মাতাল বাঁশি

 হামিদ মোহাম্মদ

 

(সাহিত্যের বহু শাখায় বিচরণ হামিদ মোহাম্মদ-এর। কবিতা,গল্প, উপন্যাস এমনকি মননশীল সাহিত্য কোনটাই বাদ যায়নি। লিখেন সমান সৃজনশীলতা নিয়ে, সমান উজ্জ্বলতায়। সত্যবাণী প্রতি রোববার ধারাবাহিক প্রকাশ করবে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘মাতাল বাঁশি’। সাম্প্রতিক নানা বিষয় থেকে শুরু করে ধর্মীয় মৌলবাদী উত্থান, প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, চিকিৎসাবাণিজ্য, বাঙালি, বাংলাদেশ এবং বিলেতের অভিবাসী প্রেক্ষিত—সব একসুত্রে গেঁথেছেন লেখক। পাঠক পড়তে থাকুন,আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।)

॥চৌদ্দ॥

পনেরো দিন বাংলাদেশের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থানে ঘুরলাম, কিন্তু মনে হল ঝটিকা সফর। কয়েকদিন বিরতি দিয়ে গেলাম প্রকৃতি কন্যা জাফলং ও জৈন্তার রাজবাড়ি দেখতে।
প্রাচীনকালে জৈন্তাকে বলা হত ‘নারীরাজ্য’। সিলেটের উত্তরাঞ্চল জৈন্তা পাহাড়, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট ও কোম্পানিগঞ্জের কিছু অংশ নিয়ে জৈন্তারাজ্যের অবস্থান। প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ‘জৈমিনি মহাভারতে’ জৈন্তারাজ্যের অধিশ্বরী বীর রমনী প্রমিলার কথা উল্লেখ আছে। কথিত আছে প্রমিলার রূপ লাবন্যে মুগ্ধ হয়ে মহাবীর অর্জুন তাকে বিয়ে করেন। এছাড়া অন্য বর্ণনায় রয়েছে রাজা হাটকের মৃত্যুর পর তার পুত্র গুহক সিংহাসনে বসেন। তার তিন পুত্র লড্ডুক, গুড়ত ও জয়ন্তক’। পুত্রদের নামে লড্ডুকের অধিকৃত এলাকার নাম হয় লাউড়, গুড়কের অধিকৃত ভূমির নাম ‘গৌঢ়’ এবং জয়ন্তকের অধিকাওে থাকা অঞ্চলের নাম হয় ‘জয়ন্তিয়া’।
এখনো এই জয়ন্তিয়া বা জৈন্তা রাজবাড়ির ধ্বাংসাবশেষ-এর মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় নানা নির্দশন। জৈন্তারাজের বাড়ি, প্রকাশ্যে নরবলির স্থান,চÐি খাল, বিরাট বিরাট পাথরে তৈরি কেদার, ৮ম তলা বড় দেউল, পান্তশালা, ঢুপির মঠ, ৪টি বিশাল কামান। পর্যটকরা এসব ঘুরেঘুরে দেখে ইতিহাসকে ধারণ করেন।
জৈন্তার অল্প দূরেই রয়েছে প্রকৃতিকন্যা জাফলং। উপরে রয়েছে ডাউকি নদী। খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের মোহনায় এই খর¯স্রোতা ডাউকী নদী পাহাড়কে দু’ভাগ করে নেমেছে বাংলাদেশে। ভারত অংশে নদীর ওপর রয়েছে ঝুলন্তব্রীজ। নদী দিয়ে বোল্ডার পাথর থেকে আরম্ভ করে নানা জাতের নুড়ি পাথর প্রবল পাহাড়ী স্রোতে গড়িয়ে নামে বাংলাদেশ অঞ্চলে। নুড়ি পাথর আর বোল্ডার পাথরের জন্য বিখ্যাত এই স্থানটি। ডাউকি নদীর স্বচ্ছ জলও শুকনো মৌসুমে ঝিরঝির বয়ে চলা সঙ্গীতময়, আবার বর্ষায় বৃষ্টির জলের প্রবল তোড় এক অদমনীয় শক্তির আঁধার। আমরা শীতকালের এই সময়টিতে কুয়াশায় ধুমায়িত পাহাড়কে দেখে আপ্লুত হই। বর্ষায় মেঘনামা সাদা আকাশ কিংবা বৃষ্টিঝরা পাহাড়ের শুয়ে থাকার অপরূপ দৃশ্যের গল্প শুনেছি।
রয়েছে এ অঞ্চলে খাসিয়া নৃ-জাতির আবাস। সংগ্রামপুঞ্জি, নকশিয়াপুঞ্জি, লামাপুঞ্জিসহ বেশ কয়েকটি খাসিয়া বসতি। জাফলংয়ে হেলান-দেয়া উত্তরের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় সবুজ হাতছানি দিয়ে এক অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা বিলিয়ে দিতে থাকে যেন। পর্যটকদের জন্য মোহনীয় এই আবেদন চিরকালীন লাবন্যময়।
