের ভেতর যাতায়াত বা বিচরণ করেছি বা করছি, নিজেকে খুঁজতে গিয়ে ঘটেছে নানা বাক বদল। এমনি এক তপ্ত অভিজ্ঞতার ভেতর আমার লন্ডন ফিরে আসা।

বাবা প্রায়ই বলতেন তার পিতার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কথা। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাব তাকে পীড়িত করতো। এক সময়, তার এক ধরনের ইচ্ছা ছিল যদি কোন সন্তান হয় তাকে ডাক্তারি পড়াবেন। দাদার বিনা চিকিসায় মৃত্যুর কারণে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা জেদের কারণও হয়ে দাঁড়ায়। দাদার মৃত্যুর সময় আমার বয়স ছিল বছর পাঁচ। আমি মেয়ে হলেও বাবা তার সন্তানকে ডাক্তার বানানো থেকে সরে আসেননি। বরং দেখা গেছে কোন কোন সময় বাবা ছেলে-সন্তানের চেয়ে মেয়ে-সন্তানের ওপর বেশি ভরসা করেন। আর সেই ভরসার পাত্রী ছিলাম আদ্যপান্ত আমি মাধুরী আজাদ। তার বরাবরের স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশে গ্রামের বাড়িতে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে সেই সন্তানকে বসাবেন এবং গ্রামের মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। বিনা চিকিৎসায় তার বাবার মৃত্যু হওয়াকে স্মরণ করে তখন তিনি স্বস্তি পাবেন, আনন্দ পাবেন অন্তত গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা দিতে পারায়Ñতার সন্তানের মাধ্যমে।

আমি ডাক্তার হয়ে বাবার সে স্বপ্ন পুরণ করেছিলাম। ডাক্তারি পড়া সমাপ্ত করে দেশে গিয়ে গ্রামের নিকটে বইটিকরস্থ শ্যামগঞ্জ বাজারে একটি দশ বেডের হাসপাতাল চালু করেছিলাম। হাসপাতাল নির্মাণ খরচ বহন করেন আমার বাবা-চাচারা। তার সখ বা স্বপ্ন আমি পুরণ করি। এই ছিল সাদামাটা বাংলাদেশ যাপনের বিবরণ।

কিন্তু আমি বাংলাদেশে গিয়ে দেখি, আসলেই চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল বড়ই করুণ। অসংখ্য প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতাল এমনকি প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ গড়ে ওঠেছে, যেগুলো চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করছে। বাণিজ্যটাও যেনতেন প্রকারের নয়, রীতিমত লোমহর্ষক। চিকিৎসার নামে রোগীর সর্বস্ব লুটপাট, রোগীর লাশ আটকিয়ে বিল আদায়সহ কত কী ঘটছেÑ যাকে হরিলুট বলে। হরিলুট শব্দটির যে প্রকৃত একটি বিভৎস মানে আছে, সেটার যথাযথ ব্যবহার বাংলাদেশের চিকিৎসকরা চালু রেখেছেন, এক ধরণের বিনা বাধায়। আরো দেখেছি, চিকিৎসার নামে অযথা  নানা  টেস্ট, রোগীকে খামোকা আইসিইউতে রেখে বিল আদায়, আরো কত কী।

আমি সেই অবস্থার বিপরীতে চালু করলাম এক টাকার বিনিময়ে রোগী দেখা এবং পারতপক্ষে অল্পদামে রোগীকে ঔষধ প্রদান। তাও একটি অজো পাড়াগায়, যেখানে পাশ করা ডাক্তাররা যান না, তাদের রুচিতে বাঁধে–এরকম একটি পরিবেশে আমার এক টাকার হাসপাতাল।

আমি যেদিন ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মহাসপাতাল’–নীচে লেখা ‘এক টাকার হাসপাতাল’ শ্যামগঞ্জ বাজার,দিরাই সুনামগঞ্জ সাইনবোর্ড লিখে টানাই, সেদিনই বেশ কয়জন নেতৃপর্যায়ের লোক এসে উপস্থিত হন। তারা আমতা আমতা করে বললেন, সাইবোর্ডে আপনি ‘শ্যামগঞ্জ বাজার’ লিখেছেন কেন? এ বাজারের নাম তো ‘আলীগঞ্জ’। কথায় বুঝা গেল তারা বিষ্মিত। আমি স্বভাবসুলভ উত্তরে বললামÑ দলিল দস্তাবেজ গেটে পেয়েছি বাজারটির নাম “শ্যামগঞ্জ’।এছাড়া এসব বিস্তারিত আমি জানি না, জানেন আমার বাবা। আপনারা বাবার সাথে কথা বলেন। তারা তেমন বাগাড়ম্বর না করে চলেন গেল, যদিও দেখতে দেখতে বেশ কিছু লোক জড়ো হয়েছিল। সেই সঙ্গে তাদের হাসি-তামাশায় বুঝতে অসুবিধা হয়নি, তারা আমাকে পাগল টাউরিবার উপক্রম। উপস্থিত সকলের চাইতে লম্বা একজন, জমায়েত লোকদের ‘চল চল, পরে দেখা যাবে’ বলে হাত দিয়ে আগলিয়ে ঐযুবকদের নিয়ে চলে গেল বাজারের দিকে।