গোয়াইনঘাটের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ‘রাতারগুল’ জলাবন। বিশেষ জীববৈচিত্রের এই জলাবন মিঠাপানির। চিরসবুজ এই বনে রয়েছে করচ গাছ, মুর্তাবন, জলজ প্রাণীর অভয়াশ্রম, বেত, কদম, হিজল নানা জাতের জলসহিষ্ণু গাছ। আছে বরুন গাছ, পিঠালি, অর্জন, ছাতিম, গুটিজাম, বটগাছ। জলমগ্ন এই বনে রয়েছে সাপের আবাস বেশি, আছে জোঁক, শুকনো মৌসুমে বেজি দেখা যায়। রয়েছে বানর, গুঁইসাপ, পাখির মধ্যে সাদা বক, কানা বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঢুপি,ঘুঘু, চিল, বালিহাঁস, বাজপাখি ও বিশালকার শকুন। মাছের মধ্যে রয়েছে টেংরা, খলিসা, রিটা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালাবাউস, রুই। আমরা নৌকা ভাড়া করে বনের ভেতর ঘুরি, মাঝি গান ধরে। মাঝির গানের তেমন গলা না-হলেও মাদকতপূর্ণ গাওয়া শুনতে মন্দ লাগেনি।
একমাস পর আলাদা সময় বের নিই। আমরা বেড়াতে যাই সুনামগঞ্জের টাঙুয়া হাওর দেখতে। সুনামগঞ্জ থেকে ইঞ্জিনের নৌকায় আঁকাবাকা সুরমা নদী দিয়ে পেরিয়ে যাই দীর্ঘ পথ। পাড়ি দিই ছোট-বড় হাওর। তারপরে এক সময় পৌছি টাঙুয়া। শুকনো মৌসুম, পৌষমাস।
টাঙুয়ার জীববৈচিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল বিভিন্ন জাতের পাখি। পরিযায়ী পাখিদের মধ্যে রয়েছে বিরল প্রজাতির প্যালাসস ঈগল, আরো রয়েছে বড় আকারের গ্রে কিংস্টর্ক। রয়েছে শকুন। অন্যান্য পাখির মধ্যে আছে পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাঙচিল, বক, সারস কাক, শঙ্খচিল, পাতিকুট, কুড়ল। বিলগুলোর মধ্যে আছে চটাইন্নার বিল, তারকাল, রোয়াবিল, লেচুমারাবিল, রূপাবই বিল, হাতিরগাতা বিল, বেরবেরিয়া বিল, বাইল্লার ডুবি, তেকুন্না ও আন্না বিল। বিলগুলোতে আছে বিরল প্রজাতির পাখি কুট, মরচেরং, ভুতিহাঁস, পান্তামুখি, লালচে মাথা ভুতিহাঁস, লালশির, নীলশরি, পাতিহাঁস, লেনজা, ডুবুরি, বৈকাল তিলিহাঁস, বেয়ারের ভুতিহাঁস, কালোলেজ জৌরালি, কালাপাখি পেঙ্গি, মোটাটুটি ফাটানো, ইয়ার, মেটে রাজহাঁস, মাচমুরাল, লালবুক, গুরগুরি, পাতি লাল পা, গেওয়াল বাটান, লম্বা আঙুল চা পাখি, বড় গুটি ঈগল, বড়খোপা ডুবুরি, কালোগির্দি।
বাংলাদেশের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার ১৮টি মৌজা নিয়ে টাঙুয়ার হাওর। ৫১টি বিল-হাওর বিশিষ্ট অঞ্চলটি ৯,৭২৭ হেক্টর ভূমি। প্রায় ১০০বর্গ কিলোমিটারের হাওরটি মিঠাপানির। ‘নয়কুড়ি কান্দার, ছয়কুড়ি বিল’ নামে খ্যাত টাঙুয়া। সুন্দরবনের পর দ্বিতীয় ‘রামসা’র প্রকল্প এটি। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই বিশাল জলভুমি বা হাওরে রয়েছে জলজ বৃক্ষের মধ্যে হিজল, করচ, বরুন, পানিফল বা হেলঞ্চা, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া, সিংড়া, শাপলা-শালুক, গুইজ্জাকাটা, উকল। মাছ হল এই হাওরের প্রধান সম্পদ। প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। রয়েছে সরীসৃপ ও ঊভচর প্রাণী। কচ্ছপ, গিরগিট, হলুদ কাছিমসহ শত প্রজাতির প্রাণীসম্পদ টাঙুয়াকে বিশিষ্টতাদান করেছে।
আমার আগ্রহের একটি বিষয় ছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আখড়া বা পৈতৃক ভূমি ঢাকা দক্ষিন দর্শন। একদিন সময় করেই গেলাম। চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬ খ্রিঃ-১৫৩৩ খ্রিঃ) ছিলেন পূর্ব এবং উত্তরভারতের এক বহু লোকপ্রিয় বৈষ্ণব সন্ন্যাসী ও ধর্মগুরু এবং ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক। তিনি নবদ্বীপে (অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলা) হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শ্রীজগন্নাথমিশ্র ও শ্রীমতী শচীদেবীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বৈষ্ণব সমাজে তাঁকে শ্রীরাধাকৃষ্ণের যুগল ‘প্রেমাবতার’ বলে মনে করা হয়। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ছিলেন শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে ভক্তিযোগ ভাগবত দর্শনের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা ও প্রচারক। তিনি বিশেষত রাধা ও কৃষ্ণের রূপে পরম সত্ত¡ার উপাসনা প্রচার করেন এবং জাতিবর্ণ নির্বিশেষে ব্রাহ্মণ থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পর্যন্ত শ্রীহরি নাম ও ভক্তি এবং হরেকৃষ্ণ হরেরাম মহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন।
চৈতন্য মহাপ্রভুর গাত্রবর্ণ গৌর ও স্বর্ণালি আভাযুক্ত ছিল বলে তাকে ‘গৌরাঙ্গ’ বা ‘গৌরচন্দ্র’ নামে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে, ‘নিম’ বৃক্ষের নিচে জন্ম বলে তার মাতা তাকে ‘নিমাই’ বলে ডাকতেন তাই নবদ্বীপবাসিও ‘নিমাই পÐিত’ বলে তাকে অভিহিত করতেন।
চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থের বর্ণনা ও বঙ্গীয় সনাতন ধর্মালম্বীদের অনুযায়ী, ১৪০৭ শকাব্দের বা ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে চৈতন্য মহাপ্রভু ফাল্গুনী পূর্ণিমার (দোল যাত্রা উৎসব) সন্ধ্যাকালে সিংহলগ্নে চন্দ্রগ্রহণের সময় নদিয়ার নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতামাতা ছিলেন প্রাচীন গৌড়বঙ্গে নদিয়ার নবদ্বীপের অধিবাসী জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবী তথা চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টের আদি নিবাসী। ঢাকাদক্ষিনে ছিল জগন্নাথ মিশ্রের বাড়ি এবং শচীদেবীর পৈতৃক বাড়ি ছিল বালাগঞ্জ উপজেলার আদিত্যপুর। পিতা জগন্নাথ মিশ্র শ্রীহট্ট থেকে দক্ষিণবঙ্গের নবদ্বীপে বেদাধ্যয়ন ও সংস্কৃত শাস্ত্রচর্চার জন্য এসে বসতি স্থাপন করেন।
ঢাকা দক্ষিন আখড়ায় মূলত একটি ভগ্নদশা বাড়ি রয়েছে, যেটি শ্রীচৈতন্যের পিতৃদেবের বাড়ি। আখড়ার তত্ত¡বধায়ক ঘুরে দেখালেন বাড়িটি। আমরা ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে কিছুই পেলাম না। পেলাম কিছু গাল-গল্প। সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে এই মহাপুরুষের বংশ পরিচয় এবং ইতিহাস।
ঢাকা দক্ষিন এলাকাটি বর্তমান গোলাপগঞ্জ উপজেলার অভ্যন্তরে। এক সময় ঢাকাদক্ষিণের পার্শ্ববতী বিয়ানিবাজার, বড়লেখা এবং গোলাপগঞ্জে বাস করতেন নবদ্বীপাগত পাঁচজন ব্রাম্মণ। যাদেরকে দেয়া হয়েছিল তৎকালিন রাজার তরফ থেকে পাঁচটি বড় জমিদারী। বিয়ানিবাজার, বড়লেখা এবং গোলাপগঞ্জে বিস্তৃত ছিল এই অঞ্চলটি। পাঁচ খণ্ডের এ অঞ্চলটির নাম ছিল সেই সুবাদে ‘পঞ্চখণ্ড’। এই অঞ্চলটি এক সময় জ্ঞানের চর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই পঞ্চখণ্ডেই জন্ম নেন বিশ্ববিখ্যাত ন্যায়শাস্ত্রবিদ রঘুনাথ শিরোমনিসহ প্রায় এক ডজন পণ্ডিত। এদেরই ধারবাহিকতার একজন ‘শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু’। যিনি ‘বৈষ্ণব’ধর্ম প্রবর্তন করেন। বৈষ্ণব ধারার মতবাদ সহজিয়া। বৈষ্ণব ধারার কবি শ্রীনিবাস পণ্ডিতের বাড়িও এখানে। এই ধারার লোকসংস্কৃতির কবিরা হলেন চণ্ডিদাস, গোবিন্দ দাস, বিদ্যাপতি ,রাধারমণ দত্তসহ বাংলার বাউল ধারটি সমুজ্জ্বল। (চলবে)

You might also like