বাজারের কোন দোকানেই সাইনবোর্ড নেই বা কোথাও কোন সাইনবোর্ড ‘আলীগঞ্জবাজার’ দেখিনি। আমার মনে হল ছোট্ট বাজার তাই হয়ত  কেউ সাইনবোর্ড টাঙায়নি বা সাইনবোর্ডের প্রয়োজন মনে করেনি অথবা ছিল এখন নেই। তাই শ্যামগঞ্জবাজার সাইনবোর্ড টাঙানোর আগে‘আলীগঞ্জ’ নাম নিয়ে কোন দ্বিধায় পড়তে হয়নি। দু’তিন দিন পর সকালবেলা এলেন আরো কয়েকজন লোকÑচেহারায় গণ্যমান্য। তারা এসে প্রথমে আমার বাবার খোঁজ নেন। আমি বললাম, বাবা আসবেন দুপুরে। কোন সাহায্য করতে পারি? Ñবললাম আমি। তারা বললেন, না আমরা পরে আসবো। দু’ঘন্টা পর বাবা এলেন। তারাও বাজারের কোন দোকানে হয়ত  বসা ছিলেন, বাবাকে দেখে তারা ফিরে এলেন। কুশল বিনিময় করেই বললেন, আমরা ‘শ্যামগঞ্জ’বাজার সাইনবোর্ড নিয়ে মানুষের আপত্তি সম্পর্কে কথা বলতে চাইছিলাম। আপনি ছাড়া তো আপনার মেয়ে তা বুঝবেন না, এছাড়া তিনি আমাদের ¯েœহের পাত্রী, তাকে যে কোন বিষয় নিয়ে বিব্রত করা যায় না বা উচিত নয়। তাই চিন্তা করছিলাম আপনি এলে কথা বলব। আপনি বুঝবেনও। বলছিলামÑনামটি তো হবে ‘আলীগঞ্জবাজার’। ১৯৭৬ সালে এক সভা ডেকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সর্বসম্মতিক্রমে নামটি বদল করেন। ‘শ্যামগঞ্জ’ হিন্দুয়ানি নাম। তাও আবার এ গ্রামে বর্তমানে কোন হিন্দু অবশিষ্ট নেই। আগে ছিলেন, তারা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। তারা যখন কেউ নেই, তাই এই নাম বদল। ‘হজরত আলী’র সম্মানে এলাকাবাসী ‘আলীগঞ্জবাজার’ রেখেছেন। বাবা বললেন, আমিও জানি আপনারা নাম বদল করেছেন। কিন্তু আমার দলিলে তো শ্যামগঞ্জ নামটি আছে। বাবা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে প্রতিবাদ স্বরূপ ‘শ্যামগঞ্জ’ সাইনবোডটি করেছেন, তখন আমার আর বুঝতে দেরি হয়নি। তারা বেশি কথা বললেন না। নাম সম্পর্কে রেকর্ডপত্র দেখানোর কথা বলে তারা চলে গেলেন।

বাবার মুখ থেকে শুনেছি, এ গ্রামের অর্ধেক বাসিন্দা ছিলেন সনাতন ধর্মালম্বী। হিন্দু সমাজের ‘দাস’ বর্ণের কৃষিজীবী পরিবারের আধিক্য ছিল। এলাকাটি পাইলগাও জমিদার ব্রজ নারায়ন চৌধুরীর জমিদারীভুক্ত। এলাকার লোকজন বলে ‘পাইলগাইয়া মাল’। ডাউকা নদীর উত্তরপারে চেলাবিলের পেটনা বরাবর পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঈষাণ কোণামুখী দীর্ঘ একটি বড় ‘রাজআইল’ আছে। এটি বাবা আমাকে দেখিয়ে বলেছেন, এই ‘রাজআইল’ই পাইলগাঁওয়ের হদ। ‘রাজআইল’টিতে নির্দিষ্ট কিছু দূর দূর হিজল গাছ আছে, যেগুলোকে এখন টুÐাগাছ বলা হয়। যে  কেউ হয়তো একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে গাছগুলো রোপন করেছিল এক সময়Ñযা সীমানাচিহ্ন হিসেবে গণ্য। কতযুগের পুরোনা গাছ কে জানে? বুড়ো হতে হতে অনেকটা পাতাবিহীন জীর্ণ রূপ এখন। বাবা আরো বললেন, আশপাশের বড় গ্রামগুলোতে এখন আর কোন সনাতন ধর্মালম্বীরা নেই। এক সময় প্রতিটি গ্রামে ছিল অর্ধাঅর্ধি লোক, সমান সমান হিন্দু মুসলিম। জাহিরপুর মাল বা জাহিরপুর জমিদারিটি ছিল উপেন্দ্রনারায়ন সিংহ মজুমদারের। আটারো শতকে সিলেট বার প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ছিলেন সেই সনামধন্য আইনজীবী যিনি বারের ১নং সদস্যের সম্মান অর্জন করেছিলেন। তার অধস্তনরা এখনো সিলেট শহরের বাসিন্দা। কিন্তু লোকজন মনে করে, এলাকায় বা গ্রামে কোন মেট্রিকপাশ লোকও নেই বা ছিল না কোন কালে। উপেন্দ্রনারায়ন মজুমদার তাদের হিসেবের মধ্যে নেই, বাদ পড়ে গেছেন কবে। কেন বাদ পড়ে গেছেন, সেটা এই শ্যামগঞ্জ বাজার’ নাম বদলে ফেলার মাঝেও রয়েছে স্পষ্ট।

ধীরে ধীরে এসব সনাতন ধর্মালম্বীরা চলে যাওয়ার ফলে, তাদের নাম-নিশানা মিটিয়ে ফেলা হচ্ছে, কোন অস্তিত্ব নেই এখন। মনে করা হচ্ছে,পরবর্তী প্রজন্ম যাতে বুঝতে পারে-না, তাদের পূর্ব পুরুষ কারো ‘রাইওত’ বা প্রজা  ছিল। এরপর, হাত দিয়ে উত্তর দিকে দেখিয়ে বললেন, ঐ ছৈলাগ্রাম, এর একটি অংশ ‘শাসন’। এ গ্রামে একজন বিশাল সম্পদশালি ব্যক্তি ছিলেন, তার নাম ছিল ‘নদ্দিয়াবাসী’ প্রকৃত উচ্চারণ হয়ত ‘নদীয়া বাসী’ হবে। প্রবাদ ছিল তিনি ‘লাখ’র বাত্তি জ্বালাতেন।

ব্রাম্মণ থেকে শুরু করে নমশুদ্র পর্যন্ত নানা জাত ও বর্ণের বসত ছিল ছৈলা, শাসন, জাহিরপুর, বারগোপী, সরিষপুরসহ বইটিকর গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের পর এরা ভেবেছিলেন এদেশেই তারা থাকবেন, এটা তাদের বাপ-দাদার ভিটেয়। কিন্তু যেই ৪৬,  ৫০ সাল ছিল, সেই একাত্তরের পরও স্বাধীন দেশের হাল।

বইটিকর গ্রামে সারো দাশের বাড়ি ৭৬ সালে ডাকাতি হয়। ডাকাতি মানে সাধারণত ধনসম্পদ লুট। কিন্তু দেখা গেলÑনা, সারো দাশের যুবতী কন্যার উপর ঝড় বয়ে গেল। কানে কানে এসব কথা বহুদিন এ গাঁ থেকে ঐগাঁয় ছড়ায়। অল্পদিনের মধ্যে সারো দাশ জমিজমা বিক্রি করে পাড়ি দেন ভারতে। একই দশা হয় জাহিরপুরের সোনামনি চন্দর। এক রাতে ডাকাতি হয় তারও বাড়ি। এই অবস্থায় ঐতিহ্যধারি ‘শ্যামগঞ্জ বাজার’ নাম থাকবে, তা ভাবা যায় না, বদল হবেই বা বদলে যাবে। সুতরাং আপত্তি আসবেই। বাবাও অনেকটা জেদ ধরেই এই ‘শ্যামগঞ্জ বাজার’ হারিয়ে যাওয়া পরিচয়টা ফিরিয়ে আনতে স্থির থাকলেন, নাম বদলকে মেনে নেননি। সাইনবোর্ডে রাখতে চাইলেন ‘শ্যামগঞ্জ বাজার’।

আমার হাসপাতাল বাজার থেকে কমপক্ষে দু’ শ গজ উত্তরে ডাউকা নদীর পারে। বাজারের কোলাহল থেকে একটু নিরিবিলি স্থানটি। হাসপাতাল থেকেই শুরু বিশাল মাঠ, সবুজ ঘাসে ভর্তিÑদুর্বা ঘাস। বর্ষায় এই ঘাসের তলে বৃষ্টির পানি জমে। ঘাসও পানিতে গলা বাড়িয়ে একটু বড় হয়, কিছুটা লম্বা গা বাতাসে দোল খায়, সবুজে ঝিলমিল করে। বিকেল হলেই স্কুল-ফেরা বালকেরা ফুটবল নিয়ে খেলতে নামে মাঠে। শীতের দিনেও একই দৃশ্য, তবে ঘাস তুলনামূলক তেমন সবুজ থাকে না, লম্বাও হয় না। সারা বছর  গরু চরানোর  জন্য গ্রামটির একমাত্র এই মাঠটি। প্রধানত গরু চরানো হয় বলে স্থানটিকেও গোচর বলা হয়। ১৮ একরের এই গোচর এই গ্রামের গর্ব। এরকম বড় মাঠ আরেকটি আছে কুর্শিগ্রামে, যেখানে ঘৌড়দৌঁড় হয় প্রতি বছর। গ্রামের  মানুষের শ্বাস ফেলার মত সবুজ দিগন্ত বিস্তারি ডাউকা নদীঘেষা রৌয়াবিলের পুব মাথায় সবুজের এই খেলা। মালিক এখন বইটিকর গ্রাম বা গ্রামের মানুষ। সরকারের খতিয়ানে পরিত্যাক্ত ভূমি, স্বাধীনতার আগে ছিল শত্রুসম্পত্তি। মূল মালিক ছিলেন পাইলগাঁওয়ের জমিদার ব্রজ নারায়ন চৌধুরী।এখানে এই মাঠে এক সময় বান্নি ও রথমেলা হতো, আরো হত ঘৌড়দৌঁড়ও। পৌষ মাঘ ফালগুন আর চৈত্র চার মাসই জমজমাট থাকতো নানা পার্বনে, উৎসবে। বর্তমানে শুধুমাত্র পৌষ মাসে একটি বড় ওয়াজ হয় বাজারের মসজিদ কমিটির উদ্যোগে,এতেই কিছু উপরি দোকান বসে, শিশু-তরুণরা প্রাণ ফিরে পায় একদিন এক রাত।

এই গোচরের লাগোয়া জায়গাটি অনেক আগেই কিনে রেখেছিলেন আমার বাবা আহমেদ আজাদ। দলিলেই স্থানটির নাম ‘শ্যামগঞ্জ’। উনিশ শ’ পঁচাত্তরের আগের কেনা। সেই দলিল দেখেই ‘শ্যামগঞ্জ বাজার’ সাইবোর্ডে লিখিয়ে আনেন বাবা।

হাসপাতাল নির্মাণের আগে তথা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে এলাকার লোকজনকে ডেকে একটি সভা করা হয়। বাবা-ই সভার ব্যবস্থা করেন। মূলত আমি যে তার কন্যা ডাক্তারি পড়েছি, হাসপাতাল করতে চাই বা তিনি হাসপাতালের উদ্যোগ নিয়েছেন, তা গ্রামের মানুষকে অবহিত করান। বড় কোন সভা নয়, মতবিনিময় ধরনের ছোট্ট একটা আয়োজন করে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। তখন অনেকেই এতো সমীহ করেন এবং আমার বাপ-দাদার ঋণ শোধ করার ক্ষমতা বা সাধ্যি কারো নেই–এসব প্রশংসাধর্মী নানা কথা বাতাসে ভাসতে থাকে। লোকজন আমাদের হাসপাতালের জন্য নির্দিষ্ট করে কেনা জায়গাটিকে উপযুক্ত বলে প্রশংসা করেন। স্থানটি দুই বিঘা পরিমাণ ভূমি চারকোণা, লম্বাকৃতি, যেখানে একটি ভবন তৈরি করে নিতান্ত ছোট্ট পরিসরে একটি হাসপাতাল চালিয়ে নেয়া যায়।

দু’বছর গেছে দোতালা ভবনটি নির্মাণ করতে। বাবা এবং আমার মেজোচাচা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাসিব যিনি বাড়িতে থাকেন, দু’জনই নির্মাণ কাজ দেখভাল করেন। নীচে হাসপাতাল, উপরে চারটি এক বেডরুমের ফ্লাট, যেটিতে স্টাফ বসবাস করতে পারেনÑএরকম।

আমাদের বাড়ি বইটিকর লাগোয়া ঢালারচর গ্রামে। সেখানেই প্রথমে হাসপাতালটি চালু করার চিন্তা ছিল। কিন্তু বেশি মানুষের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে স্থির করা হয় হাসপাতালটি বাজারেই হবে এবং বাড়িতে একটি ফামের্সী থাকবে মাত্র। বাবার এই প্রস্তাবটি এলাকার লোকজনও সমর্থন করেন, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও  দেন তারা।

‘এক টাকার হাসপাতাল’ কথাটি দ্রুত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। যেদিন চালু করি, সেদিন স্থানীয় এমপি,উপজেলা চেয়ারম্যানসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হন। ফিতা কেটে, পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে চালু হল হাসপাতাল। উপস্থিত মেহমানদের উদ্দেশে বাবা একটি নাতিদীর্ঘ বক্তব্য প্রদান করলেন। তিনি বললেন, লন্ডনে আমাদের কিছু সম্পদ আছে, আমরা দুই ভাই এর মালিক। সেগুলো ভাড়া দিয়ে আমরা বাংলাদেশী বড় অংকের কিছু টাকা  বছরে পাই। এ টাকা দিয়ে একটি ট্রাস্ট করেছি আমাদের পিতার নামে। এই ট্রাস্টের আয় থেকেই হাসপাতাল চলবে। বাবা তার কন্যা হিসেবে আমি ডা. মাধুরী আজাদ পরিচয় করিয়ে দিলেন। যারা আমাকে শিশুবেলা দেখেছিলেন, তারা আমার দুর্দান্ত সময়টিকে মনে করে ‘চিনি’ বলে একটু হাসলেন। একটু থেমে বাবা বললেন, আশা রাখি আমার এই মেয়ে হাসপাতালটি পরিচালনা করতে পারবে, সেই সঙ্গে আপনাদের সহযোগিতা অবশ্যই প্রয়োজন। আমিও সকলের উদ্দেশে ছোট্ট একটি শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখি।

আমি সপ্তাহে তিন দিন রোগী দেখি। বাকী চারদিনের জন্য একজন ডাক্তার নিয়োগ করি। দুজন পুরুষ নার্স ও  দুজন মহিলা নার্স সঙ্গে নিলাম। আমিসহ মোট ছয় জন লোক হাসপাতালটির প্রাণ।

হাসপাতালটি চালু করার পর দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যে নানা সংকট, বিশেষত স্টাফ সমস্যা তা অনেকটা নাভিশ্বাস তুলে। নার্সরা গ্রামে থাকতে চায় না, নারী-পুরুষ নার্স উভয়েরই একই অবস্থা। লন্ডনে মা ও বাবার সাথে যোগাযোগ করে খবর পেলাম মা’র বান্ধবী ললিতা নামে একজন গুণী মানুষ আছেন, তিনি একটি বেসরকারি নার্সিং কলেজে শিক্ষকতা করেন। আমাকে পরামর্শ দিলেন তার কাছে যাওয়ার জন্য। মা আশা দিয়ে বললেন, যতটুকু তাকে জানি, তিনি মনপ্রাণ দিয়ে  তোমাকে সহযোগিতা করবেন।

খবর নিয়ে দেখেছিÑবেসরকারি হলেও বেশ নাম-ধাম আছে নার্সিং হোম’টির। অন্তত আমার নার্স সংকট সমাধানের একটা আশা তৈরি হয়। ললিতা আন্টি সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি মায়ের নিকটে। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে, তাদের প্রাণ ও ইজ্জত রক্ষার নানা কৌশল, কোন কোনটা হাস্যকর হলেও সেসময়ের জন্য অত্যন্ত বিষ্ময়করভাবে প্রয়োজনীয় ছিল। ঐগল্পগুলো শৈশবে আমার জন্য বেশ উপভোগ্যই ছিল। নিজের মাঝে আত্মবিশ্বাস তৈরী, সংগ্রামী চেতনালাভ, রক্তাক্ত ঘটনাসমূহ অতিক্রমÑসবই ছিল আমার বেড়ে ওঠার জন্য গল্প হলেও সাহসী অনুসঙ্গ। (চলবে)

 

You might also like